প্রধানমন্ত্রী… প্লিজ আরো কঠোর হউন

23

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী
বীর চট্টলাবাসীর পক্ষ থেকে আপনাকে বিপ্লবী অভিন্দন। চট্টগ্রাম সংগ্রাম ও বিপ্লবের নগরী। ১৯৬৯ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীর চট্টলার ঐতিহাসিক লালদিঘীর ময়দান থেকে ৬ দফা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বীর বাঙ্গালি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে প্রিয় স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। বাঙ্গালি আজ স্বাধীন। সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন এ বাংলায় বাঙ্গালী যা ইচ্ছা তাই করবে এটি কোনোভাবে মেনে নেয়া যাবে না। প্রিয় নেত্রী, গত ১২ বছর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আপনি শতভাগ সফল প্রধানমন্ত্রী আসীন হয়েছেন। উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ও ব্যাপক কর্মকাÐের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী এখন ইমাজিং টাইগার। বাংলাদেশকে অনুসরণ করার জন্য অনুশীলন করছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভ‚টান, শ্রীলংকা, কানাডাসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো। অপ্রিয় হলেও সত্য যে চিহ্নিত কিছু কুলাঙ্গারের জন্য বাংলাদেশের অহংকার ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা ধ্বংস করা যাবে না। দুর্নীতিবাজ ঘুষখোর ও ক্যাসিনো ওয়ালাদের খপ্পর থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করা হয়েছে। এখন আত্মশুদ্ধির অভিযান খুব জরুরী।
প্রিয় পাঠক এবার লক্ষ্য করুন দুর্নীতি, চাঁদাবজি, ক্যাসিনো ও মাদক বিরোধী অভিযানে এতদিনের অধরা সরকারি দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতেও এখন আইনের হাতকড়া পড়ছে। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম, এই ইংরেজী প্রবাদ বাক্যের সত্য আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ দলের অপরাধী, লুটেরা, ক্যাসিনো-জুয়াড়ি ও কালোটাকার মালিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযানের নির্দেশ দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অপসারণ করা হয়। এরপর অভিযান শুরু হয় ক্যাসিনো, জুয়া, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত অগাধ কালো টাকার মালিক যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাবের অভিযানে যে কয়জন যুবলীগ নেতাকে ধরা হয়েছে তাদের অফিস ও বাসার ভল্ট থেকে উদ্ধার করা নগদ কোটি কোটি টাকা, ব্যাংক ডিপোজিট, টাকা পাচারের আলামত এবং মাদক ও অস্ত্রের মুজদ দেখে আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি উদ্বেগজনক চিত্র বেরিয়ে এসেছে। এসব ব্যক্তি এতদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও এখন খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই অপকর্মের হোঁতাদের হাতে আইনের হাতকড়া পড়ানোর পর জাতি নতুনভাবে উপলব্ধিকরতে পারছে, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। শুধু সরকারের শীর্ষ মহল ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রয়োজন ছিল। দেরিতে হলেও প্রধানমন্ত্রী সে নির্দেশনা এবং ব্যক্তিগত সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। অবশ্য ৫-১০ জনকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়েই এ ধরনের অভিযানের সাফল্য-ব্যর্থতা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ ধরনের অভিযানের সুফল পেতে হলে এ মূলে হাত দিতে হয় এবং সফল পরিসমাপ্তির জন্য দৃঢ় অঙ্গীকার নিতে হয়। রাজনৈতিকভাবে অনেক ত্যাগ স্বীকারেরও প্রয়োজন হয়।
দেশে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, লুণ্ঠন, মাদক-জুয়ার কালো অর্থনীতি এবং বিদেশে টাকা পাচারের মচ্ছব হঠাৎ করেই উদ্ভব হয়নি। বিগত সরকারগুলো সময়েও কমবেশি এসব সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যধির প্রাদুর্ভাব ছিল। তবে বর্তমান সরকার গত এক দশকে অর্থনৈতিকভাবে এবং অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশকে যেমন বহুদূর এগিয়ে নিয়েছেন, সেই সাথে মোটা মহীরূহের ডালে ডালে জেঁকে বসেছে পরগাছার আচ্ছাদন। এখন সরকারী দলের পরিচয়ে এসব দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ও জুয়ায় নিজ্জিত পরগাচাই ক্ষতাসীন দলকে ডুবাতে বসেছে। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এবং ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্রলীগের এক শ্রেণীর নেতাকর্মীর বল্গাহীন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও খুনাখুনি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাÐ এবং ইতিবাচক অর্জনগুলোর উপর কালিমা লেপন করে দেয়। প্রধানমন্ত্রীকে বার বার এদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে দেখা গেলেও তাদের আচরণের তেমন কোনো পরিবর্তন না ঘটায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্থানীয় ছাত্রলীগ কমিটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি এক সময় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন। এরপরও ছাত্রলীগের অপকর্মের তেমন কোনো হেরফের দেখা যায়নি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার স্বার্থ হাসিলে প্রভাব বিস্তারের জন্য সরকারীদল এমনকি নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি করে শত শত নেতাকর্মী হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগের মত ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা যখন আত্মকলহ, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ ক্যাম্পাসে একের পর এক রোমহর্ষক ষটনার জন্ম দেয়, তখন দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার কোনো পথ থাকে না। দেশের মানুষ জাতির জনকের কন্যার প্রতি আস্থা রাখতে পারেন। গত কয়েক সপ্তাহের অভিযানে সেই আস্থার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এ পর্যন্ত যারা আইনশৃঙ্গলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে তাদের প্রায় সকলেই সরকারী দলে নেতাকর্মী। তবে ১০-২০ জনকে গ্রেফতার করলেই অবস্থার পরিবর্তন হবে না। এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সুশাসন, রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। গণতন্ত্রের রাজনৈতিদক মূল্যবোধের অবাধ চর্চা ছাড়া এ পরিবর্তন সম্ভব নয়। অনেক ব্যর্থতা ও হতাশার মধ্যেও গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্জনও কম নেই। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ, অমর্ত্য সেন সম্প্রতি একটি মার্কিন পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে সামাজিক ও জীবনমান উন্নয়নের বেশ কিছু খাতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে বেশ এগিয়ে গেছে বলে স্বীকার করেছেন। বিশেষত: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা ও সহাবস্থানের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের কথা বলেছেন। তিনি ভারতে বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সহাবস্থানের পরিবেশ নস্যাৎ হয়ে পড়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার শিক্ষা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম ধর্মের মৌলিক শিক্ষার অংশ। তবে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অসষ্ণিুতা এবং মত প্রকাশের কারণে বর্বরোচিত হত্যাকাÐের মত ঘটনা বর্তমান সরকারের গণতান্ত্রিক ভাবমর্যাদাকেই শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, সেই সাথে বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের অবস্থাকেও বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ড আমাদের শিক্ষাঙ্গনে বেড়ে ওঠা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবের চিত্রই জাতির সামনে তুলে ধরেছে। আবরার হত্যার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে জড়িত বলে সন্দেহভাজন অনেককেই ইতিমধ্যে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, এ কথা প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। এবার নিজ দলের খুনি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, অর্থপাচারকারী, ব্যাংক জালিয়াত, ক্যাসিনো ও মাদক গডফাদারদের বিচারের সম্মুখীন করতে অভিযান পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশপ্রেম, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা ও অঙ্গীকার এই অভিযানের মধ্য দিয়েই প্রমানিত হচ্ছে। আমরা এই অভিযান ও অঙ্গীকারের প্রতি আস্থা রাখতে চাই। একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেই সম্ভব বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয় রুখে দিয়ে একটি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করা। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ বিণির্মান করতে হলে প্রধানমন্ত্রী আপনাকে আরো কঠোর ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হতে হবে…।
লেখক : প্রাবন্ধিক