প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ৮০ রোহিঙ্গা শিশু

37

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ভয়ে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় হয়েছে উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থীক্যাম্পে। এখানে প্রতিদিন ৮০টি শিশুর জন্ম হচ্ছে। গত ২০ মাসে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া বর্তমানে ২০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী সন্তানসম্ভবা। ফলে আগামী এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে বিভিন্ন সংস্থার সূত্রে জানা গেছে। তবে এ নিয়ে সরকারি সংস্থার মতবিরোধ থাকলেও স্থানীয় সুশীল সমাজ, সচেতন মহলের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সরকারের দ্রæত পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা বলেছেন, এর আগে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নিবন্ধনভুক্ত চার লাখ রোহিঙ্গা পরিবারে আরও এক লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে। এছাড়া ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে যে সাত লাখ রোহিঙ্গা এসেছে এদের মধ্যেও ২ লাখ ৪০ হাজার শিশু-কিশোর রয়েছে।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, প্রত্যাবাসনকাল বেশি দীর্ঘ হলে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশু ও এখানে বড় হওয়া শিশু-কিশোরদের নাগরিকত্ব নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে।
পরিকল্পিত উখিয়া চাই’য়ের আহবায়ক, সাংবাদিক নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেছেন, কিছু এনজিও সংস্থা রোহিঙ্গা শিশুদের এবং মায়েদের জন্য সামান্য পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে তাদের সন্তান প্রসবে উৎসাহিত করছে। তারা মনে করছে, সন্তান হলেই তার জন্য আলাদা ভরণপোষণ পাওয়া যাবে। তাই ত্রাণের আশায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশু জন্মের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও তারা সেটি মানছে না।
আরও একটি বিষয় আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা হলো বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এবং এখানে শিশু-কিশোর বয়স থেকে বেড়ে ওঠা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে কি না? সবকিছু মিলিয়ে অধিক হারে রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম নিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
রোহিঙ্গা শিশুদের নাগরিকত্ব বিষয়ে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের জন্মসূত্রে বাংলাদেশি বলা যাবে না। আর সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। বিষয়টি সরকারের রোহিঙ্গা বিষয়ক নীতির ওপর নির্ভর করছে।
অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দ্রæত দিক-নির্দেশনা দেওয়া উচিত। এখন যেমন প্রাপ্তবয়স্কদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে, সেভাবে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া শিশুদেরও নিবন্ধন করা হবে কি না সে বিষয়ে সরকারকে দ্রæত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাবা-মা রোহিঙ্গা হওয়ায় এ দেশে জন্ম নেওয়া তাদের শিশুরাও স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা বা মিয়ানমারের নাগরিক বলে বিবেচিত হবে। তারা এ দেশে জন্ম নেওয়ার সুবাদে জন্মসূত্রে বাংলাদেশি হবে না। তবে বর্তমান পরিস্থিতি একটু অন্যরকম। তারা এখানে অস্থায়ীভাবে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যদি কোন কারণে তাদের এই দেশে থেকে যেতেই হয়, তাহলে সেটা অনেক পরের বিষয়। এছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে যদি কখনো এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, তাহলে এসব শিশুর বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে, তা গুরুত্ব দিতে হবে। আবার যেসব শিশু বাবা-মা ছাড়া আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে এসেছে, তাদের কে গ্রহণ করবে, এসব বিষয়ও আলোচনায় থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত মনে হয়, এই শিশুদের রোহিঙ্গা বা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই দেখা হবে।
তিনি বলেন, যেসব শিশু বাংলাদেশে জন্ম নিচ্ছে, তাদের তালিকা তৈরি করা উচিত। নাগরিকত্ব নিয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত সেই তালিকা যেন বাংলাদেশের কাছে থাকে। এসব শিশুর জন্ম তারিখ, বøাড গ্রæপ চেক করে রাখাসহ প্রয়োজনে তথ্য থাকা উচিত।
উখিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান (বর্তমানে ছুটিতে) বলেন, একটি ক্রাইটেরিয়া ছিল জন্ম নিবন্ধনের সার্টিফিকেটে একটি সিল থাকবে, সেখানে লেখা থাকবে তারা মিয়ানমারের নাগরিক। ওই জন্ম নিবন্ধনের কাজটাও চলছিল শুধু নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের জন্য। কিন্তু এই নিবন্ধিতদের বাইরেও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ছিল, যাদের বিষয়ে সরকারের কোন সিদ্ধান্ত ছিল না। এবার এই রোহিঙ্গা আসার পর থেকে কক্সবাজারের পুরো জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়াটাই বন্ধ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করছি আগে। এরপর সরকার যেভাবে নির্দেশনা দেবে, সেভাবেই কাজ হবে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের জন্ম নিবন্ধনের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো ইনস্ট্রাকশন নেই।
রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রæপ (আইএসসিজি) এর দেওয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ নারী। এদের মধ্যে ১৩ শতাংশ কিশোরী এবং ২১ শতাংশ গর্ভবতী ও প্রসূতি। শিশুদের মধ্যে ৬-১৮ বছর বয়সী শিশুর হার ২৩ শতাংশ, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর হার ২১ শতাংশ এবং ১ বছরের কম বয়সের শিশুর হার ৭ শতাংশ।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আব্দুল মান্নান জানান, রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসে, তখন প্রথম তিন মাসে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৪৮০ জন গর্ভবতী নারীর। তার মধ্যে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব হয় সাড়ে পাঁচ হাজার শিশু আর বাকিগুলো হোম ডেলিভারি হয়। সেই হিসেবে লক্ষাধিক শিশুর জন্ম নিয়েছে প্রশ্ন রয়েছে। তাই এ নিয়ে নতুন করে সার্ভে করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এ ব্যাপারে সোমবার কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, ২০১৭ সালের আগস্টের পর থেকে পরবর্তী ২০ মাসে নবজাতকের সংখ্যা আমাদের হিসেব মতে লক্ষাধিক হয় না, কিন্তু বিভিন্ন জরিপ সংস্থা কিভাবে এক লাখ বলতেছে সে ব্যাপারে আমার কিছুই বলতে পারতেছি না।
তিনি বলেন, আমাদের ২শতাধিক কর্মী সপ্তাহে ২দিন করে উখিয়া-টেকনাফে কাজ করতেছে। বেশ কিছু সময় আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করার পর অনেক সচেতন হয়েছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। আমরা এ পর্যন্ত ৭২ হাজার নারীকে ইনজেকশন দিয়েছি, ৭৬ হাজার নারীকে জন্মনিয়ন্ত্রন ওষুধ দিয়েছি। এছাড়া তিন বছর মেয়াদি ২ হাজার ৪৯১ জন আর ১০ বছর মেয়াদি ইনজেকশন দিয়েছি ২১শ জনকে।
ক্যাম্পের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্ত বলেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সদ্য সন্তান প্রসব করবে এমন নারীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। রোহিঙ্গাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা না গেলে তা বাংলাদেশের জন্য নতুন ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে।