প্রগতির মশাল জ্বেলে তোমরা এগিয়ে যাবে

37

ডাকসু নেতাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আমাদের এগুতে হবে, লাখো শহীদের বিনিময়ে অর্জিত দেশকে গড়তে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এদেশ গড়ে উঠবে, এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই তোমাদের চলতে হবে। প্রগতির মশাল জে¦লে শান্তির পথ ধরে তোমরা এগিয়ে যাবে, এটাই আমি চাই।’
শনিবার গণভবনে সদ্য বিজয়ী ডাকসু ও হল সংসদে বিজয়ী নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রী তাদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন। এসময় প্রধানমন্ত্রীর ডানপাশে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর এবং বাম পাশে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন উপস্থিত ছিলেন। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতার শুরুতে স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই স্কুল ছিল তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের বক্তৃতা শুনতে স্কুল ফাঁকি দিয়ে সেখানে চলে যেতেন তারা। পরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু আন্দোলন ও ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এসময় তিনি নব নির্বাচিত ডাকসু ও হল সংসদ নেতাদের বিজয়ী হওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান। একইসঙ্গে বিজয়ীদের সিংহভাগ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বহুমুখী বিশ্ববিদ্যালয় করেছি। আমরা দেশের প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় করেছি। প্রত্যেক বিভাগে এমন বিশ্ববিদ্যালয় আমরা করে দেবো।’
ডাকসুর নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরা দেখবা, আমরা কত ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছি যাতে শিক্ষার্থীরা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও কাজ পায়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। তার জন্যও আমাদের শিক্ষিত তরুণ দরকার। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমার লোক দরকার। একশ’ অর্থনৈতিক অঞ্চল করবো আমরা, তার জন্য লোক দরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগ এসেছে, তা দিয়ে বিভিন্ন কিছু তৈরি হবে, তার জন্যও আমার উপযুক্ত লোক দরকার।’
তিনি বলেন, আমি সরকারে এসে বেসরকারি খাতকে এমনভাবে উন্মুক্ত করে দিয়েছি, যাতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, চাকরির সুযোগ তৈরি হয়। এত খাত অতীতে কেউ উন্মুক্ত করেনি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘পড়াশুনার পাশাপাশি আমাদের সংস্কৃতি চর্চা, খেলাধুলা-এসব দিকেও মনোযোগ থাকতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ওয়াই-ফাইসহ বিভিন্ন ডিজিটাল সার্ভিসের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আগামীতে হলেও ওয়াই-ফাইয়ের ব্যবস্থা করবো।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটা উন্নত করা উচিত। বর্তমান লাইব্রেরিটা কত বছর আগের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিকে ডিজিটালাইজড করে দেওয়া হবে। পাশপাশি পাবলিক লাইব্রেরিও উন্নত করা হবে।’
ডাকসু নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমাদের দেওয়া বক্তব্য থেকে আমি কিছু বিষয় নোট করেছি; লিফটের ব্যবস্থা করবো, পাশাপাশি জরাজীর্ণ ফ্যান পাল্টে নতুন ফ্যানের ব্যবস্থা হবে। এজন্য আমি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসবো।’
৭৫ এর হত্যাকান্ডের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘‘একটা সময় আমি অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশে ফিরেছিলাম। এইবার নিয়ে আমি চতুর্থবার ক্ষমতায়, এটা ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুসহ আমার পরিবারের অন্যদের হত্যাকারীদের জন্য মোটেই সুখকর নয়। ’৭৫ এর পরে আমি যেদিন বাংলাদেশে পা রাখি, সেদিন থেকেই আমি জানি, যেকোনও দিন আমাকেও মেরে ফেলতে পারে। যেহেতু আমার কাছে জীবনের কোনও মায়াও নেই, সেকারণে আমার কোনও ভয়-ডরও নেই। সব হারিয়েছি, হারাবারও কিছু নেই, পাওয়ারও কিছু নাই, সেক্ষেত্রে দেশকে কতটুকু দিয়ে যেতে পারি, এই হিসাবটাই আমি করি।’
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি গোয়ান্দা সংস্থার যে রিপোর্টটা, যা সিক্রেট ডক্যুমেন্ট, এটা কিন্তু প্রথমবার সরকারে এসে আমি সংগ্রহ করেছিলাম। তারপর এটা নিয়ে প্রায় দীর্ঘ ২০ বছর আমি কাজ করি, আমার বান্ধবী বেবী মওদুদকে নিয়ে কাজ করেছি। এ নিয়ে আমরা দুই খন্ডে বই বের করেছি। একজন নেতার বিরুদ্ধে একটা গোয়েন্দা সংস্থা এতো রিপোর্ট দিয়েছে, যাতে ৪০ হাজার পৃষ্ঠা। সেইসব রিপোর্ট দিয়ে বই করে দিচ্ছি, সেখানে তোমরা দেখতে পাবে যে, ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত কীভাবে তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। এদেশ স্বাধীন করতে একটা মানুষ সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন, অনেক মানুষ জীবন দিয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগ আমরা বৃথা যেতে দিতে পারি না।’
সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে ছাত্রসমাজেরও দায়িত্ব রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের তো সময় শেষ। আমার ৭২ বছর বয়স। কাজেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিকল্পনা দরকার, আমরা কিন্তু সেটাও করেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ডেল্টা প্ল্যানসহ আরও নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। সেগুলো তোমাদেরই বাস্তবায়ন করতে হবে। আজ তোমরা যারা এখানে এসেছো, তোমরা কিন্তু নির্বাচিত হয়েই এসেছো। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে তোমরা কী দিবা, এসব শিক্ষা নেওয়ার সময় এখন তোমাদের।’
ডাকসু নেতাদের তিনি বলেন, ‘দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার শিক্ষাগ্রহণের অংশ হিসেবে দেশকে ভালোবাসতে হবে, মানুষকে ভালোবাসবে, দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া ভুলে কাজ করতে পারলে, তোমরা একদিন সফল নেতা হবা-এটাই জাতির পিতার শিক্ষা, সেই শিক্ষাই তোমাদের নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখবে, আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, আমরাই কিন্তু দেশের কল্যাণে কাজ করি; অন্যেরা যারা উড়ে এসে জুড়ে বসে ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা কিন্তু দেশকে ভালোবাসেনি, দেশের কল্যাণে কাজ করেনি।’
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে উন্নতি হয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘আর কেউ ক্ষমতায় আসলে এতো উন্নতি হয় না। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েই আমাদের এগুতে হবে, লাখো শহীদের বিনিময়ে অর্জিত দেশকে গড়তে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এদেশ গড়ে উঠবে, এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই তোমাদের চলতে হবে। প্রগতির মশাল জ্বেলে শান্তির পথ ধরে তোমরা এগিয়ে যাবে, এটাই আমি চাই।’
‘সাহস থাকা ভালো, তবে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকাটাও জরুরি’
কোটা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলার রাতে বড় কোনও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যেতে পারতো জানিয়ে যেকোনও আন্দোলনে সতর্ক থাকার আহবান রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সাহস থাকা ভালো, তবে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকাটাও জরুরি।’
শনিবার গণভবনে ডাকসু ও হল সংসদে বিজয়ীদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রী তাদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
কোটা আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা বিষয় আমাকে খুবই ব্যথিত করে। আর তা হলো-কোটা আন্দোলনের সময় ভিসির বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর। ভিসির বাড়িতে ঢুকে লুটপাট, ভাঙচুর, আগুন দেওয়া, ভিসির ওপর হামলা-এসব কিন্তু কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।’
তিনি বলেন, ‘আন্দোলন আমরাও করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাড়িতে অবস্থান ধর্মঘট হয়েছে। খুব বেশি হলে বাড়ির সামনে কয়েকটা ফুলের টবই ভাঙা হতো। কিন্তু কোনোদিনই ভিসির বাড়িতে ঢুকে আগুন দেওয়া বা এ ধরনের ঘটনা কখনও ঘটেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভিসির বাসভবনে হামলার রাতে যখন ছাত্রীরাও হল থেকে বের হয়ে আসলো, আমি পরে আর ঘুমাতে পারিনি। কারণ, কিছু ওঁৎ পেতে থাকা লোক এসব আন্দোলনে মিশে যায়। স্বাভাবিকভাবে একটা উদ্বেগ কাজ করেছে মনে। ওই রাতে যদি একটা ছেলে বা একটা মেয়ের ক্ষতি হতো, যারা আন্দোলনে ছিল তারা কী প্রটেকশন দিতে পারতো। এসব ভেবে আমি আমাদের নেতাদের বিষয়টি দেখার নির্দেশ দিই। পরে ডিএমপি কমিশনার যখন সকাল ৬টার দিকে জানালেন, মেয়েরা নিরাপদে হলে ফিরেছে, তখন আমি বিশ্রাম নিতে যাই। তাই আমি তোমাদের বলবো, সাহস থাকা ভালো, তবে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকাটাও জরুরি। একটা ঘটনা বা দুর্ঘটনা আরও অনেক সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোটা আন্দোলনের পরপরই দেশজুড়ে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন শুরু হয়। পরে এ আন্দোলনেও সুযোগ সন্ধানীরা ঢুকে পড়ে। তবে ওই সময় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ঘরে ফেরার আহবান জানালে তারা ঘরে ফিরে যায়।’
ডাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি আমি সবসময় একটা বিষয় সংশ্লিষ্ট সবাইকেই বলেছি, ডাকসু নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়। এখানে যেন বোমা বা গুলির আওয়াজের কোনও ঘটনা না ঘটে, এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কে ভোট পেলো, আর কে পেলো না-এটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি শুধু একটা সুষ্ঠু ভোট দেখতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী জয়লাভ করেনি। ও যখন আমার কাছে এসেছে আমি তাকে বলেছি, যে জিতেছে তাকে অভিনন্দন জানাও এবং তার সব কাজে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দাও। আমি ধন্যবাদ জানাই শোভনকে, বলার সাথে সাথে সে তা করেছে।’