প্রসঙ্গ : চীন-ভারত যুদ্ধ দামামা যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই

94

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ

বিরোধপূর্ণ লাদাখ সীমান্তের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে মে মাসের শুরু থেকেই গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চীনা সেনাদের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছিল উত্তেজনা। তাঁর চুড়ান্ত রূপ নেয় গত ১৫ জুন উভয় দেশের সেনাদের মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। লাদাখের গালওয়ান নদী ঘেঁষা উপত্যকায় ১৫ জুন রাতে চীনা সেনাবাহিনীর সাথে প্রাণঘাতী এই সংঘর্ষে একজন কর্ণেলসহ ভারতের ২৩ জন সৈন্য নিহত হয়েছেন। যদিও চীনের হতাহতের সংখ্যা এখনো প্রকাশ করেনি দেশটি। এই সংঘাতের মধ্য দিয়ে বেজে উঠে চীন-ভারত যুদ্ধ দামামা।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লাদাখ সীমান্তের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে ভারতের সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে চীনের যুদ্ধাংদেহী মনোভাবের পেছনে মূল কারণ, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন আইন ২০১৯ এর মাধ্যমে প্রাক্তন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ এবং “লাদাখ” নামে নতুন দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে পুনর্গঠন করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ থেকে। প্রকাশিত মানচিত্রে বিরোধপূর্ণ কাশ্মিরের পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মিরের পাশাপাশি আকসাই চীন ও লাদাখের চীন নিয়ন্ত্রিত এলাকাও ভারতের বলে দাবী করা হয়। চীনের গোস্বা মূলতঃ ওখান থেকেই।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট অমিতশাহ এই বিলটি উত্থাপনকালে খোদ ভারতের লোকসভায়ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বিলটির বিরোধিতা করে এবং ভারত শাসিত কাশ্মীরের দুই বিধায়ক সংবিধান ও গায়ের জামা চিড়ে নজিরবিহীন প্রতিবাদ জানিয়ে লোকসভা থেকে ওয়াকআউট করেন। বিজেপি’র বিদায়করা তুমুল করতালির মাধ্যমে বিলটির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। লোকসভার বাইরেও বিজেপি’র সমর্থকরা নেচে-গেয়ে এবং মিস্টি বিতরণ করে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করে উত্থাপিত বিলটির সমর্থনে। সম্ভাব্য বিক্ষোভ দমনে ভারতীয় সরকার পূর্ব থেকেই সবরকমের প্রস্তুতি রাখলেও কাশ্মিরের জনগণ প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রতিবেশি শক্তিশালী দু’টি রাষ্ট্র (পাকিস্তান ও চীন) এর সাথে বিরোধপূর্ণ অঞ্চল নিয়ে আনীত বিলটি উত্থাপনকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ অত্যন্ত দাম্ভিকতার সূরে আকসাই চীনকেও নিজেদের বলে দাবী করেন। নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন কট্টর সা¤প্রদায়িক ও উগ্র জাতীয়তাবাদী উম্মাদনা সৃষ্টিকারী বিজেপি’র এই পদক্ষেপ সম্পর্কে বিরোধী দল কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা পি. চিদাম্বরম এর মন্তব্য আজকের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। শ্রী পি. চিদাম্বরম এই বিলটিকে একটি ‘বিপজ্জনক পদক্ষেপ’ এবং এর ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে বলে সংসদে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন সেইদিন।
ভারতীয় লোকসভায় এই বিল উত্থাপনের পর প্রতিবেশি পাকিস্তান ও চীন তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। পাকিস্তান তো রীতিমতো যুদ্ধ উম্মাদনায় মাতোয়ারা হয়ে উঠে। বিরাজ করে পাক-ভারত সীমান্তে থমথমে অবস্থা। কাশ্মির নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশন আহবানসহ ভারতের এই একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন কামনা করেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। চীন পাকিস্তানের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ব্যক্ত করে।
পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা প্রশমন হতে না হতেই লাদাখের গালওয়ান ভ্যালির কাছে চীন-ভারতের মধ্যকার ডি-ফ্যাক্টো সীমান্ত, যাকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বলা হয় তার পাশ দিয়ে ভারত সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করলে চীন তাতে বাধা প্রদান করে। বিরোধপূর্ণ এলাকায় ভারতের এমন একতরফা সিদ্ধান্তে চীন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। চীন এই এলাকায় কেবল সামরিক উপস্থিতি ঘটিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি; ইতিমধ্যে ভারতের লাদাখের প্রায় ৬০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে চীনা সেনারা। রাহুল গান্ধী বিষয়টি নিয়ে বিজেপি সরকারের রহস্যজনক নিরবতায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ব্যাখ্যা দাবী করলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজানাথ সিং সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে রাহুলের প্রশ্ন তোলা উচিত হয়নি বলে এড়িয়ে যান। এককথায়, পুরো বিষয়টি বিজেপি সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পারছে সইতে, না পারছে কইতে।
চীন ও ভারতের সীমান্ত রেখা নিয়ে অস্পষ্টতা এবং বিরোধ ঐতিহাসিক। দুই দেশের মধ্যে ৩,৪৪০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। আকসাই চীন অঞ্চলের ১৫০০০ বর্গমাইল এলাকাকে ভারত তাদের এলাকা বলে দাবি করে। অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য অরুণাচলকে চীন তাদের এলাকা বলে মনে করে। ২০১৭ সালে ভুটানের সীমান্তে দোকলাম নামক একটি এলাকায় চীনের রাস্তা তৈরি নিয়ে চীন ও ভারতের সৈন্যরা ৭২ দিন ধরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। ‘জম্মু ও কাশ্মির’ এবং ‘লাদাখ’ নিয়ে ভারতের নতুন মানচিত্র প্রকাশ ছাড়াও লাদাখ সীমান্ত এলাকায় ভারতের সড়ক নির্মাণকে চীন একটি হুমকি হিসাবে দেখতে শুরু করেছে। বিশেষ করে পশ্চিম জিনজিয়াং প্রদেশের কাসগড় শহর থেকে তিব্বতের রাজধানী লাসা পর্যন্ত সামরিক কৌশলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে মহাসড়ক চীন তৈরি করেছে তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এমনিতেই এই দু’টো প্রত্যন্ত প্রদেশ এবং সেখানকার বাসিন্দাদের আনুগত্য নিয়ে চীন সবসময়েই উদ্বেগে। উপরন্তু এই মহাসড়কটি আকসাই চীন নামে যে এলাকার মধ্য দিয়ে গেছে সেটিকে ভারত তাদের এলাকা বলে বিবেচনা করে। সুতরাং, সেই অঞ্চলের কাছে ভারতের অবকাঠামো নির্মাণের তৎপরতা চীন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এই বিরোধ থেকেই ১৯৬২ সালে ভারত-চীন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং লাদাখের বিশাল এলাকা চীন নিজেদের দখলে নেয়। চীন লাদাখের পুরোটায় নিজেদের বলে দাবি করে। চীনের দাবী, লাদাখ তিব্বতেরই অংশ বিশেষ। উল্লেখ্য, অনুর্বর লাদাখের জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই বৌদ্ধ এবং তিব্বতী বংশোদ্ভূত। বিশাল লাদাখের বিরাট অংশ এখনো জনবিরল। সুতরাং এমন পরিস্থিতে চীন-ভারত এই সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে কারো একতরফা সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ গ্রহণ হবে অত্যন্ত হটকারী মূলক ও ধ্বংসাত্মক। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই সকল বিরোধের সমাধানই হবে উভয় রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর।
চীন-ভারত যুদ্ধ দামায় উদ্বিগ্ন উপমহাদেশসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জনগণ। জনসংখ্যায় এবং সামরিক শক্তিতে পৃথিবীর তৃতীয় ও চতুর্থ বৃহৎ দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র যথাক্রমে চীন ও ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে কি ভয়াবহ পরণতি ডেকে আনতে পারে-তা ভাবাই মুশকিল। অধিকন্তু চীন-ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ভারতের চির বৈরি এবং চীনের পরীক্ষিত বন্ধু পাকিস্তান পুরো সুযোগটিই কাজে লাগাবে- এমনটি মনে করে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। পাকিস্তান পুরো কাশ্মির দখলে নিতে উদগ্রীব হয়ে বসে আছে সুদীর্ঘকাল ধরে। ফলে পাকিস্তানও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। পারমাণবিক শক্তিধর তিনটি রাষ্ট্র মরণঘাতি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা কোনভাবেই উদ্বিগ্ন না হয়ে পারিনা। যুদ্ধ কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনা- এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য কথন। বিশ্বের শান্তিকামী সাধারণ মানুষ যুদ্ধ চায়না কখনো, কিন্তু তারপরও ক্ষমতাসীন মহলের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই মরণ খেলায় মেতে উঠে। ডেকে আনে দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি।
পরিশেষে বলবো, আলোচনার টেবিলেই সমাধান হোক চীন-ভারতের সকল বিরোধের; যুদ্ধের ময়দানে নয়। যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই।

লেখক :কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক