প্রসঙ্গ বাবা দিবস পালনের সার্থকতা

391

এমরান চৌধুরী

গতকাল ছিল বিশ্ব বাবা দিবস। সন্তানের জন্য অদ্বিতীয় মহান পুরুষ বাবার সম্মানে প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার এ দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য একটি তারিখ নির্দিষ্ট থাকলেও পৃথিবীর সব দেশে এ দিনটি একই দিনে পালিত হয় না। তবে প্রথম বাবা দিবস পালনের পর থেকে এ বছরই প্রথম দিবসটি অনাড়ম্বরে পালিত হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে সারা পৃথিবীর মানুষ কেউ শারীরিক, কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। একটু প্রাণ খুলে হাসবে এমন আবহ পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। ফলে বাবাকে নিয়ে গেল বছরের মতো আনন্দ, আড্ডা, বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া এবার হয়ে ওঠেনি। তবে থমথমে অন্ধকারের মধ্যেও এক চিলতে আলো এবারের বাবা দিবসকে দিয়েছে নবতর ব্যাঞ্জনা। স্মরণাতীত কালের মধ্যে এ বছরই প্রথমবারের মতো সন্তানেরা তাদের বাবা-মাকে দীর্ঘ সময় ধরে কাছে পেয়েছে, যা আর কোনো সময় ঘটেনি। করোনাকালের চরম অস্থিরতার মধ্যে একজন সন্তানের জন্যে এটা সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এ বছর বাবাকে নিয়ে হৈ চৈ, হুল্লোড়, নানা উপহার, বাবার পছন্দের খাবারের আয়োজন কিংবা বাইরে বেড়ানো সম্ভব না হলেও সন্তানেরা তাদের বাবাকে নিজেদের মতো করে অন্তরের সমস্ত নির্যাস দিয়ে উইশ করেছে ‘ আই লাভ ইউ বাবা’ বলে। পৃথিবীর তাবৎ বাবারা, মায়েরা এই অল্পতেই তুষ্ট। পৃথিবীর এমন এক অদ্ভুত মানুষ বাবা-মা। শত অপরাধের পরও যদি কোনো সন্তান মুখ কালো করে বাবা-মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় পলকেই তাঁদের অন্তরে জেগে ওঠে স্নেহধারা। যে ধারা শুধু কাছেই টানে, কখনো দূরে ঠেলে দিতে পারে না। তাই বাবা-মা সন্তানের জন্য সৃষ্টিজগতের বড় নেয়ামত।
পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা এই বিশ্ব জগত সৃষ্টির পর প্রথম যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন তিনি ছিলেন একজন পুরুষ। আর এই মহান পুরুষটির নাম হযরত আদম (আ.)। যাঁকে আমরা বাবা আদম বলে জানি। এই আদম (আ.) হলেন মানবজাতির আদি পিতা। এভাবে মুসলমান জাতির পিতা হিসেবে হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর নাম এবং আদর্শ পিতা হিসেবে হযরত লোকমান (আ.) এর নাম গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের সহিত উচ্চারিত হয়। সন্তানদের উদ্দেশ্যে হযরত লোকমান (আ.) এর উপদেশ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এতই পছন্দ করেন যে আল্লাহ পাক তাঁর নামে একটি আলাদা সূরা অবর্তীণ করেন। এ থেকে আমরা সহজেই বৃঝতে পারি পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাসের সাথে বাবা বা পিতা শব্দটির কী অপরিসীম অবদান। সৃষ্টির আদি থেকে শুরু করে সন্তানের প্রতি বাবার যে ভালোবাসা তাতে এতটুকু চিট ধরেনি। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বস্তু বাবার বাড়ানো হাত। যে হাত অনেক গুণের আধার। আশ্রয়, প্রশয়, স্নেহ, ভালোবাসা, নির্দেশনা, বাতিঘর এর অনন্য প্রতীক। সর্বোপরি বাবার হাত নিরলস শ্রমের হাতিয়ার। যে হাতিয়ারের সুবাদে আমরা বেড়ে উঠি আলো বাতাসে। বাবা তাঁর নিরন্তর শ্রম, অন্তরের নির্যাস দিয়ে সন্তানের শুধু মঙ্গলই কামনা করেন না, সন্তানের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও এতটুকু দ্বিধা করেন না। বাবা বটের ছায়ার মতো সারা জীবন সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। সন্তানের যে কোনো বিপদে আপদে বাবা ছায়া সঙ্গি হয়ে থাকেন। শৈশবে বাবার হাত ধরে আমাদের যে পথ চলা শুরু হয়, সে পথের দিশারী এক সময় আমাদের জীবনের আদর্শ হয়ে ওঠে। সে আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশ পালন করে বাবা দিবস। বাবাকে ভালোবাসার জন্য, শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সন্তানের জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন হয় না। তবু একটি নির্দিষ্ট দিন বাবার সাথে সন্তানের একান্তে কাটুক, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হোক বাবারা, এই উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে প্রতি বছর পালন করা হয় বিশ্ব বাবা দিবস। জন্মদাতা বাবাই হলো বাবা দিবসের মুখ্য বিষয়।
১৯০৯ সালের আগে পৃথিবীর কোথাও বাবা দিবস নামে কোনো দিবসের অস্তিত্ব ছিল না। যদিও মা দিবস পালন করা হচ্ছিল অনেক বছর ধরে। ওয়াশিংটনের সেনোরা লুইচ স্মার্ট নামে এক মহিলা ১৯০৯ সালে এক গির্জার বক্তব্যে জানতে পারেন পৃথিবীতে মায়ের নামে একটা দিবস আছে। সেই সময় তাঁর মনে হলো বাবার নামেও একটি দিবস থাকা উচিত। বিষয়টি নিয়ে তিনি স্থানীয় ধর্মযাজকদের সঙ্গে কথা বলেন। স্থানীয় কয়েকজন ধর্মযাজক তাঁর এই ধারনাটি গ্রহণ করেন। তাঁর বাবার জন্মদিন ছিল ৫ জুন। তিনি নিজের বাবার জন্মদিনের দিন বাবা দিবস পালনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। উল্লেখ্য সেনোরা লুইচের জীবনে বাবা কিংবা মা বলতে ছিলেন একজনই, তিনি তাঁর বাবা। ষষ্ঠ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তাঁর মা মারা যান। তখন বাবাই একাধারে মা ও বাবার ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বাবা তাঁদের ছয় ভাইবোনকে মায়ের স্নেহে, বাবার আদরে বড় করে তোলেন। ১৯১০ সালের ১৯ জুন অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রথম বাবা দিবস পালন করা হয়। এরপর অতিবাহিত হয় অর্ধ শতাব্দীরও অধিক সময়। ১৯৬৬ সালে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন ঘোষণা করে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস পালন করা হবে। ছয় বছর পর (১৯৭২ সালে) প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এটিকে আইনে পরিণত করেন।
ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতে বাবা শব্দটি এসেছে বপপ থেকে। তাঁর মতে বাবা শব্দটি সংস্কৃত পিতা থেকে আসেনি। প্রাকৃত ভাষা বপপ থেকে এসেছে বাপ। আবার বাপ থেকে বাপু। আর বাবার রূপটি এসেছে ঠিক এভাবে বপপ > বাপু > বাবু > বাবা। বাবাকে যে নামে ডাকা হোক না কেন বাবার ভালোবাসা কোনো অংশে কমে যায় না। আমাদের দেশে বাবাকে বাবা, আব্বু, আব্বাজি, বাপি, আব্বা এসব নামে ডাকা হয়। ভাষার বৈচিত্র্যের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাবাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। ভাষা না বুঝলেও বোঝা যায় এটি বাবার প্রতিশব্দ। হিন্দি ভাষায় বাবাকে পিতাজি, ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় আইয়্যাহ, হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় পাপা, জার্মানি ভাষায় ফ্যাটা, জাপানি ভাষায় ওতোসা, হিব্রæ ভাষায় আব্বাহ আর ইংরেজি ভাষায় ফাদার, ড্যাড, ড্যাডি নামে ডাকা হয়।
পৃথিবীর নানা দেশে নানা ভাবে বাবা দিবস পালন করা হয়। ব্যক্তি বিশেষেও বাবা দিবস পালনে পার্থক্য দেখা যায়। তবে বাবা দিবসের মূল বিষয় হচ্ছে উপহার। এদিন ছেলেমেয়েরা বাবার সবচেয়ে পছন্দের জিনিস বাবাকে উপহার দেয়। এ পছন্দের জিনিস হতে পারে নানা ধরনের জামা, হতে পারে বিশেষ কোনো খাবার যা বাবার খুব পছন্দ। এমনও হতে পারে বাবাকে নিয়ে কোনো দর্শনীয় স্থানে বেড়ানো। কোনো কোনো দেশে ছেলেমেয়েরা বাবাকে কার্ড বা ফুলের তোড়া উপহার দেয়। আবার কেউ কেউ সাড়ম্বরে কেক কেটে বার্থ ডে এর মতো বাবা দিবস পালন করে। তবে সব কিছু নির্ভর করে স্থান কাল পাত্রের ওপর। যে পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে বাবা দিবসের হাতছানি পৌঁছাবার কথা নয়। আবার যে পরিবারে বাবা বয়োবৃদ্ধ সেখানকার বাবা দিবস আর স্বচ্ছল মাঝ বয়সী বাবার বাবা দিবস এক হবার কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে বাবা দিবস যে আড়ম্বরে পালিত হয় উপরতলায় রৌশনাই থাকলেও তা পালনের খুব একটা অবকাশ নেই। তাই বাবা দিবস শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছেই সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে।
যে দেশে যেভাবে বাবা দিবস পালন করুক না কেন বাবা দিবসের মুখ্য বিষয় হচ্ছে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা, ভক্তি ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। জন্মদাতা হিসেবে, পরিবারের প্রধান কর্তা হিসেবে এবং শাসক ও প্রশাসক হিসেবে বাবা যে নিরলস শ্রম দিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন সন্তানের কাছে সে বার্তা পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু আমাদের সমাজ জীবনে বাবা-মার প্রতি যে আচরণ আমরা লক্ষ্য করি তা অত্যন্ত অমানবিক। যে বয়সে বাবা-মা সন্তানের সান্নিধ্য কামনা করে সে সময় অনেক সন্তান তাঁদের রেখে আসেন বৃদ্ধাশ্রমে। অথচ পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বাবা-মায়ের প্রতি সর্বোচ্চ সেবাযতেœর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে সূরা বনি ইসরাইল এর ২৩ সংখ্যক আয়াতে বলা হয়েছে ‘ তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদের সামনে উহ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিও না এবং তাদের সঙ্গে শিষ্ঠচারপূর্ণ কথা বলো।
মা-বাবার সেবাযতœ সম্পর্কে হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি মহানবী (স.) এর কাছে এসে জেহাদের জন্য অনুমতি চাইল। মহানবী (স.) তার পিতামাতা জীবিত আছেন কিনা জানতে চাইলেন। লোকটি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে মহানবী (স.) বললেন, তাহলে তাদের সেবাযতœ করো, তাদের সেবাই তোমার জন্য জেহাদ। সুতরাং আমাদের সবার উচিত বাবার প্রতি আমাদের যথাযথ ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। আর তাতেই আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক