আবদুল হাই
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বৃহৎ একটা রাষ্ট্র ভারত। ঐশ্বর্যপূর্ণ এদেশটি যুগে যুগে বহু জাতিকে আকৃষ্ট করেছে। পূর্তগীজ ওলন্দাজদের আগমনের পর সর্বশেষ ইংরেজদের পদার্পণ ঘটে। তারা প্রায় দু’শত বছর ভারতকে শাসন, শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতনের মাধ্যমে শাসন করে। ২৩ জুন ১৭৫৭ সাল, পলাশীর যুদ্ধে ৫৩ হাজারের বিরাট সেনাবাহিনী অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত নবাব বাহিনী ইংরেজের ক্লাইভ বাহিনী মাত্র ৩০০০ সেনাবাহিনীর নিকট পরাজিত হয়ে পরাধীনতার সূচনা ঘটে। ধীরে ধীরে গোটা ভারত ইংরেজদের পদানত হয়। এরপর ১৯০ বছর ২ মাসের মধ্যে ভারতবর্ষে ২টি দেশ স্বাধীন হয়। মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠের ভিত্তিতে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সাল পাকিস্তান, ১৫ আগস্ট বিভিন্ন ধর্মের লোকদের সমন্বয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ভারতের আয়তন ৩২,৮৭,৭৮২ বর্গ কিঃমিঃ এই গণপ্রজাতন্ত্রী ভারতে ২৫টি রাজ্যপাল শাসিত এবং ৭টি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য নিয়ে গঠিত। ভারতে গড়পড়তা জনসংখ্যায় ঘনত্ব ২৫৭.৪ জন। কেরেলায় প্রতি বর্গ কিঃমিঃ ৬৫৫জন পশ্চিম বাংলায় ৬১৫ জন। সর্বনিম্ন লোকবসতি বাস করে অরুণাচল প্রদেশে, প্রতি বর্গ কিঃ মিঃ ৮জন। জনসংখ্যার ৮০% মানুষ গ্রামে বাস করে। পক্ষান্তরে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে ভারতে বর্ষের অভ্যন্তরে ২টি অঞ্চল নিয়ে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে এক অদ্ভুদ রাষ্ট্র ২টি অঞ্চল নিয়ে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র। পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান দুটি অঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ১২০০ মাইল। স্বাধীন ভারত-পাকিস্তানের বয়স বর্তমানে প্রায় সাড়ে বাহাত্তর বছর। দুটি রাষ্ট্র বর্তমানে বার্ধক্য উপনীতে দুই রাষ্ট্র যখন সবেমাত্র কিশোর বয়স পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে অর্থাৎ ১৮ বয়সে উন্নীত হয়, তখন যৌবনের দারুণ উম্মাদনায় ১৯৬৫ সারে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। লালবাহাদুর শাস্ত্রী জি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পক্ষান্তরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মার্শাল ম্যান আইয়ুব খাঁন। ১৭ দিনের যুদ্ধে কাহিল হয়ে পড়ে রাশিয়া মধ্যস্থতা মেনে শাস্ত্রী জি এবং আইয়ুব খাঁন মোটামুটি হাঁফ ছাড়লো। ২টি রাষ্ট্র যখন এক্কেবারে পূর্ণ যৌবনকালে পদার্পণ করলো অর্থাৎ ২৪ বছর বয়স তখন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সামরিক শাসক ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ফলাফলের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা অর্পণ না করে বঙ্গবন্ধুকে মিয়ান ওয়ালী কারাগারে নিয়ে গিয়ে গণহত্যা সংঘটিত শুরু করে। এদেশের মানুষ শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে নয় মাসের যুদ্ধে ভারতের সার্বিক সহায়তায় এদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বাংলা ২টুকরা হয়। পূর্ব বাংলা আজকের বাংলাদেশ পশ্চিম বাংলা ইন্দ্রিরা গান্ধির শাসনকালে বঙ্গ প্রদেশ নাম ধারণ করে। মোদী সরকার নাম পরিবর্তন করে বঙ্গ প্রদেশের নামকরণ করেন বাংলা, অথচ বাংলার খন্ডিত অংশের একটি স্বাধীন বাংলাদেশ এর আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিঃ মিঃ আমাদের জাতির স্লোগান জয় বাংলা। সাম্প্রতিকালে বঙ্গপ্রদেশের নাম বাংলা হওয়াতে মমতা জি সন্তুষ্ট যার জন্য অনেক সভা সমাবেশে তাঁর কন্ঠে জয় বাংলা শ্লোগান ধ্বনিত হয়েছে যা স্মার্ট ফোনে ভাইর্যাল হতে দেখেচি। আমাদের কাছের প্রতিবেশী রাজ্য নব মাসে বাংলা যার আয়তন ৮২০০০ বর্গ কিঃ মিঃ। ঘোটা ভারত আমাদের বাংলাদেশের অনুপাতে ৩০-৩২ গুণ বড়ো। জনসংখ্যার দিক থেকে প্রায় ১২০ কোটি মানুষের দেশ আমাদের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেশী ভারত। অর্থবিত্তে, সামরিক ক্ষমতার দিক দিয়ে ভারত অনেক এগিয়ে আছে আমাদের চাইতে। কোন কিছুর ব্যাপারে চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দেওয়ার মতো শত্তি সামর্থ আমাদের সক্ষমতা নেই। ভারতের বর্তমান বয়স প্রায় ৭২ বছর ৫ মাস। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের বর্তমান বয়স ৪৯ বছর। অর্থাৎ ভারত আমাদের ২৩ বছরের বড়ো। ভারতের সাহায্য সহযোগিতায় পুষ্ট হয়ে আমরা শত্রুুর বিরুদ্ধে মোকাবিলা করে। স্বাধীনতার অমূল্য রত্নলাভ করেছি। এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের স্বাধীনতায় ভারতের সহযোগিতার মধ্যে ছিলো এক কোটি শরণার্থীদের ৯ মাস যাবৎ আশ্রয় প্রদান ও সার্বিক সহযোগিতা। ৯ মাস ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও সামরিক সহায়তা প্রদান। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে যোগদান করে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ পাকিস্তানের ৯৩০০০ এর সেনাবাহিনীর সদস্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়ে ১১০০০ হাজার ভারতীয় সেনাসদস্য প্রাণ সংহার এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং বঙ্গবন্ধুর আবেদনে তড়িৎ গতিতে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার এসবকিছুর জন্য আমরা চির কৃতজ্ঞ। ৩২ লক্ষ আয়তনের বিশাল জনসংখ্যা ও সামরিক শক্তিতে ভারতের যে সক্ষমতা সে হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের একটা রাজ্যের সমকক্ষ। যেমন কাশ্মির আয়তনের দিক দিয়ে আমাদের দ্বিগুণেরও কিছু কম। তারপরও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে আমরা কারো পরাধীন নই।
আমরা জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্যতম এবং কমনওয়েলথের সদস্য রাষ্ট্র। আমাদের নিজস্ব পরিচিতির জন্য পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত আছে। আমরা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে নিজস্ব সরকার এবং সংসদ দ্বারা পারিচালিত। বাংলাদেশের মোট সীমারেখা প্রায় ৫১০৮.৫৭ কিঃ মিঃ এর মধ্যে ভারতের সাথে ৪১৩১.৯১ কিঃ মিঃ মায়ানমারের সঙ্গে ২৬.৬৬ কিঃমিঃ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে ৭১৬ কিঃ মিঃ, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সীমারেখার ১০ ভাগের মধ্যে ৯ ভাগ শুরু ভারতের সঙ্গে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের পূর্বাংশে ভারতের আসামের সঙ্গে ২৭৬.৭৫ কিঃ মিঃ মেঘালয় ৪২৭.৯৯ ত্রিপুরার সঙ্গে ৯০১.০৪ কিঃ মিঃ এসব রাজ্যে ঢোকার জন্য শুধুমাত্র ২৫ কিঃ মিঃ চওড়া একচিল্তে চিকন শিলিগুঁড়ি করিডোর কোনমতে ভারতের দুই অংশকে যুক্ত করে রেখেছে। আমরা ভারতের ঐক্য, সংহতি, স্বাধীনতার প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক এবং সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণে বিশ্বাসী। আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এও বিশ্বাস করে আসছি ভারতও একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এ বিশ্বাসবোধ থেকে আমরা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সমস্ত জাতিগোষ্ঠি বাংলাদেশের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ। নাগরিক আইন প্রত্যেকের জন্য সমান। আমাদের অবস্থান সকল বৈষম্যের ঊর্ধ্বে।
