প্রবাসে নির্যাতিত নারী শ্রমিকেরা

36

প্রবাসে গিয়ে কষ্টের আয়ে যে নারী শ্রমিক বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন সেই শ্রমিকরাই বিদেশে গিয়ে শিকার হচ্ছেন অমানবিক নির্যাতনের। কপাল ফেরাতে বিদেশ পাড়ি দিলেও নারী শ্রমিকরা দেশে ফিরছেন লাশ হয়ে। নির্যাতিত যেসব নারী কোনোরকমে মালিকের অত্যাচার থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে আসছেন তাদের শরীরেও নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট। দেশে ফিরে এসব শ্রমিকের কেউ কেউ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খুললেও লজ্জায় মুখ বন্ধ রাখেন অনেকেই। চলতি বছরের ১০ মাসে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়ে ৯৫০ জন নারী শ্রমিক সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন। আবার এই বছরেরই প্রথম ১০ মাসে দেশে ফিরেছে ১১৯ জন নারী শ্রমিকের লাশ। বিদেশে নারী কর্মীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সামনে বারবার তুলে ধরা হলেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স। প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন। আগে শুধু পুরুষরাই কাজের জন্য বিদেশে যেতেন; কিন্তু গত এক দশকে অনেক নারী শ্রমিকও এসব দেশে বিশেষত গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করার জন্য যাচ্ছেন।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত নারীর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ ৬৬ হাজার। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই রয়েছেন ৪ লাখের উপর। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গৃহ খাতে কর্মী নিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সৌদি সরকারের একটি চুক্তি হয়।
এ চুক্তির আওতায় বিনা খরচে সৌদি আরব যেতে পারেন নারীরা। এসব নারীর বেতন ৮০০ রিয়াল বা ১৭০০০ টাকা। দুই বছরের জন্য এই চুক্তির আওতায় নারীরা সৌদি আরব যাচ্ছেন। এ চুক্তির অধীনে ৩ লাখের মতো নারী শ্রমিক সৌদি আরব গেছেন।
যেসব নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য বিদেশে যান, তাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। অসচ্ছল বা স্বামী পরিত্যক্ত নারীরাই মূলত কাজ করার জন্য এসব দেশে যাচ্ছেন। যখন নারী শ্রমিকদের কথা আসে তখন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে আসে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এসব প্রবাসী নারীকর্মীর নিরাপত্তার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। নারীকর্মীদের বেশিরভাগই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে দাসীর মতো ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমন অনেক ঘটনার বিবরণ আমরা খবরের কাগজে দেখতে পেয়েছি। যে স্বপ্ন নিয়ে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন নারীরা, তা খুব কম সময়ের ব্যবধানেই বালির বাঁধের মতো ভেঙে যাচ্ছে। এ নারীদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েও পরিবার-পরিজনের কল্যাণের কথা ভেবে কাজ করে যাচ্ছেন। অনেকে দেশে ফিরতে চেয়েও পারছেন না। যারা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরার সুযোগ পাচ্ছেন, তাদের অনেকেই দেশে ফিরে আসছেন।
গত নয় মাসে শুধু সৌদি আরব থেকে আট শতাধিক নারীকর্মী দেশে ফিরেছেন। এসব নারীর ভাষ্যে নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনাগুলো আমরা জানতে পারছি। এত বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের দেশে ফেরত আসার পেছনের কারণগুলো অবশ্যই অনুসন্ধানের দাবি রাখে। প্রথমত, এসব নারী শ্রমিক আসলে কোন্ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন, সেটা সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে।
এ নারীদের অনেকেই যাচ্ছেন দালালদের মাধ্যমে এবং অনেকে নারী পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ছেন। ফলে বিদেশে যাওয়ার পর তারা দাস-দাসীর মতো আচরণের শিকার হচ্ছেন। যেসব নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসছেন, তাদের মুখেই নিগ্রহের কাহিনী আমরা শুনছি। যেমন- তাদের ঠিকমতো খেতে দেয়া হয় না, বেতন চাইলে তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
এ অবস্থায় নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। কোনোভাবেই যেন কোনো নারী দালালের খপ্পরে না পড়েন সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব রিক্রুটিং এজেন্সিকে শ্রমিক পাঠানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাদের প্রতি অবশ্যই কঠোর নির্দেশনা থাকা দরকার। সৌদিতে নারী শ্রমিক পাঠানোর আগে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে বিবেচনায় রাখতে হবে। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। কোনো নারী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হলে তাকে দ্রæত আইনি সহায়তা প্রদান করতে হবে। সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের সরকারের সম্পর্ক অনেক ভালো।
সুতরাং সরকারি পর্যায়ে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পেলে অবস্থার পরিবর্তন হবে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত সব নারী শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহবান জানাচ্ছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক