প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের শত বৎসর পর

163

প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে। এই যুদ্ধ দীর্ঘ চার বৎসরব্যাপী সারা বিশ্বে এক মহা তাÐব সৃষ্টি করেছিল। এক পক্ষে ছিল জার্মানি, অষ্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি এবং ইতালি অপর পক্ষে ছিল গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়া। জার্মানি এবং ফ্রান্সের মধ্যে বৈরীতা ছিল বহু পুরোনো। জার্মানে তখন বিসমার্ক ক্ষমতায়। ১৮৭০ সালে ফ্রান্সের দুইটি প্রদেশ ‘আলসেচ্্’ এবং ‘লরেন’ জার্মানী নিজেদের ভূমি বলে দাবি করে চিরতরে দখল করে নেয়। তখন থেকেই ফ্রান্স এবং জার্মানীর মধ্যে চিরস্থায়ীভাবে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের সৃষ্টি।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে শুরু করে। ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলির মধ্যে বিভিন্ন মহাদেশে বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকায় সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় সর্বশক্তি নিয়োগের অটল সিদ্ধান্ত নেন। ফলে ১৯০৪ সাল থেকে ১৯১৪ অর্থাৎ যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় পর্যন্ত প্রায় এক দশক ধরে সমস্ত ইউরোপে অরাজকতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছিল। বিশ্ব ইতিহাসে এই দশকটি ‘অরাজকতার’ দশক হিসাবে ???????।
প্রথম মহাযুদ্ধে কাইজার দ্বিতীয় উইলহেল্ম ছিলেন জার্মানির সম্রাট এবং যার দ্বিতীয় নিকোলাস ছিলেন রাশিয়ার সম্রাট। প্রথমে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয় জার্মানি এবং রাশিয়ার মধ্যে। ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসের মধ্যেই ইউরোপের ৮টি দেশের প্রায় ১৭ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৪০ লক্ষ লোক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তিন বৎসর পর অর্থাৎ ১৯১৭ সালে কমরেড লেলিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সর্বহারা বা কম্যুনিস্ট বিপ্লব ঘটে। রাশিয়ার কম্যুনিস্ট নেতৃবৃন্দ বিশেষকরে কমরেড্্ লেলিন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে ইউরোপের সা¤্রাজ্যবাদীদের শোষণ করার যুদ্ধ বলে নীতিগতভাবে এই যুদ্ধ পরিত্যাগ করার ঘোষণা দেন।
১৯১৮ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে জার্মানির সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে রাশিয়া নিজেকে যুদ্ধ থেকে প্রত্যাহার করে নেন। ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসের ২ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উইলসন ইউরোপের এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের ঘোষণা দেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের যুদ্ধ অংশগ্রহণের ঘোষণার অনুমোদন দেয়। তখন কংগ্রেসের সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উইলসন যুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণ স্বরূপ বলেছিলেন, “ঞযব সড়ংঃ ঃবৎৎরনষব ধিৎ ড়ভ ধষষ ধিৎং. ইঁঃ ঃযব ৎরমযঃ রং সড়ৎব ঢ়ৎবপরড়ঁং ঃযধহ ঢ়বধপব ধহফ বি ংযধষষ ভরমযঃ ভড়ৎ ঃযব ঃযরহমং ঃযধঃ বি যধাব ধষধিুং পধৎৎরবফ হবধৎবংঃ ড়ঁৎ যবধৎঃং, ভড়ৎ ফবসড়পৎধপু, ভড়ৎ ৎরমযঃ ধহফ ষরনবৎঃরবং ড়ভ ংসধষষ হধঃরড়হং.” অর্থাৎ ‘এই শান্তিকামী জনগণকে একটি ভয়ংকর যুদ্ধে সম্পৃক্ত করা ভয়ের ব্যাপার। কিন্তু শান্তির চাইতে ‘অধিকার’ অধিক মূল্যবান। আমরা যেটাকে হৃদয় দিয়ে পোষন করি তার জন্য অবশ্যই যুদ্ধ করব তাহলো ক্ষুদ্র দেশসমূহের গণতন্ত্র, ন্যায্য অধিকার এবং স্বাধীনতা।’ যুক্তরাষ্ট্র তখনও সম্পদশালী এবং শক্তিশালী দেশ ছিল। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র বৃটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে যোগদানের ফলে এসব দেশ আরও শক্তিশালী হয়ে যায়। মানবজাতির ইতিহাসে এটাই ছিল সব চাইতে প্রথম ভয়াবহ দুর্বিপাক। এই ভয়াবহ যুদ্ধে কত মানুষ নিষ্ঠুর হত্যার স্বীকার হয়েছে এবং কত মানুষ আমৃত্যু পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, কত মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে তার সঠিক হিসাব এখনও বের করা সম্ভব হয় নাই। এসব ব্যাপারে সকল হিসাবই আনুমানিক। এক হিসাবে দেখা যায় প্রত্যেকদিন এই যুদ্ধে গড়ে ৬,০০০ মানুষ হত্যার স্বীকার হয়েছে। এই হারে ১৫০০ দিন হত্যাকাÐ সংঘটিত হয়েছিল। দুই পক্ষের সর্বমোট ৩০ মিলিয়ন বা ৩ কোটি সৈন্যের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়াও উভয় পক্ষের অগণিত সৈন্য নিখোঁজ হয়েছিল। অগণিত মানুষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে আ-মৃত্যু পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছিল। যুদ্ধের পর ইউরোপের বিভিন্ন গ্রামে এবং শহরে শত শত পঙ্গু মানুষের ভিড় দেখা যেত, যুদ্ধে জড়িত প্রায় দেশের (আমেরিকা ছাড়া) অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়েছিল। এদের মধ্যে জার্মানির অর্থনীতি সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কারণ জার্মানিকে যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ বিরাট অংকের মুদ্রা বিজয়ী দেশগুলিকে দিতে হয়েছিল। যুদ্ধের সাথে জড়িত সমস্ত দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ অন্যান্য সমস্ত অর্থনৈতিক অবকাঠামোগুলি ভেঙে পড়েছিল। দীর্ঘ চার বৎসর যুদ্ধের ফলে, যুদ্ধে জড়িত সব দেশের জিডিপি শূন্যের কোটায় পৌঁছেছিল। শিল্প এবং কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। যুদ্ধের ফলে জার্মান অর্থনীতি প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে সেন্ট্রাল ইউরোপে প্রায় সব দেশেরই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শূন্যের কোটায় পৌঁছেছিল। জার্মানি-রাশিয়ার এবং অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির শক্তিশালী রাজতন্ত্রের চির অবসান হয়। মোটামুটি ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলিতে রাজতন্ত্রের চির অবসান ঘটে তার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র ইউরোপে শক্তিশালী হয়ে উঠে। পূর্ব ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশগুলিতে প্রজাতন্ত্রী সরকার কায়েম হয়। অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির দ্বৈত রাজতন্ত্রের অবসান হয় এবং দুই রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বলকানে মিত্র শক্তির জয় এবং জার্মানির পরাজয়ের ফলে অষ্ট্রিয়ার পার্লামেন্টে চেকোশ্লোভাকিয়া এবং যুগোশ্লোভাকিয়ার ডেপুটিরা উভয় দেশের স্বাধীনতার জন্য জোর দাবি জানান। ১৯১৮ সালের অক্টোবরের ২৮ তারিখে চেকেশ্লোভাকিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এবং অন্তবর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা দেয়া হয়। কয়েকদিন পর যুগোশ্লোভাকিয়াও স্বাধীনতা লাভ করে। অষ্ট্রিয়াও রাজতন্ত্রের অবসান হয়ে গণতন্ত্র কায়েম হয়।
জার্মানির স¤্রাট কাইজারের পতন ঘটে এবং নেদারল্যান্ডের রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। তুরস্কেও রাজতন্ত্র কায়েম ছিল। রাজা সুলতান এবং খলিফা নামে আখ্যায়িত হত। প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে যোগ দিয়েছিল। কামাল আতার্তুক এর নেতৃত্বে বিপ্লবের মাধ্যমে তুর্কী খোলাফতের অবসান ঘটে এবং তার নেতৃত্বে তুরস্কে গণপ্রজাতন্ত্র কায়েম হয়।
যাই হউক, প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে বিশ^ব্যাপী গণতান্ত্রিক শাসন কয়েমের পথ খুলে গিয়েছিল, এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রথম বিশ^যুদ্ধে মানবজাতি সর্বদিক দিয়ে যে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা ছিল অতীব ভয়াবহ। সবচাইতে দুঃখের বিষয় প্রথম বিশ^যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মাত্র দু’দশক পর, আবার দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের প্রস্তুতি আরম্ভ হয়ে গেল।
আজকে বিশে^র পরাশক্তিগুলি যে সব অস্ত্র উৎপাদন করছে তার বেশির ভাগই হলো পারমাণবিক অস্ত্র। বর্তমানে শুধু যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার কাছে যে পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত রয়েছে তা দিয়ে অনায়াসে বর্তমান পৃথিবীর মতো কয়েকটা পৃথিবী ধ্বংস করা যাবে। কিন্তু তারপরও কোন পরাশক্তি থেমে নেই। নিত্যনূতন আণবিক অস্ত্রের উৎপাদন চলছে এবং সংশ্লিষ্ট পরাশক্তির নেতৃবৃন্দ সাংবাদিক সম্মেলন করে উৎপাদিত অস্ত্রের ধ্বংস ক্ষমতা সংবাদ সম্মেলন মাধ্যমে বিশ^বাসীকে জানিয়ে দিচ্ছে। এই লোকগুলো যে মানবমূল্যবোধ এবং বিবেকশূন্য হয়ে পড়েছে একথাটা অকপটে বলার মত ব্যক্তিত্বের বিশ^ব্যাপী বড় অভাব দেখা দিয়েছে।
১৯৬০ দশকের দিকে সোভিয়েট রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নিখিতা ক্রুশ্চেভ। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর তিনি কৎঁপযবাব জবসবসনবৎং, নামে একটি বই লিখেছেন। সে বইতে তিনি লিখেছেন ঞযবৎব ধৎব ঃযড়ংব যিড় ফড়হ’ঃ ংববস ধনষব ঃড় মবঃ রহঃড় ঃযবরৎ যবধফ ঃযধঃ রহ ঃযব হবীঃ ধিৎ, ারপঃড়ৎ রিষষ নব ৎধৎবষু ফরংঃরহমঁরংযধনষব ভৎড়স ঃযব াধহয়ঁরংযবফ, অ ধিৎ নবঃবিবহ ঝড়াবরঃ টহরড়হ ধহফ ঃযব টহরঃবফ ঝঃধঃব ড়িঁষফ ধষসড়ংঃ ঈবৎঃধরহষু বহফ রহ সঁঃঁধষ ফবভবধঃ. অর্থাৎ ‘কিছু লোকে মাথায় আসেনা যে আগামী যুদ্ধে বিজিত এবং পরাজিতের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবেনা। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে য্দ্ধু সংঘটিত হলে নিশ্চিতভাবে সে যুদ্ধে উভয়ের পরাজয় ঘটবে।’
লেখক : কলামিস্ট