প্রতারণার ভয়ঙ্কর বিস্তার

54

কোথাও যেন আর ঝুঁকিহীন ও নিরাপদ নয়। আদালতপাড়া থেকে সরকারি কিংবা বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান- সর্বত্র নিজেদের জাল বিস্তার করে ওঁৎ পেতে বসে আছে ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্র। চাকরি- সেবা ও প্রতিকার চাইতে গিয়েই এসব চক্রের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। লাগাম টানায় ঢিলেমির সুযোগে নানা খাতে রীতিমত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে প্রতারকচক্র। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর অভিযোগ সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টিগোচরে আসার পর প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
অতিসাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশসহ জেলা আইনজীবী সমিতি চাঞ্চল্যকর প্রতারণার কয়েকট ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও জড়িত প্রতারকচক্রের কয়েকজনকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে। এদের প্রতারণার ধরন ও কাহিনী রীতিমত পিলে চমকানো। তবে তাদের সহযোগী অনেকেই এখনও নিজেদেরকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। র‌্যাব ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, চক্রের বাকি সদস্যদেরও আইনের আওতায় আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
একই অঙ্গে এত রূপ!ঃ র‌্যাব-৭ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. মাহমুদুল হাসান মামুন জানান, গত ২৬ সেপ্টেম্বর নগরীর পাহাড়তলী থানাধীন ডিটি রোড এলাকায় ঢাকা ভবনের (ইউনিয়ন ব্যাংক ভবন) দশম তলায় ভুয়া এনজিও সংস্থার একটি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে পারভীন আক্তার (৫০) নামে বহুরূপী এক নারী প্রতারক আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে দশটিরও বেশি প্রতারণার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন দুয়েকবার। এরপরও তিনি মোটেই দমে যান নি। বরং তিনি নিজেকে কখনও ম্যাজিস্ট্রেট, কখনও ভোক্তা অধিকারের সহকারী পরিচালক, কখনওবা ক্যাব সভাপতি, আবার কখনও মানবাধিকার কর্মীসহ নানা পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছিলেন। এছাড়াও তিনি কখনও নিজেকে সাংবাদিক কিংবা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী, পরিবেশবিদ, এনজিও বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী, দেশি-বিদেশি নিয়োগকারী সংস্থার মহাব্যবস্থাপকের ভুয়া পরিচয় দিয়েও নগরীর বিভিন্নজনের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তার স্বামী সৈয়দ মিজান উল্লাহ সমরকন্দিও তার অন্যতম সহযোগী। তিনি পলাতক রয়েছেন। এসব ভুয়া পরিচয় দিয়ে সুযোগ পেলেই বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করতেন।
আড়াই দশকের ভুয়া আইনজীবী! ঃ দুয়েক বছর নয়, টানা ২৫ বছর ধরে চট্টগ্রাম আদালতে নিজেকে আইনজীবী পরিচয়ে কাজ করে আসছিলেন রতন কুমার দাশ নামে এক ব্যক্তি। আইনজীবী হিসেবে নিজের পরিচিতি নম্বর ব্যবহার করতেন ৭১৪। যদিও এই ৭১৪ পরিচিতি নম্বর রতন কান্তি নাথ নামে আরেকজন আইনজীবীর। আইনজীবী বলে পরিচয় দেয়ার পাশাপাশি নিজেকে একটি মানবাধিকার সংগঠনের চেয়ারম্যান বলেও দাবি করতেন রতন। এছাড়া, ‘আইন কণ্ঠ’ নামে একটি পত্রিকায় কাজ করেন বলেও প্রচার চালাতেন। এসব ভুয়া পরিচরে আড়ালে মূলতঃ আদালতে আইনগত সেবা নিতে আসা বিচারপ্রার্থী লোকজনের সাথে প্রতারণা করতেন তিনি। নিজেকে আইনজীবী হিসেবে তুলে ধরে ছাপিয়েছেন ভিজিটিং কার্ডও। দীর্ঘদিন আইনজীবী ভবন এনেক্স- ওয়ানের ৭১২ নম্বর চেম্বারে বসে চালিয়ে গেছেন প্রতারণার কারবার। গত ৩০ আগস্ট জেলা আইনজীবী সমিতির ‘টাউট উচ্ছেদ কমিটি’ তার প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হয়ে আটক করার পর ঠিকানা হয়েছে হাজতখানা। সমিতির এজিএস বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে থানায় প্রতারণার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন।
সরকারি চাকরি পাইয়ে দেয়ার নাম করে প্রতারণা ঃ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরি পাইয়ে দেয়ার নাম করে অর্ধকোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর নগরীর চান্দগাঁও এলাকা থেকে মো. ইব্রাহীম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবি’র বন্দর অঞ্চলের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আবু বকর সিদ্দিক জানান, গ্রেপ্তার হওয়া ইব্রাহীমের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ প্রতরক চক্র রয়েছে। তারা বেকার কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত যুবকদের টার্গেট করে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে আকর্ষণীয় পদে চাকরি পাইয়ে দেয়ার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নেয়। চক্রটি এরইমধ্যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও কক্সবাজার এলাকার বেশ কয়েকজন যুবকের কাছ থেকে সরকারি চাকরির পাইয়ে দেয়ার নাম করে কমপক্ষে ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
গ্রেপ্তার ইব্রাহীমের প্রতারণা কৌশলের বিবরণ দিয়ে ডিবি কর্মকর্তা জানান, নগরীতে অবস্থিত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নিজাম নামের এক যুবকের সাথে ২০১৮ সালে ইব্রাহীমের পরিচয় হয়। গত বছরের প্রথমদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘অডিট অফিসার’ পদে নিয়োগ পাইয়ে দেয়ার নাম করে তার কাছ থেকে ১৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন গ্রেপ্তার ইব্রাহীম। প্রতারণার কৌশল হিসেবে প্রথমে নিজামের ঠিকানায় একটি ভুয়া ইন্টারভিউ কার্ড পাঠানো হয়। সেটি হাতে পাওয়ার পর নিজাম তা নিয়ে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ঢাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে যান। সেখানে থাকাবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘এইচআর এডমিন’ পরিচয় দিয়ে এক নারী নিজামকে ফোন করে তার পরীক্ষা হবে না এবং নিয়োগটি বিশেষভাবে হয়ে যাবে জানিয়ে তাকে চট্টগ্রামে ফিরে যেতে বলেন। এর কিছুদিন পর নিজাম বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নিয়োগপত্র হাতে পান। সেটি নিয়ে ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে যোগদান করতে গিয়েই জানতে পারেন যে আসলে নিয়োগপত্রটি ভুয়া। পরবর্তীতে নিজাম চাকরির আশায় ইব্রাহীমের হাতে তুলে দেয়া টাকা ফেরত চাইলে তিনি টালবাহানা শুরু করেন। প্রতারণার শিকার হওয়া নিজাম অবশেষে নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে হাজির হয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে ইব্রাহীমকে চান্দগাঁও এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে এভাবে সরকারি চাকরি দেয়ার নাম করে বিভিন্নজনের কাছ থেকে কমপক্ষে ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আখতার কবির চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রতারকের সাথে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর কিংবা বিচারাঙ্গনের কারও না কারও সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আড়ালে থাকা ব্যক্তির প্রশ্রয়েই প্রতারক চক্রের সদস্যরা একের পর এক প্রতারণা করেও পার পেয়ে যাওয়ায় এক পর্যায়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাই প্রতারণার মূলোৎপাঠনে অপকর্মের সাথে সম্পৃক্ত সকলকেই আইনের আওতায় আনতে হবে।’