এদেশ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী দেশ। বিশ্বে যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর নোবেল পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকতো আমরা মনে হয় এর ব্যাপারে যোগ্যতম দেশ রূপে বাংলাদেশ বিবেচনায় থাকতো। ১৯৪৭ সালের অনেক মুসলিম নাগরিক ভারত থেকে বিতাড়িত হয়। এদের বেশিরভাগকে ঠেলে দেয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানে তথা আজকের বাংলাদেশ। এদের বেশীর ভাগ উর্দূ বা হিন্দি ভাষাভাষি। তখন থেকেই ওরা পাকিস্তান প্রিয়। বালাদেশ স্বাধীন হলেও এরা মনেপ্রাণে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে মেনে নিতে পারেনি। চট্টগ্রামের হালিশহর, পাহাড়তলীর ওয়ার্লেস কলোনী, ঢাকার মীরপুর, মোহাম্মদ পুর জেনেভা ক্যাম্প ভারত ফেরত বিহারীতে পূর্ণ। এসব পাকিস্তানি সমর্থক গোষ্ঠি যাদের পাকিস্তানে পাঠাবার শত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পাকিস্তান সরকারের অনীহার কারণে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পার্সপোর্টধারী রাষ্ট্রদ্রোহী প্রিয়া সাহা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেবের দপ্তরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি নালিশ উপস্থাপন করে বলেন, বাংলাদেশ থেকে নাকি ৩ কোটি ৭০ লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নির্যাতিত হয়ে ভারত চলে গেছে। এই মহিলার এই মনগড়া বানোয়াট বক্তব্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করে। এ উক্তি ষড়যন্ত্রের একটা অংশ এর মাধ্যমে আমাদের বন্ধুপ্রতীম ভারত রাষ্ট্রকে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার উদ্যোগ বলে নিঃসন্দেহে এক হীন প্রয়াস। ঠিক এর আগখানে ভারতের সঙ্গে ৬২ বছরের ছিটমহল সমস্যা শান্তিপূর্ণভাবে মিটমাট হয়ে গিয়েছিলো। প্রিয়া সাহার রাষ্ট্রবিরোধী ভূমিকার পর থেকে আমাদের অত্যন্ত বন্ধুপ্রতীম ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্রের নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জির মাধ্যমে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সুনামের প্রতি আঘাত হেনেছে। এরফলে দেশটিতে গণতান্ত্রিক বিভাজন উসকে দেওয়ার সামিল। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের ইকোনমিস্ট এ অসহিষ্ণু ভারত’ এর মাধ্যমে সে মন্তব্য উঠে এসেছে। ভারতের সুনাম হচ্ছে ভারত বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তৎস্থলে ভারত যদি একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে রূপান্তর হয় এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ছাড়া মুসলিম ধর্মাবলম্বীদেরকে যদি বক্রচোখে দেখা হয় তবে ২০ কোটি মুসলমিদের স্বার্থ নিশ্চয় অমর্যাদাকর হবে নিশ্চিয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার জায়গাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে যদি তর্জনী আঙ্গুল উত্তিত করে পশ্চিমবঙ্গের বিজিপির সভাপতি দীলিপ ঘোষ যদি ১ কোটি মুসলিমকে ঝেটিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ২০৪১ সাল থেকে যে সব হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ভারতে এসেছে কেবল তাদেরকেই নাগরিকতা দেওয়া হবে। দীলিপ দা এসব কি বললেন ? এ ধরনের হুমকী ধমকী বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসরণকারীদেশের অহংকারকে পর্যুদস্ত করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরকালে আবুধাবীতে গালফ নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকালে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তবে এটার প্রয়োজন ছিলোনা। আমরা বুঝতে পারছিনা কেন ভারত সরকার এ আইন করলেন। তিনি আরো বলেন ২০১৯ সালে অক্টোবরে আমার নয়াদিল্লী সফরের সময় ও প্রধানমন্ত্রী মোদী আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ২০১৯ সালে ১১ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাস করা হয়। নিপীড়নের মুখে পাকিস্তান বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের আগে যেসব ধর্মীয় সংখ্যালঘু (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান) সেদেশে পালিয়ে গেছেন তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রাপ্তির পথ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সবসময় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ে অধিকার সুরক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক এরপর খ্রিস্টান সম্প্রদায়, বৌদ্ধ সম্প্রদায়, বিহারী প্রত্যেক সম্প্রদায়ে অধিকার সংরক্ষণ করে আসছে। এতদ্ব্যাপারে আমাদের দেশে কোন সরকারের আমলে অধিকার হরণের দৃষ্টান্ত নেই।
এদেশে কাহাকেও কখনও সংখ্যালঘু রূপে বিবেচনা করা হয় না। স্বইচ্ছায় মুসলিম পরিবার ছাড়া কেউ যদি অন্যদেশে অভিবাসী বা নাগরিকত্ব গ্রহণ করে তাতে আমাদের করণীয় কিছুই নেই। তবে জোড়পূর্বক তাড়িয়ে দেওয়ার কোন দৃষ্টান্ত আমাদের নেই। জোর করে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ অন্যদেশে নাগরিকত্ব লাভের সহক রাস্তা তৈরির যুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসামে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম ঘজঈ থেকে বাদ পড়েছে এর অর্থ হচ্ছে ভারত ১৯ লক্ষ মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে প্রস্তুত। বাংলাদেশ থেকে কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক ভারত রাষ্ট্রের নাগরিক হতে ভারমুখী হয়নি। যারা ভারতীয় মুসলিম তারা অবশ্যই ভারতীয় নাগরিক। তাদেরকে বাংলাদেশে ঠৈলে দেওয়া সম্পূর্ণ অমানবিক দিলীপ বোস যুক্তি তর্কের ধারে কাছে না গিয়ে রাখঢাক না করে কোন সমীহ না করে ভারতীয় মুসলিমদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে চাইছেন। এটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু আচরণ আমাদের মতো ছোট একটি দেশের জন্য। আমরা যেকোন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং অন্যকোন দেশের অভ্যন্তরিণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে বিশ্বাসী। ঘজঈ বা নগরপঞ্জি এবং নাগরিকতা আইন ভারতের অভ্যন্তরিণ বিষয় হলেও আমাদের দেশকে অদূর ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এমন কিছু ইতিমধ্যে আঁচ করা যাচ্ছে। আইনটা দ্বারা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ঘন ছায়াতলে আগলে রাখার ব্যবস্থা থাকলে মুসলিম সম্প্রদায়কে বাদ দিয়েছেন। ভারতে চাকুরীও জীবন জীবিকার ব্যাপারে উন্নতম ব্যবস্থা নেই বলে আমাদের দেশের কোন মুসলিম ভারতে স্থায়ী আবাসন গড়তে তেমন আগ্রহী নয়। সুতরাং কোন মুসলিমদেরকে নাগরিকতা প্রাপ্তির বাইরে রাখা হবে তাতে কি হবে তাহলে ১ কোটি মুসলিম কি ভারতীয় ? যাদেরকে আমাদের কাছে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থার ইঙ্গিত করা হয়েছে।
