প্রবৃদ্ধির ওই ফানুস রঙিন-চকচকে এক সোনার হরিণ

63

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

দেশে প্রবৃদ্ধি নিয়ে চায়ের টেবিল নয়, ভার্চ্যুয়ালি আলোচনা চলছে। পেপার-পত্রিকায়, টকশো, আলোচনায় কদিন ধরে, বিশেষ করে দেশের জাতীয় বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর থেকে প্রবৃদ্ধি কথাটি একটু বেশী শোনা যাচ্ছে । সেদিন এক জাতীয় পত্রিকায় দেখলাম ভারতের এবারের প্রবৃদ্ধি -৪%, চীনের -০.৪%, আফগানিস্তানের -৪.৫%, পাকিস্তানের -০.৪%। দেখিলাম আমাদের প্রবৃদ্ধি ৮.২%, মাশাল্লাহ্। প্রবৃদ্ধি কি, তা বুঝি বা না বুঝি, শুনেই যা মালুম হয় তা উন্নতি। অতএব চিত্র দর্শনে বুঝা যাচ্ছে উল্লেখিত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের অবস্থা অনেক উন্নত। আর আমরা তো সকলে জানি প্রবৃদ্ধি মানে বাড়া বা বেশি হওয়া। তবে আলোচ্য প্রবৃদ্ধিটা যেহেতু জাতীয় বাজেট সংশ্লিষ্ট, তাই তৎমধ্যে কিছু ব্যাপকতা রয়েছে। আর ব্যাপকভাবেও সব মিলিয়ে তা ওই বৃদ্ধি পাওয়াই। এবং ব্যাপক বলতে বুঝাতে চাইছি জিডিপি তথা মোট জাতীয় উৎপাদনকে। এখানে প্রবৃদ্ধিটা হচ্ছে বাজেটের সাথে সম্পর্কিত, তাই প্রবৃদ্ধি বলতে এখানে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকেই বুঝানো হচ্ছে। জিডিপি হল দেশের সব উৎপাদন, উৎপাদন হচ্ছে পণ্য ও সেবা। দেশের মাটি, পানি, আকাশ, বাতাস, বৃক্ষলতা, বাড়িঘর, কল-কারখানা, ইত্যাদিতে যা উৎপন্ন হয় সব পণ্য। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মাস্টার, গায়ক, নায়ক, বায়ক, কামার, কুমার, চামার, ওসি, ডিসি, মুচি, লেখক, বাহক, পাচক, ইত্যাদি সবার যাবতীয় কাজ সেবা। আর সোজা কথায় বছরব্যাপী দেশে যত পণ্যসম্ভার উৎপাদন ও যত সেবাকর্ম সম্পাদন হয় সব মিলে জিডিপি তথা মোট জাতীয় উৎপাদন।
জিডিপি হল বাজেটের সাথে সম্পৃক্ত আর বাজেট গোটাই হল অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়। ফলে জিডিপি হল অর্থনৈতিক কর্মকাÐ এবং একারণে জিডিপিকে অর্থের অংকে বিচার করতে হয়। আর সে একই কারণে প্রবৃদ্ধিকেও অর্থের মানদÐে বিচার করতে হয়। তাই প্রবৃদ্ধি ও জিডিপিকে টাকায় গণনা করা লাগে। তাহলে চলুন এবার আমরা প্রবৃদ্ধি ও জিডিপি একটু টাকায় হিসাব করি। উদাহরণ স্বরূপ মনে করুন, গত বছর আমাদের জিডিপির মোট মূল্য ছিল ১০০ টাকা এবং এ বছর এসে তা দাঁড়িয়েছে ১০৫ টাকা। তাহলে এ বছর আমাদের প্রবৃদ্ধি হল ৫ টাকা বা ৫%। অর্থাৎ এবছর আমরা শতে ৫ টাকা উন্নতি করেছি। আর পত্রিকায় যেহেতু বলা হচ্ছে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৮.২%, সুতরাং আমাদের অবস্থা অনেক ভাল চীন, ভারত, পাকিস্তানের তুলনায়, কেননা তাদের প্রবৃদ্ধি মাইনাস। আর ইকোনোমিক্যাল পয়েন্ট অব ভিউতে পরিসংখ্যান বলছে, উল্লেখিত দেশ সমূহের অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের তুলনায় অনেক খারাপ। কারণ তাদের উৎপাদন প্রচুর হ্রাস পেয়েছে, অপরপক্ষে আমাদের উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আসলে কি অবস্থাটা তেমন, নাকি সেখানে অন্য কোন তেলেসমাতি খেলা করছে? চলুন সেটি না হয় দেখি।
বলেছিলাম জিডিপি হিসাব করতে হয় টাকার অংকে। যেহেতু টাকায় হিসাব করতে হয় সেহেতু শুভঙ্করের ফাঁকি কিছু প্রক্ষিপ্ত তো হবেই এই টাকার ভেতর। কেননা টাকা এক অতি স্পর্শকাতর প্রপঞ্চ এবং ইতোমধ্যে টাকার খেলা আমরা প্রচুর দেখেছি। টাকার কল্যাণে ১ নাম্বারে দুশ নাম, ৩৭ লাখ টাকা পর্দার দাম, এমনই অবিশ্বাস্য টাকার কাম, হাহা…। ফলে টাকার আছে অনেক শক্তি, তাই চলুন টাকাকে সবাই করি ভক্তি। আসুন টাকার তেলেসমাতিটি এখানে কি, সেটি এবার দেখি। দেখুন, একটি দেশের জাতীয় উৎপাদনের ভেতর হাজার হাজার পণ্য ও লক্ষ লক্ষ সেবা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিষয় সব যদি এখানে হিসাবে আনি, বক্তব্যটা হয়ে যাবে অতি জটিল আর ব্যাপক যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে সঙ্কুলান হবে না। তাই বিষয় সহজ ও সংক্ষিপ্ত করণে আমরা কেবল একটি মাত্র বস্তুকে এখানে জিডিপির মানদÐ হিসেবে গণ্য করব। ধরুন গত বছর আমাদের পিঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ১০ কেজি, আর দাম ছিল ২০ টাকা কেজি। ফলে গতবছর আমাদের জিডিপি ছিল ২০০ টাকা। এবার ধরুন আমাদের পিঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৫ কেজি, কিন্তু দাম ৩০০ টাকা কেজি, কাজেই এবছর আমাদের জিডিপি ১৫০০ টাকা। অতএব এবছর আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১৩০০ টাকা তথা শতে প্রবৃদ্ধি ৬৫০ টাকা, হাহা…। আশাকরি মোটামুটি বুঝা গেছে প্রবৃদ্ধি ব্যাপারটা।
আসলে অধমের অনুর্বর মস্তিষ্কে এসেছে যা ছাড়লাম, ভুল হলে ক্ষমা করবেন। ভুল-শুদ্ধ যা’ই হোক, আলোচনার এই লেভেলে এসে উপলব্ধি করছি প্রবৃদ্ধির সোনার হরিণের পিছে না ছুটে, সমৃদ্ধি কি হয়েছে চিন্তা করাই অধমের জন্য উত্তম। কারণ প্রবৃদ্ধির মধ্যে রয়েছে একটি বড় ফাঁক যা সমৃদ্ধির ভেতর নাই। একটি কথা মনেরাখা দরকার আমাদের দেশে বছর বছর টাকার দাম কমে পণ্যমূল্য বাড়ে।
চীন-ভারতে তা হয়না সেখানে মূল্য আরো কমে। আমাদের দেশে বছর বছর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ে, যা জিডিপিতে প্রভাব ফেলে তাই প্রবৃদ্ধি বাড়ে। কিন্তু উল্লেখিত দেশগুলোতে এসব সেভাবে হয় না। এক ছেলে শহরে এসে ঘুরতে ঘুরতে খিদে লাগায় হোটেলে ঢুকল। বয় জানাল, ডিম আছে, মাছ আছে, মাংস আছে, এগ কা’রি আছে। কি দেবো? ছেলে তো এগ কা’রি নাম কখনো শুনেনি, তাই বলল, এগ কা’রি দাও। বয় খাবার নিয়ে এলে ছেলে দেখে ঝোলের ভেতর ডিম। তখন সে, ও মরার আÐা শুরুয়ার ভেতর দেয়াতে তুই কা’রি হয়ে গেলি? এখন আÐার দাম তো দশ টাকা, কা’রি হওয়ায় হয়ে গেল ৩০ টাকা। কারি যে এত ভারি সে বুঝিতে নারী, হিহি..। প্রবৃদ্ধিও সেরূপ, পিঁয়াজে ২০ টাকা প্রবৃদ্ধিতে ৩০০ টাকা। তবে এত সোজাও না, প্যাঁচ কিছু আছে তার ভেতর। লক্ষ উপকরণের সামঞ্জস্য বিধান করা লাগে। কিছুর মূল্য বাড়ে, কিছুর কমে, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্য সংকোচন, ইত্যাদি সমন্বয় সাধন করে সঠিক প্রবৃদ্ধিনির্ণয় কিছুটা জটিল। তবে