প্রফেসর শায়েস্তা খানের জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা

139

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

[গতকাল ১০ জুন ছিল প্রফেসর শায়েস্তা খানের জন্মদিন। জীবনের সাড়ে সাত দশক পেরিয়ে পা রেখেছেন ৭৬-এ। তিনি চট্টলার কৃতি সন্তান। শিক্ষাবিদ, ক্রিড়া সংগঠক ও লেখক। ২০১৩-২০১৬ খ্রি. পর্যন্ত দৈনিক পূর্বদেশে ‘৬০-এর দশকে ছাত্র রাজনীতি এবং আমি’ শীর্ষক একটি কলাম লিখে পাঠক সমাজে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ায় লেখাটি আর নিয়মিত করা সম্ভব হয়নি। আমরা স্যারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর আলোচ্য কলামটি ছাপিয়ে প্রফেসর শায়েস্তা খানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।- সম্পাদকীয় বিভাগ]
প্রফেসর শায়েস্তা খান একজন বর্ণাঢ্য চরিত্রের আকর্ষণীয় মানুষ। তিনি নানা গুণে গুণান্বিত একজন বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে স্নেহভাজন সুপ্রতিম বড়ুয়া একটি পোস্ট দিয়েছেন ফেসবুকে। খুব ভাল কাজ করছেন সুপ্রতিম। শায়েস্তা খান সাহেবের মত একজন জ্ঞানী মানুষের জন্মদিন আমাদের জন্য পুণ্যদিন।তিনি চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন, এটা চট্টগ্রামের জন্য গৌরবময় ঘটনা এবং চট্টগ্রামবাসীর জন্য সৌভাগ্যের দিন।আমি সকাল এগারটার সময় এই পোস্ট লিখতে বসেছি। ফেসবুকে খুব বেশি লাইক কমেন্ট দেখতে পাচ্ছি না। অথচ প্রফেসর সাহেবের শত শত ছাত্র (হাজার বললেও অত্যুক্তি হবে না) চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ছড়িয়ে আছেন।তাঁর বিখ্যাত ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আবদুল মান্নান, চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ, হাজী মহসিন কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ফজলুর হক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোরুল আজিম আরিফ তো রয়েছেনই। কেন প্রফেসর শায়েস্তা খানের জন্মদিনে তাঁর ছাত্র ভক্ত-অনুরক্তের সাড়া মিলল না সেটা সেই যে প্রবাদ আছে ‘বাঙালি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে না’- সে কথা মনে রাখলে হয়তো আফসোস থাকবে না। তা সত্তেও প্রফেসর শায়েস্তা খান যে একজন বড় মাপের মানুষ তা মিথ্যা হয়ে যায় না।
আমি যতটা জানি প্রফেসর শায়েস্তা খানের জন্ম ১৯৪২ সালে। সে হিসেবে তাঁর ৭৯তম জন্মদিন হওয়ার কথা। প্রফেসর শায়েস্তা খানের কথা উঠলে তিনি একজন শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াসংগঠক, আলোকিত মানুষ তাঁর এসব গুণের কথা উল্লেখ করা হয়।কিন্তু তিনি যশস্বী শিক্ষক ছাড়াও একজন বিশিষ্ট শিক্ষাসংগঠক ছিলেন। কমার্স কলেজের অধ্যাপনা ও অধ্যক্ষতা ছাড়াও তিনি একাধিক কলেজ সংগঠিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাকে একজন শিক্ষা সংগঠক ও শিক্ষা প্রশাসকও বলা যায়। এদিক থেকে তিনি স্বনামধন্য অধ্যক্ষ রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে তুলিত হতে পারেন।রেজাউল করিম সাহেব সিটি কলেজ ছাড়াও আরও দু’টি কলেজের অধ্যক্ষ পদ অলংকৃত করেছিলেন। এর একটি ওমর গনি এমই এস কলেজ ও অপরটি কাট্টলী মোস্তফা হাকিম কলেজ। আরও কলেজ থাকতে পারে, আমি হয়তো জানি না। তবে আমি যতদুর জানি পটিয়ার হুলাইন ছালেহ্ নূর কলেজ প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকে প্রায় সব কাজ তিনি করে দেন। সেকালে ভাল পাস দিয়ে যারা শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হতেন তারা নামিদামি সরকারী কলেজে শিক্ষকতা করতে চাইতেন। যেমন চট্টগ্রাম কলেজ, সরকারি কমার্স কলেজ।কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পরিক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে গোল্ড মেডেল পাওয়া রেজাউল করিম চৌধুরী কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপনা করে তারপর চট্টগ্রাম এসে লেখাপড়ায় অমনোযোগী, বেয়াড়া স্বভাবের দুরন্ত ছাত্রদের মানুষ করার ব্রত নিয়ে সিটি কলেজে যোগ দিলেন। অধ্যক্ষ রেজাউল করিম সাহেব না হলে মহিউদ্দিন চৌধুরী, সুলতান-উল -কবির চৌধুরী, ইদরিস আলমদের মানুষ করতো কে। রেজাউল করিম সাহেব এমন অসাধারণ প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন যে তাঁর সঙ্গে তুলনা করার মত প্রতিভাবান লোক খুব বেশি আমরা পাই না। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে চট্টগ্রামের দুই’শ বছরের
ইতিহাস অধ্যয়ন করে মেধাবী মানুষদের আমি যে নামগুলো পেয়েছি সেগুলি হলো -সফিনা-ই-ইলম মওলানা আবুল হাসান, মহাকবি নবীন চন্দ্র সেন, রাজদূত শরচ্চন্দ্র দাশগুপ্ত, কবি ভাস্কর শশাঙ্ক মোহন সেন, কেদারনাথ দাশগুপ্ত, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ভূতপূর্ব প্রিন্সিপাল ড. আতাউল হাকিম, প্রফেসর ওমদাদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার ড. সানাউল্লাহ, প্রফেসর এটিএম আবদুল হাই, অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র সিংহ, কানুনগো পাড়ার দত্ত ভ্রাতাগণ, সিএসপি শফিউল আজম ও একে এম আহসান, শিক্ষাপ্রশাসক ও ভাষাতত্ববিদ মোহাম্মদ ফিরদাউস খান, অধ্যাপক সুলতান উল আলম চৌধুরী,অধ্যক্ষ মোজাফফর আহমদ, বাংলাদেশ পরিকল্পনা পরিষদের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম, ধন্বন্তরী চিকিৎসক ষষ্টী মজুমদার, ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর, নীল কমল কবিরাজ ও চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডাক্তার নুরুল ইসলাম, তমুদ্দুন মজলিস ও বাংলা কলেজখ্যাত অধ্যক্ষ আবুল কাসেম, অধ্যক্ষ রেজাউল করিম চৌধুরী, ড. জামাল নজরুল ইসলাম, ড.অনুপম সেন ও ড. সলিমউল্লা খান। রেজাউল করিম সাহেবকে তার পিতা আলী আহমদ চৌধুরী এমএলএ পিএইচডি করার জন্য লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন। একবার ছুটিতে বাড়িতে আসলে তার পিতা আলী আহমদ চৌধুরী তার পীর হাটহাজারীর মুফতি ফয়েজউল্লাহর কাছে তার পুত্রকে নিয়ে যান। রেজাউল করিম সাহেব মুফতি সাহেবের মুরিদ হন। এরপরের ঘটনা রেজাউল করিম সাহেবের বাসায় বসে তার মুখে আমি শুনেছি।পীর সাহেব নাকি কোলাকুলি করতে যেয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রচÐ চাপ দেন। রেজাউল করিম সাহেবের মনে তার বুকে বিরাট তোলপাড় শুরু হয়ে যায়।তার মনে হলো তার চোখের সামনে দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞান উন্মোচিত হয়ে গেল। এ কথা শোনা মাত্রই আমার শরীরে সমস্ত লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম স্যার কি হয়েছিল? তিনি বললেন বাবা পীর সাহেব বুকে চাপ দিয়ে আমার কলব পরিস্কার করে দিয়েছেন।দুনিয়ার কোন জ্ঞান তখন আমার অজানা নেই।এরপর যা হলো আরোও কৌতুহল উদ্দীপক। রেজাউল করিম সাহেব আর লন্ডন গেলেন না।কেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন সেখানে গিয়ে যা পড়বো এখানে বসে আমি তা জানি। এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন এসে যায়। আপনি বিশ্বাস করতে পারেন নাও করতে পারেন। ‘বিশ্বাসে মিলায় হরি তর্কে বহুদূর’ পরলোকগত জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকও লন্ডনে গিয়েছিলেন পিএইচডি করতে। তাঁর গাইড ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত প্রফেসর হ্যারল্ড লাস্কি। থিসিস করার মাঝপথে প্রফেসর লাস্কি মারা গেলে অধ্যাপক রাজ্জাক দেশে চলে আসেন এই বলে যে প্রফেসর লাস্কি যখন নাই তখন পৃথিবীতে আমার থিসিস কে দেখবে? বাঙালি মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর অধ্যাপক রাজ্জাকের এই অসমাপ্ত থিসিসটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ভুঁইয়া ইকবাল তাঁর সম্পাদিত ‘বক্তব্য’ পত্রিকায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। প্রফেসর শায়েস্তা খানের প্রসঙ্গে রেজাউল করিম সাহেবের কথা বোধয় বেশি বলা হয়ে গেলো।আবার শায়েস্তা খানের প্রসঙ্গ ফিরে আসি। অধ্যক্ষ শায়েস্তা খান চান্দগাঁও এর বিখ্যাত হায়দার আলী নাজিরের বংশধর, তার পিতা আজিজ উল্লা খান লালদীঘির দক্ষিণ পাড়ের যে লাইব্রেরি, একসময় যার নাম ছিল বাকল্যান্ড ঘাট লাইব্রেরি, বর্তমানে ভাষা সংগ্রামী মাহবুবুল আলম চৌধুরীর নামে যার নামকরণ হওয়ার কথা, সেই লাইব্রেরিতে শায়েস্তা খান সাহেবের পিতা লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
