প্রসঙ্গ : বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশে আশ্রিত বাস্তুহারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী

51

যদিও রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য নতুন কোন ঘটনা নয় তবুও বলবো ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে এদেশে তাদের আগমনটা ছিলো অন্যান্য যেকোন বারের চেয়ে ব্যাপক ও বিস্তৃত। আমরা যদি পেছন ফিরে সে সময়ের দিকে তাকাই তখন দেখি দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের বর্ডারে এসে, নো-ম্যান্স ল্যান্ডে এসে জড়ো হয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে চেষ্টা করছে কিন্তু বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) তাদেরকে ঢুকতে দিচ্ছে না। তখন অনেক রোহিঙ্গা নাফ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে এদেশে প্রবেশ করতে চেষ্টা করেছে। অনেকে সাগর পথে লঞ্চে, বোটে দিনের পর দিন ভেসে বেড়িয়েছে। খেয়ে, না খেয়ে তাদের বুকের ছাতি ফেটে গেছে, অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় তাদের অনেকে মারা গেছে।
তাদের শিশু মারা যাচ্ছে, নারী মারা যাচ্ছে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মারা যাচ্ছে এমন সচিত্র প্রতিবেদন তখন প্রতিদিনই সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছিলো।
তখন বাংলাদেশের শত শত মানুষ খানাপিনা নিয়ে, কাপড় চোপড় নিয়ে বর্ডারে গিয়ে তাদেরকে সাহায্য করেছে। অনেক রোহিঙ্গা তখন বিভিন্ন পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এক এক জায়গায় জড়ো হয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আগে থেকে এদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা তাদেরকে পথ দেখিয়েছে।
সে সময়ে রোহিঙ্গাদের কেটে টুকরো টুকরো করছে এমন কিছু সেন্সেটিভ ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল করা হয়। মূলত আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এসব ভাইরালকারীদের টার্গেট ছিলো।
রোহিঙ্গাদের এদেশে অবাধে প্রবেশ করতে না দেয়ার কারণে একসময় বাংলাদেশের সরকার এদেশের ভেতর থেকেই বিশাল এক জনগোষ্ঠীর সমালোচনার সম্মুখীন হতে থাকে। বিশেষ করে কওমি লাইনের আলেমরা ছিলো আগত রোহিঙ্গাদের সেবায় অগ্রগণ্য। তাছাড়া, চরমোনাই, শরশিনাহ, তাবলিগ, মাইজভান্ডারসহ অনেকে তখন রোহিঙ্গাদেরকে এদেশে আশ্রয় দেবার জন্য বাংলাদেশ সরকারের নিরব ভূমিকার বিপক্ষে প্রতিবাদ মুখর ছিলো(তখনকার প্রেক্ষাপটে এটা নিশ্চয় দোষের ছিলো না)। রোহিঙ্গা আলেমরা বেশীর ভাগই এদেশের কওমী মাদ্রাসা থেকে পড়ালেখা করা আলেম। তবলীগ তাদের অস্থিমজ্জায় প্রথিত। এদেশে এই শ্রেণির আলেমসহ জনগণ ছিলো আওয়ামীলীগের ভোট ব্যাংক। অনেকটা তাদের রোষানলে পড়ার মত রিস্ক নেয়ার চেয়ে রোহিঙ্গাদেরকে এদেশে আশ্রয় দেয়াই নিরাপদ মনে করেছিল আওয়ামীলীগ সরকার। শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য বর্ডার খুলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদার অব হিউম্যানিটি হয়েছিলেন। তাছাড়া আন্তর্জাতিকভাবেও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার জন্য চাপ ছিলো। সেসময় যারা রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নিঃসন্দেহে তারা মানবতার সেবায় অগ্রগণ্য।
আজকে যারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থান নিয়ে সরকারের উলঙ্গ সমালোচনা করছেন তারাও সেদিন মানবতার দরজা খুলে দেবার জন্য মুখ খুলেছিলেন। তবে শুরু থেকে যদি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মায়ানমারের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কড়া প্রতিবাদ করা হতো তাহলে ওরা এতোটা নির্দয় হতে পারতো না। সেটা বাংলাদেশ সরকার করে নাই যদিও রোহিঙ্গাদেরকে বাস্তুহারা নাগরিক হিসেবে এদেশে আশ্রয় প্রদান করেছিলো।
জান বাঁচা ফরজ। বুদ্ধ সন্ত্রাসীদের অত্যাচারের মুখে টিকতে না পেরে তারা হাজার বছর থেকে বসবাস করা নিজেদের দেশ-মাটি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো। আমরা সবাই তখন তাদের আশ্রয় দেবার জন্য কলম ধরেছিলাম। শুরুর দিকে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো।
২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে তারা এদেশে নতুন করে প্রবেশ করেছিলো। এর ৯ দিন পর ৪ সেপ্টেম্বর আমি নাইক্ষ্যাংছড়ির ফুলতলী ক্যাম্পে সেবার নিয়্যতে প্রথম প্রবেশ করি। এর পরেরটা ইতিহাস।
আজকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে অনেকে নেতিবাচক কথা বলে থাকেন। এটা ঠিক যে রোহিঙ্গাদেরকে সেদেশের সরকার দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষাদিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখার ফলে তারা একটি অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, সভ্যজগত থেকে পিছিয়ে পড়া জাতিতে পরিণত হয়েছে। এটা তাদের দোষ নয়, তারা পরিস্থিতির স্বীকার। তাদের পাশে বিশ্ব বিবেক যুগ যুগ ধরে অন্ধের ভূমিকা পালন করেছে। হয়তো তারা মুসলমান এটাই তার কারণ!
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ টানতে গিয়ে সরকারের সমালোচনা করলেও আমরা যেন রাষ্ট্রীয় স্বার্থ-বিরোধী কোন তৎপরতায় নিজেরা জড়িয়ে না পড়ি এটা বিশেষ সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে।
রোহিঙ্গারা এদেশে আসার বিষয়ে বলি, প্রথমতঃ তাদেরকে এদেশে কেউ ডেকে নিয়ে আসেনি। না সরকার, না জনগন। তারা নিজেরাই আশ্রয় প্রার্থনা করে জান বাঁচাতে এদেশে প্রবেশ করেছে। দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশ সরকার প্রথমে তাদেরকে প্রবেশে বাঁধা দিয়েছে। এতে দেখা গেছে তারা চোরাই পথে দলে দলে প্রবেশ করছে। আবার এদেশ থেকেও তাদেরকে প্রবেশ করতে দেবার জন্য বিভিন্ন ভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিলো। তৃতীয়তঃ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী একদেশের নাগরিক নিজ দেশে অত্যাচারিত হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেবার জন্য প্রবেশ করলে তাদেরকে জোর করে বের করে দেবার নিয়ম নেই। তবে প্রবেশে বাধা দিয়ে যদি ঠেকিয়ে রাখা যায় তাহলে সেটা ভিন্ন কথা।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এদেশের সরকার বাস্তুহারা হিসেবে গ্রহণ করার পর সরকারের নেয়া বেশ কিছু পদক্ষেপ অত্যন্ত দক্ষতার স্বাক্ষর রাখে। সেগুলো হলো, # প্রতিদিন যখন হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করছিলো তখন অল্প দিনের মধ্যে সেখানে বিজিবির পরিবর্তে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা। এটা না করলে তাদেরকে দমিয়ে শৃঙ্খলার ভিতর রাখা একপ্রকার অসম্ভব ছিলো। # এনজিওদের মাধ্যমে তাদেরকে রেজিষ্ট্রেশন করে তালিকাভুক্ত করা। বর্তমানে তাদেরকে যে মাষ্টার কার্ড দেয়া হয়েছে তাতে তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী পরিচয়েই এখানে থাকতে হবে। একি কার্ডে পরিবারের সবার ছবি থাকায় তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারবে না। বিনাকারণে বিচ্ছিন্ন থাকলে তারা রেশন পাবে না। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর তত্ববধানে করা কার্ডে তাদের অরিজিন দেশ হিসেবে মায়ানমার লিখা আছে। # সেনাবাহিনী ক্যাম্পে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলে সেখানে সেনাবাহিনী কমিয়ে নির্বাহী মেজিস্ট্রেট এর হাতে ক্ষমতা দিয়ে প্রশাসনিকভাবে ক্যাম্প পরিচালনা করা। # ক্যাম্পে বাহির থেকে যে কারো প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করাটাও আমার মতে সরকারের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো। আন-রেজিস্টার্ড যে কোন সংস্থা বা ব্যক্তি ক্যাম্পে ফ্রি স্টাইলে প্রবেশ করলে রোহিঙ্গাদের সাথে এদের একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতো যা পরবর্তীতে এদেশের জন্য হুমকি হতো। এতে এনজিওদের সাথে সরকারের ভুলবুঝাবুঝি হবার সম্ভাবনাও ছিল। এনজিওরা ওদেরকে খাওয়া পড়ার আঞ্জাম দিচ্ছে বলে এনজিওদের ন্যায্য চাওয়া পাওয়াগুলোকেও আমলে নিতে হবে। # রোহিঙ্গা কমিউনিটির সন্তানদের স্কুলে বাংলা শিখতে না দেয়াটা সরকারের একটি গুড পলিসি। তাছাড়া শত শত কমিউনিটি স্কুলের মাধ্যমে অন্যান্য ভাষার উপর পড়ালেখা তাদের মাঝে তাদের দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলার ব্যাপারে ভূমিকা রাখবে। ওরা এদেশে আসার প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন এনজিও এবং দেশি বিদেশি সংস্থাসমূহ যদি রোহিঙ্গাদের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত না করতো তাহলে কী হতো? খাবার না পেয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মাটি খেতো! মানুষের মাংস খেতো! অতঃপর সারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে অরাজকতার সৃষ্টি করতো। এখন ওরা কোনো রকমে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা পাচ্ছে বলে পাহাড়ে পলিথিন মোড়ানো ক্যাম্পে দিনাতিপাত করছে।
তারা এদেশে কতদিন থাকবে, কখন চলে যাবে এসব চিন্তা করার জন্য সরকারের নীতি নির্ধারক মহল আছেন, আন্তর্জাতিক মহল আছেন। বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ সতর্ক পর্যবেক্ষণে রেখেছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্প।
এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে এত অল্প জায়গায় রাখতে গিয়ে কিছু কিছু অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা হতেই পারে। গুজবে কান না দিয়ে সত্য মিথ্যা যাচাই না করে যেকোন বিষয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে না করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কেউ কেউ পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার করে, মিথ্যা খবর রটিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করতে পারে। তাতে সায় দিয়ে তাল মিলালে আমাদেরই ক্ষতি হবে। এমন আচরণ করা যাবে না যাতে এনজিওগুলো তাদের সহযোগিতার হাত গুটিয়ে নেয়।
আমরা আন্তরিকভাবে চাই রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের দেশে নিজেদের পরিচয়ে ফিরে যাক। তারা সেদেশের স্থায়ী নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পাক, ন্যায্য অধিকার পাক। মানুষের মত বাঁচার স্বাধীনতা পাক। নিজেদের শিক্ষা-সংস্কৃতি অবাধ চর্চার সুযোগ পাক। দ্বীনধর্ম পালন করার স্বাধীনতা পাক। আমরা পরিপূর্ণরূপে বিশ্বাস করি তারা তা পাবে এবং স্বসম্মানে ফিরে যাবে তাদের বাপ দাদার ভিটায়।
রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছে, প্রসংশিত হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মানবতার বড় উদারহণ! বাংলাদেশের এই ত্যাগের বিনিময়ে সারাবিশ্বে যেসব বাংলাদেশী প্রবাসী বিভিন্ন সমস্যায় নিপতিত আছেন জাতিসংঘের মাধ্যমে তাদেরকে সমস্যামুক্ত করে সবাইকে কাজের ব্যবস্থা করা হোক। বাংলাদেশীদের জন্য ভিসার দুয়ার খোলে দেয়া হোক। অনেক সমস্যা সংকূল ছোট্ট একটি দেশ হওয়া সত্বেও যদি বাংলাদেশ ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে পারি তাহলে বাংলাদেশের জনশক্তি বহির্বিশ্বে অবাধ শ্রমবাজার পাবে না কেন? আর রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান। আমরা আশা করবো আন্তর্জাতিক মহল রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন এর যথাযথ ব্যবস্থা নিবেন। আমাদের সরকার রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা গতানুগতিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পরিকল্পিতভাবে অব্যাহত রাখবেন এটাই আমার বিশ্বাস।
লেখক : সমাজকর্মী