আমাদের বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধু, খ্রিস্টান, প্রত্যেক সম্প্রদায়সহ অবস্থানের মাধ্যমে অত্যন্ত সুখে শান্তিতে বসবাস করে আসছে। প্রত্যেক সম্প্রদায় যার যার অবস্থান থেকে ভালো আছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। জীবনযাত্রার উন্নতি হয়েছে। ক্রয়সক্ষমতা বেড়েছে। তুলনামূলকভাবে ভারতের চাইতে বাংলাদেশ ভালো অবস্থায় অবস্থান করছে। ভারত ১৩০ কোটি লোকের দেশ। এদেশটা আমেরিকার মতো সম্পদশালী দেশ নয় যে বাংলাদেশে ছেড়ে মানুষ ভারতমুখী হবে। বিশেষ করে মুসলিম ধর্মানুসারিরা। এদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মুসলিম ধর্মানুসারিদের মধ্যে সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্ব বোধ বিদ্যমান, প্রত্যেকের ধর্ম কর্ম এদেশে সুচারুভাবে সম্পন্ন করে আসছে। হিন্দুদের দূর্গা উৎসবে কাউন্সিলরদের ওয়ার্ড কার্যালয়ে সকল সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। শান্তি ও নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য পুলিশ প্রশাসন দিন রাত দায়িত্বে থাকে। এরপরও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্ররোচনা গ্রহণযোগ্য নয়। মোদী সাহেব যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নগরপঞ্জি তাদের অভ্যন্তরিণ বিষয় বলেছিল, কিন্তু তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় এবং পশ্চিম বাংলার বিজিপি সভাপতির উক্তি বিপরীত ধর্মী। তা হলে দিলীপ বোস সাহেব নগরপঞ্জির নামে বাংলাদেশকে নাফারবন্দি করার প্রয়াসে উঠেপড়ে লেগেছে? মুসলমানদেরকে নিয়ে ভারতের এতো অস্বস্থিবোধ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আচরণকে অসম্মানের পথে ঠেলে দিয়েছে। সুদীর্ঘ ভূরাজনীতিতে ভারতে গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকারের যে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তা হিংসা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে দুঃখজনক পরিণিতির দিকে ধাবিত হতে শুরু হচ্ছে।
আমরা বন্ধুপ্রতীম একটা শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী ভারত দেখতে চাই। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তার স্বার্থে এবং ভারত মহাসাগরকে যদি নিরাপত্তার বেষ্টনে বেষ্টিত করতে হয় তবে ভারতের আশে পাশের রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে সম্পর্কের পরিধি সম্প্রসারিত করতে হবে। সার্ক অস্থিত্বহীন, কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা বাতিল। ঘজঈ এর মাধ্যমে মুসলিমদেরকে নাগরিকতা না দেওয়া, প্রতিবেশী দেশে ঠেলে দেওয়া এসব কিছুর জন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি হচ্ছে। এতে সবাই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ বিষয়ে ভারতের রাজনীতি বন্ধুদের তালিম দেওয়ার তেমন প্রয়োজন নেই।
ভারতে সর্বপ্রথম কেরালা এরপর পাঞ্জাব, রাজস্থানে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বিরোধী প্রস্তাব পাশের পর পশ্চিম বঙ্গের বিধান সভায়ও একই পদক্ষেপ নিতে চলেছে। ২৭/১/২০২০ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধান সভায় এক বিশেষ অধিবেশনে সিএএ (Citizen Ship Amendment Act) প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাশ করাতে চলেছেন মততা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতাজি রাজ্য বিধান সভায় সব রাজনৈতিক দলের কাছে তাঁর প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে অনুরোধ জানিয়েছেন। গত বছর জাতীয় নাগরিক পঞ্জী NRC (National Registration Certificate) নিয়েও মমতাদির আপত্তি ছিলো। NRC অনুসারে সকল সম্প্রদায়ের নাগরিকত্বের ওপর ধাক্কা এসেছিলো। তাই ভারতজুড়ে আন্দোলনের অগ্নিপ্রজ্বলিত হতে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে সেই অগ্নি নির্বাপিত করতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন সিএএ। তাতেও বিক্ষোভ সংঘর্ষের আগুন জ্বলে ওঠে। সিএএ অনুসারে প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার পথ সুপ্রসস্থ হয়। তবে কোন মুসলিম নাগরিকত্ব পাওয়া থেকে কৌশলে বঞ্চিত হয়। কথা হচ্ছে ঐসব মুসলিম সম্প্রদায়াকি সত্যি সত্যি বিতাড়িত শরনার্থী না আন্দোলন শীতল করার নিমিত্তে রাজনৈতিক জল বর্ষণ। তবে ১৯৪৭ এরপর মুসলিমরাই ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে আজো বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে বসবাস করে আসছে। এদেরকে আজো বাঙালি করতে পারা যায়নি। এরা হিন্দি বা উর্দু ভাষী কিন্তু ২০১৪ পর্যন্ত কোন লোভ লালসার টানে কোন বাংলাদেশি ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেনি। হতে পারে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের পরিবর্তে সিএএ দ্বারা অন্যকোন হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চান মোদী সরকার কিন্তু তারপরও আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্থ করা হয় এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সাগরের অভ্যন্তরে ঝড় সৃজন হলে চতুর্দিক জুড়ে ছড়িয়ে পরে। ভারতের এ হাঙ্গামা আমাদেরর দিকে ২০০ মাইল গতিতে যে প্রবাহিত হবেনা তার কি গ্যারান্টি আছে। মাইয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীর ভার বহন করতে গিয়ে এখন ও সোজা হতে পারচ্ছিনা। প্রতি বছর এ জন্য ৭০০০ কোটি টাকার ফালতু ব্যয় বহন করতে করতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ১৮ কোটি মানুষের দেশ। এদেশের কোন মুসলিম স্বপ্রণোদিত হয়ে ভারতে বসবাস করছেনা। সুতরাং মনে করা কি যায় মুসলিম সম্প্রদায়কে ঠেলে আমাদের দেশে আর একটি সমস্যা সৃজন করতে চায় বন্ধুপ্রতীম ভারত। ভারতে গো রক্ষার জন্য গো নিধন বন্ধ হউক, গো প্রসাবকে পবিত্র মনে করলে করুক। মুসলিমদেরকে নাগরিকত্ব দিক বা না দিক কাশ্মীরের মর্যাদা হানি করুক, তা নিয়ে আমাদের মাথা উষ্ণ করার কিছুই নেই। আমাদের গাত্রধাহের মূল হেতু হচ্ছে যখন পশ্চিমবঙ্গের বিজিপি সভাপতি বলেন, মুসলিমদেরকে ঘাড় ধরে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানে চালান করে দেয়া হবে। এ উক্তি অমানবিক এবং সৌজন্যহীনতার বহিঃপ্রকাশ। আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব আশাকরি প্রভুত্ব নয়। We respect friendship not muster ship. আমরা সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধে ভারতকে চিরদিনের তরে পেতে চাই। গত ২৫ জানুয়ারি ২০২০ চট্টগ্রাম হোটেল রেডিসন ব্লু বে ভিউতে ভারতের ৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভারতের সহকারী হাই কমিশনার অনিন্দ্য ব্যানাজী সাহেব বলেন, বাংলাদেশ ভারতের কাছে প্রতিবেশী, প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশ সবার আগে। আমাদের সম্পর্ক বহুমুখী। আমাদের বন্ধন এখন কৌশলগত সব সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। অনিন্দ্য ব্যানার্জীর বক্তব্য আমাদের চিত্তে আশার আলো প্রজ্জ্বলিত করেছে।
লেখক : কলামিস্ট