প্রফেসর শায়েস্তা খান অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কৃতিত্বপুর্ণ শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি শিক্ষকতায় যোগদান করেন এবং কমার্স কলেজসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করে অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। তবে প্রফেসর শায়েস্তা খানের জীবনের যেদিকটা মানুষ ভুলে যাচ্ছে, সেদিকটা হলো তিনি একজন ছাত্রনেতা ছিলেন। ১৯৬২ সালে যখন এম এ মান্নান, ফেরদৌস কোরেশি, শহীদ মুরিদুল আলম,আবু সালেহ প্রমুখের উদ্যোগে চট্টগ্রামে নতুনভাবে ছাত্রলীগ পুনরুজ্জীবিত করা হয় এবং কমিটি পুনঃগঠিত করা হয়, তখন ফেরদৌস কোরেশিকে আহŸায়ক এবং পেকুয়ার বখতিয়ার কামাল চৌধুরী ও প্রফেসর শায়েস্তা খানকে যুগ্ম আহŸায়ক নির্বাচিত করে ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম শাখা গঠন করা হয়। শায়েস্তা খান ৬২’র ছাত্র আন্দোলনের প্রধান নেতা। শায়েস্তা খানদের দিয়েই চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের গৌরবময় ইতিহাসের ভিত্তি রচিত হয়। তখন ভাল ছাত্ররাই ছাত্রলীগের নেতা হতেন। যেমন এম এ মান্নান, ফেরদৌস কোরেশি, শহীদ মুরিদুল আলম, শায়েস্তা খান,এসএম ইউসুফ, ইদরিস আলম, আ ফ ম মাহবুবুল হক, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি,আফতাব আহমদ, রায়হান ফেরদাউস মধু প্রমুখ ভাল ছাত্ররা বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেয়ায় চট্টগ্রামে ছাত্র সমাজের মাঝে ছাত্রলীগ দ্রæত জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
শায়েস্তা খান শুধু ক্রীড়া সংগঠক নন, তিনি একজন ক্রীড়া লেখক ও ভাষ্যকারও। তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি নন্দনকানন তমিজ মার্কেট থেকে ‘দৈনিক মিছিল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। প্রফেসর শায়েস্তা খান একজন সুলেখক। তার ভাষা সরস, রসালো, ফলে তার লেখা পড়ে স্বাদ গদ্যের আমেজ পাওয়া যায়। তার জ্ঞানের ভান্ডার বিশাল, ‘মেছাল’ (রেফারেন্স) দিয়ে যে লেখা তিনি পরিবশন করেন তা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠে। তিনি চট্টগ্রামে একটি বৈঠকী গদ্যের ঢং আমাদের উপহার দিয়েছেন। গানে যেমন হয় বৈঠকী গান, যেমন রামকুমার ভট্টাচার্যের বৈঠকী গান;যেমন রান্নায় তেল মসলা বেশি দিয়ে ঘন ঝোলবসিয়ে হয় বৈঠকী রান্না। তিনি সম্ভবত নাসিরুদ্দিন হোজ্জা অথবা গোপাল ভাড় কিংবা বীরবলের ভক্ত। তার লেখায় পরিবেশিত হাস্যরস উপভোগ্য হয়ে উঠে। অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন সাহেবও ব্যঙ্গ বিদ্রæপাত্মক লেখা লিখতেন। তবে পার্থক্য আছে। প্রফেসর সাহেব রম্য রচনা লিখতেন। তার লেখায় ধার ছিলো, উইটের কাছে তার দাবী ছিল বেশি। অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিনের রঙ্গরচনায় হাসির ঝিলিক খেলে যায়।
প্রফেসর শায়েস্তা খান একজন আড্ডাপ্রিয়, দরবারী মানুষ। যেমন জহুর হোসেন চৌধুরী, চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী ও হাতি কোম্পানির রফিক মিয়া (শায়েস্তা খানের আঙ্কেল) দরবারী মানুষ ছিলেন। প্রফেসর শায়েস্তা খানের পর আড্ডা জমানো লোকের অভাব পড়বে। আহা অমন রূপবান, গুণবান মানুষটি যখন মধ্যমনি হয়ে দরবারে বসেন তখন কী যে ভাল লাগে।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক