প্রকল্প ব্যয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

84

জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আরো একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমদানিকৃত ক্রুড ও রিফাইন্ড অয়েল গভীর সমুদ্রে জাহাজ থেকে খালাস করে চট্টগ্রামের প্রধান ডিপোতে নিয়ে আসার জন্য প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্প। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।
বিপিসি জানিয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জ্বালানি পরিবহনে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি ১০ দিনের পরিবর্তে দুই দিনে খালাস করা সম্ভব হবে ক্রুড অয়েলের জাহাজ। ইতোমধ্যে মহেশখালীস্থ প্রকল্প এলাকায় কনস্ট্রাকশন ক্যাম্পের কাজ চলছে। প্রকল্পের মালামাল আনলোডিংয়ের জন্য দুটি জেটি নির্মাণ কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। মহেশখালীর উপকূলে প্রকল্প এলাকায় চলছে ক্রুড অয়েল মজুদের ট্যাংক নির্মাণে ভূমি উন্নয়ন কাজও। নির্মিতব্য পাইপলাইনের জন্য প্রথম ব্যাচের প্রায় দুই কিলোমিটার পাইপ চট্টগ্রাম বন্দরে চলে এসেছে।
সূত্র জানায়, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল) প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা বার্ষিক ১৫ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমান নির্মাণাধীন ইউনিট টু প্রকল্প চালু হলে ইআরএলের ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা প্রতি বছর ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে।
অন্যদিকে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রতি বছর ৩ মিলিয়ন মেট্রিকটন এইচএসডি আমদানি করা প্রয়োজন। বঙ্গোপসাগরের কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্যতা ৮ থেকে ১৪ মিটারের নীচে হওয়াতে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে ক্রুড অয়েলবাহী বড় ভ্যাসেল হ্যান্ডেল করতে পারে না চট্টগ্রাম বন্দর। যে কারণে ক্রুড অয়েলবাহী মাদার (বড়) ভ্যাসেলগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করা হয়। মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ করে ক্রুড আনলোডিং করা হয়। লাইটারেজ অপারেশনের মাধ্যমে ক্রুড আনলোড করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। মূলত ব্যয় ও সময় বাঁচানোর পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তা বাড়াতে এসপিএম নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
সূত্র আরো জানায়, ২০১০ সালে ইআরএল এর মাধ্যমে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিপিসি। ওই সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৫৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তন্মধ্যে সরকারি তহবিলের ৪৭ কোটি ৮২ লাখ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) ঋণ ৯০৪ কোটি ৪১ লাখ এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার ২ কোটি ৫ লাখ টাকা অর্থায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব ২০১৫ বছরের ৬ মার্চ পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।
এতে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ২৪৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তন্মধ্যে সরকারি তহবিলের ৮০২ কোটি ৭৮ লাখ, বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৩ হাজার ৩শ কোটি এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ১৪০ কোটি টাকা অর্থায়নের প্রস্তাব করা হয়। বৈদেশিক সহায়তার অংশে আইডিবি থেকে ইতিমধ্যে গৃহীত ঋণের ৩৪ কোটি ২৫ লাখ এবং অবশিষ্ট অর্থ চায়না এক্সিম ব্যাংক হতে ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়। পরে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে আইডিবির ঋণ সীমা অতিক্রম করায় এবং প্রকল্পের ডিজাইনে ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ার কারণে আইডিবি সংশোধিত প্রকল্পের অর্থায়নে অপারগতা জানায়।
এ প্রেক্ষিতে প্রকল্পের ব্যয় ৩৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্পটির ব্যয় যৌক্তিকীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে ২০১৫ সালের ২৪ আগস্ট পরিকল্পনামন্ত্রীর নির্দেশে পুরোনো প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করে নতুন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করে জ্বালানি বিভাগ। সে অনুযায়ী প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে ‘ইনস্টেলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ রাখা হয়। নতুন ডিপিপিতে ১১০ কিলোমিটার ডাবল পাইপলাইন যুক্ত করে প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় জ্বালানি বিভাগ। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ২৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকার প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন পায়।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ব্যুরো’র (সিপিপিবি) সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৮ সালের ১৪ মে থেকে চুক্তিটি কার্যকর হয়। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বিপিসি’র বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- প্রকল্পের অফশোর ও অনসোর সার্ভে কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন কাজ শুরুর জন্য গত বছরের ৩০ আগস্ট ঠিকাদারকে নোটিশ ইস্যু করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ওই তারিখ থেকে ৩৬ মাসের মধ্যে প্রকল্পে সমস্ত কার্যাবলী সম্পন্ন করার কথা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পে এসপিএম নির্মাণের পাশাপাশি মহেশখালীর মাতারবাড়ি উপকূলে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ক্রুড অয়েল স্টোরেজ এবং ৩০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি রিফাইন্ড অয়েল স্টোরেজ নির্মাণ করা হবে। তাছাড়া এসপিএম থেকে মাতারবাড়ির উপকূলে নির্মিত স্টোরেজ পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দুটি সাব-সী পাইপলাইন এবং স্টোরেজ থেকে পতেঙ্গাস্থ গুপ্তখাল পর্যন্ত ৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। এর বাইরেও মহেশখালীতে পাম্প স্টেশন স্থাপন, স্কাডা সিস্টেম স্থাপন এবং ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম তৈরি করা হবে।
বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোস্তফা কুদরত-ই-এলাহী পূর্বদেশকে বলেন, ‘এসপিএম প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, আমরা বর্তমানে মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ করে ক্রুড শোধনাগারে আনতাম। এতে একটি জাহাজ খালাস করতে ৮-১০ দিন লাগতো। এসপিএম প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দুই দিনের মধ্যে একটি জাহাজ খালাস করা সম্ভব হবে। তাছাড়া লাইটারেজ ভাড়ার ব্যয় থাকবে না, ওশেন লস দূর হবে, সিস্টেম লসও কমে যাবে। এতে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার মতো সাশ্রয় হবে। বাড়বে জ্বালানি নিরাপত্তাও।’