তাই বলে এটি ভাববেন না, প্রবৃদ্ধি পারসেপশনটা অতি জটিল। পারসেপশন অতি সরল, শুধু নির্ণয়করণটা একটু গরল। জটিল যা-তা হল স্নো-পাউডার, লিপস্টিক মানে মেকআপ। দেখেন না মেকআপ মেরে কালা মেয়ে ধলা বানায়? প্রবৃদ্ধি ঠিক তেমনি কালা বাজেট ধলা করে, হেহে…। বাজেট নিয়ে কি বলব, ইতোমধ্যে নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিদ্যুৎ, ভর্তুকি, প্রণোদনাতে নানা মুনির নানামত। এই ক্ষুদ্র পরিসরে তা পর্যালোচনা সম্ভব না। পরবর্তী স্বল্প সময়ে একক একটি প্রবন্ধ রচনার আশা রাখি। তবে আজ দুয়েকটি কথা বলব, ব্যাখ্যা সেদিন দেব।
দেখুন বাজেটে বলা হয়েছে লাভক্ষতি যা হোক, বছরে ৩ কোটি টাকা লেনদেন হলে ০.৫% ট্যাক্স দিতে হবে। এখন চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে যারা তেল-চিনির ডিওর কারবার করে তারা একটি ডিও ৫০০ টাকা লাভেও বিক্রি করে। আর ১টি ডিওর মূল্য দশলক্ষ টাকা! তাহলে বছরে তার লেনদেন কত হবে? তাছাড়া ১টি ডিওতে তো তার ট্যাক্সই আসবে ৫ হাজার টাকা, হাহা…। করযোগ্য আয় সীমা ধরা হয়েছে তিনলক্ষ টাকা, কিন্তু বর্তমান বাজারে তা হওয়া দরকার ৬লক্ষ টাকা। কারণ একটু মানসম্পন্ন জীবনযাপন করতে গেলে এখন ৫০ হাজার টাকার নিচে তা সম্ভব নয়। ৫৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটের কোন দরকার নাই আমাদের। দুর্নীতি যদি বন্ধ হয় ১ লক্ষ কোটিতে হবে, বাজেটের টাকা তো সব ঘুষে আর জোশে যায়। মাত্র এককাজে গণপূর্ত বিভাগের দুইজন ইঞ্জিনিয়ার ১৫’শ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছে! সেই সাথে পর্দা, পুকুর খনন, উগাÐায় বিচরণ, সম্প্রতি কলা, রুটি, ডিমÑ এতেই বুঝে নিন দেশের পুরা সিন = দৃশ্য। আমাদের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলিত হচ্ছে ৮.২% অথচ এশিয়ার ঝানু ঝানু অর্থনীতি এখন মাইনাস। বিশ্বব্যাংক বলছে ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি পর্যন্ত এবার মাইনাস থাকবে। আমদের প্রবৃদ্ধি সেখানে ওভার প্লাসে, হেহেহে। অবশ্য আশার কথা, হলে উত্তম। কিন্তু যুগে যুগে শাসকরা শাসিতের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়। দেখিয়ে কুসুম আকাশ,করেছে বিষম হতাশ, সাক্ষী গোটা ইতিহাস।
প্রকৃতপক্ষে বাজেট জটিল কোন বিষয় নয়, পরিবারে আমরা প্রতিদিন বাজেট করি। তবে রাষ্ট্রীয়গÐিতে তার কিছু ব্যাপকতা রয়েছে। আর বাজেটারি টার্মগুলি হল ইকোনোমিক্যাল টার্ম তথা অর্থনৈতিকশব্দ, তাই একটু বিদঘুটে ও দুর্বোধ্য হয় মেডিক্যাল টার্মের মত। ডাক্তার বললেন, সিদ্দিক্যার ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে। শুনে সিদ্দিক্যা মা তো কেঁদেকেটে হয়রান; মাগো আমার ছেলের কি হইলরে, আল্লাহ্রে আমার পোলা বাঁচব নি? আপনি যখন শুনলেন ইনফ্লুয়েঞ্জা, আপনি বুঝে গেছেন সেটি সর্দি। সিদ্দিক্যা মাকে তখন আপনি বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন, সিদ্দিক্যা মা শান্তি। সেরূপ বাজেট, জিডিপি, প্রবৃদ্ধি শব্দগুলিও ঠিক তেমন, না বুঝলে ইনফ্লুয়েঞ্জা, বুঝলে সর্দি, হিহি…।

লেখক : কলামিস্ট