প্রতিরোধ, প্রতিকার এবং শিশুপুষ্টি পরিস্থিতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

127

এখন থেকে চার দশক কিংবা তারও কিছু আগে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে লেগে লাগত ডায়রিয়া। শুধু গ্রামে নয় এই রোগ লেগে থাকত শহরে-গঞ্জের বস্তি এলাকাগুলোতেও। কখনো কখনো ডায়রিয়া কলেরার রূপ নিয়ে মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়ত। কোনো পরিবারের একজন সদস্য আক্রান্ত হলে বাদ বাকি সদস্যদের সুস্থ থাকার কোনো উপায় ছিল না। গ্রামের লোকেরা এই রোগকে ওলাওঠা রোগ বলে অভিহিত করত। গ্রামের অশিক্ষিত, কুসংস্কার আচ্ছন্ন মানুষের ধারণা ছিল ওলাওঠা রোগটি সৃষ্টিকর্তার গজব। আর এই গজব থেকে বাঁচতে তাঁরা ঝাড়ফুঁক, বৈদ্য-কবিরাজের সহায়তা নিত। ঘরদোর, বাড়ি এমনকি পাড়ার চার কোণায় দোয়া-দরুদ লেখা সাদা পতাকা লম্বা খুঁটিতে লাগিয়ে উড়িয়ে দিত। তাঁদের বিশ্বাস ছিল এ পতাকার সুবাদে তাঁদের পরিবারের লোকজন এবং নিজেরা ওলাবিবির নজর থেকে বেঁচে যাবে। তারও আগে আমাদের দেশে গুটি বসন্তে মারা যেত হাজার হাজার লোক।


মাত্র এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুড় (আট চা চামচ চিনি) আর ২ পোয়া পানির বিস্ময়কর কারিশমা মানুষ যখন জানল কিংবা তাঁদের জানানো হলো তখন থেকে মানুষ বেরিয়ে আসল অন্ধকার থেকে আলোয়। কিছু কিছু রোগ সৃষ্টি কিংবা ছড়িয়ে পড়ার জন্য যে মানুষ নিজেরাই দায়ি যখন তা বুঝতে পারল তখন তাঁরা সচেতন হয়ে উঠল। খাবার স্যালাইন তৈরির সহজ নিয়ম যেদিন থেকে গ্রাম বাংলার মানুষ জানল সেদিন থেকে কমা শুরু হলো ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার। সে সঙ্গে মানুষ জানতে পারল ডায়রিয়ার কারণ, কিভাবে ছড়ায়, নিরাপদ পানির উৎস ইত্যাদি বিষয়। নিরাপদ পানির উৎস এবং ডায়রিয়ার কারণ সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে ডায়রিয়ার প্রতিরোধের উপায় এসে গেল মানুষের হাতের মুঠোয়। এরপর প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যশিক্ষার সুবাদে মানুষ একে একে জানতে পারল ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচতে হলে কি করতে হবে? ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী মশা প্রতিরোধে ডিডিটি স্প্রে এবং ওষুধ মিশ্রিত মশারী ব্যবহারের ফলে কমে আসল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের হার। শিশুদের সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচাতে হলে কি করতে হবে ইত্যাদি বিষয়।
ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, য²াসহ নানা প্রতিরোধযোগ্য রোগ থেকে মানুষের একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেল ঢ়ৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ পঁৎব. অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। আমরা যদি রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে রোগের উৎসমূলে আঘাত হানতে পারি সেটাই হয় অনেক বেশি সহজ ও সুফলযোগ্য। যেমন হয়েছে বসন্ত নির্মূলের ক্ষেত্রে, ম্যালেরিয়া উচ্ছেদ অভিযানের ক্ষেত্রে, ডায়রিয়া, য²াসহ পানিবাহিত, বায়ুবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে। স¤প্রাসারিত টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর উপর্যুক্ত বাক্যটি উন্নীত হলো প্রবাদে। কারণ এ কর্মসূচির অভাবিত সাফল্যে শিশু ও মাতৃমৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসল। কমে আসল ঐ সব রোগে মৃত্যুর হার। সচিত্র বাংলাদেশ জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সরকারের সাফল্যের ৮ বছর’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে মাতৃমৃত্যু হার প্রতি লক্ষ জীবিত জন্মে ২০১৭ সালের ১৯৪ থেকে কমে বর্তমানে ১৭০-এ নেমে এসেছে। অর্থাৎ ২০১০ সালে যেখানে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ১.৯৪ জন মায়ের মৃত্যু হতো সেখানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৭-এ। একইভাবে শিশুমৃত্যুর হারও হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ৫ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যু ২০১০ সালে যেখানে ছিল প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ৬৫ বর্তমানে তা ৩৬। সবচেয়ে বড় কথা হলো শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসে যুগান্তকারী সাফল্যের জন্য ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্জন করেছেন ‘ সাউথ সাউথ পুরস্কার’। শুধু তাই নয় মা ও শিশুর ধনুষ্টংকার প্রতিরোধে সরকার অর্জন করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সনদ। প্রতিরোধযোগ্য রোগে সাফল্য এখানেই থেমে থাকেনি। বাংলাদেশ ২০১৪ সালে অর্জন করেছে পোলিওমুক্ত দেশ হিসেবে পোলিও নির্মূল সংক্রান্ত সার্টিফিকেট। প্রতিরোধ পর্যায়ে সরকারের একের পর এক সাফল্যে সরকার স¤প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে যোগ করেছে আরও ৩টি নতুন টিকা।
সরকারের তৃণমূল পর্যায়ে কর্মরত স্বাস্থ্য সহকারী (ঐ.অ.) পরিবার কল্যাণ সহকারী (ঋ.ড.অ).এবং সর্বশেষ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো এ ব্যাপারে রেখে চলেছে মূল্যবান ভূমিকা। এসব তৃণমূল স্বাস্থ্যসৈনিকদের নিরলস শ্রম আর আন্তরিক প্রয়াসের ফলেই দেশ থেকে বসন্ত নির্মূল হয়েছে। ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। য²া ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং দেশ হয়েছে পোলিওমুক্ত। এসব সাফল্যের ধারাবাহিকতায় সরকারের তৃণমূল পর্যায়ে কর্মরত স্বাস্থ্য সৈনিকেরা পুষ্টির অভাবজনিত রোগ সমূহ প্রতিরোধে রাখতে পারে বিশেষ ভূমিকা। কেননা রোগ হওয়ার আগেই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যুহ তৈরিতে এসব তৃণমূলের স্বাস্থ্য কর্মীরা ইতিমধ্যেই তাঁদের শক্তি, সামর্থ্য ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
স¤প্রতি ইউনিসেফের বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতি সম্পর্কে যে সব বিষয় উঠে এসেছে তা শুধুমাত্র স্বাস্থ্য শিক্ষার মতো প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদারকরণের মাধ্যমে অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব বলে আমাদের ধারণা। ইউনিসেফের রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে ২৮ শতাংশ শিশু প্রয়োজনের চেয়ে কম ওজন নিয়ে জন্মায়। ৪৯ শতাংশ শিশুকে ঠিক সময়ে শালদুধ দেওয়া হচ্ছে না। ছয় মাসের কম বয়সী ৫৫ শতাংশ শিশু শুধু বুকের দুধ খায়। অর্থাৎ এই বয়সী শিশুদের ৪৫ শতাংশ শিশু পুষ্টিসমৃদ্ধ এই খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কেন এমনটা হচ্ছে এ ব্যাপারে ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বায়ন, নগরায়ণ, বৈষম্য, মানবিক সংকট —এসবই শিশুপুষ্টিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।”(প্রথম আলো, ১৯/১০/২০১৯)।
আমরা জানি, আমাদের দেশে দরিদ্রতম শিশুদের অধিকাংশই বস্তি এলাকায় থাকে। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে বন্যা ও নদী ভাঙনে উদ্বাস্তু হওয়া শিশু। এ বস্তিবাসী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির ঝুঁকি বেশি। শিক্ষা, সচেতনতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা প্রভৃতি কারণে অন্য দশটা শিশুর মতো এরা বেড়ে উঠতে পারে না। এদের মা-বাবারা থাকে খেটে খাওয়া মানুষ। অনেকের অবস্থা হয় নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। ফলে এরা না পারে নিজেদের পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে, না পারে শিশু ও শিশুর মায়েদের প্রতি যতœবান হতে। বস্তি এলাকার বাইরে দেশের পশ্চাৎপদ অনেক এলাকায় অজ্ঞতার কারণে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের প্রতি যথাযথ যতœ নেয়া হয় না। পাশাপাশি অনেক কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবার গর্ভবতী নারীদের বাড়তি খাবার দেওয়ার বদলে খাওয়া দাওয়া ব্যাপারে নানা নিয়ম আরোপ করেন। ফলে পুষ্টির অভাবে ঐ সব নারীরা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দিয়ে থাকেন —যে সব শিশুদের অধিকাংশই কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
ইউনিসেফের রিপোর্টে বাংলাদেশের শিশুপুষ্টি পরিস্থিতি ওপর প্রতিবেদনে যে তিনটা বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, তাহলো কম ওজনের শিশু, সঠিক সময়ে শিশুকে শালদুধ না খাওয়ানো এবং শিশুকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাইয়ে না যাওয়া। স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ের যে জনবল আছে তাঁদের দীর্ঘদিনের কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে মিডিয়া ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রয়াসে এবং দেশের সচেতন নাগরিকদের সহযোগিতায় এ পরিস্থিতির ক্রমান্বয়ে উন্নতি সম্ভব বলে আমরা মনে করি। এজন্য প্রয়োজন আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ, উঠান সভাসহ স্বাস্থ্যশিক্ষার সবগুলো মাধ্যমের যথাযথ প্রয়োগ ও ব্যবহার। যার মাধ্যমে একজন গর্ভবতী মহিলা জানতে পারবেন কেন কম ওজনের শিশুর জন্ম হয়। একজন অভিভাবক জানতে আগ্রহী হবেন কেন তাঁদের গর্ভবতী মেয়েটির বাড়তি পরিচর্যা প্রয়োজন। শালদুধ কেন খাওয়াবেন, এর উপকারিতাই বা কি? কেন একটি শিশুকে ৬ মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
আসুন আমরা গুটিবসন্ত নির্মূলে যেমন ভূমিকা রেখেছি, ডায়রিয়া প্রতিরোধে যেভাবে খাবার স্যালাইনের কথা বলেছি, দেশকে পোলিওমক্ত করতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছি, টিকা দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য রোগের বিরুদ্ধে টিকাদান কর্মসূচিতে যেভাবে অবদান রেখেছি, ঠিক সেভাবে সরকারের তৃণমূলের স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে আরেকবার নেমে পড়ি সুস্থ, সবল আগামীর জন্যে। সরকারের সঙ্গে সচেতন জনগোষ্ঠী যখন কোনো কল্যাণকর কাজে সম্পৃক্ত হয় তখন তার গতি বেড়ে যায় বহুগুণ। বাংলাদেশে শিশুপুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে এ মুহূর্তে বড় প্রয়োজন আন্তঃব্যক্তিক, উঠোন সভা, ইপিআই আউটরিচ কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্য শিক্ষা জোরদারকরণ।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক