‘পেট্রোদাসী’

581

এ গ্রামে কোনো দিন বিদেশফেরত মানুষ যে এর আগে আসেনি, তা নয়। বিদেশফেরত ছেলেমানুষ এলেও মেয়েমানুষ আসেনি। এবার বিদেশফেরত মানুষটি ছেলে নয়, মেয়ে। মেয়েমানুষ বলে কথা! গ্রামের সকালটা তাই আচমকা যেন নড়েচড়ে উঠেছে। গুতু ফকিরের কাছে এসেছে ধলাবুড়ি। তার চোখ দুটো কদিন ধরে করমচা লাল, ঝাড়ফুঁকে যদি কমে, এই আশায় এখানে আসা তার। গুতু ফকির তৈলপড়া, পানিপড়া দেয়; ঝাড়ফুঁক করে। গ্রামের মানুষ ছোটোখাটো সমস্যায় পড়লে গুতুর কাছে ছুটে আসে। ধলাবুড়ি ঠকঠক করে লাঠি হাতে উঠানের কোনায় খড়ের ঢিবির নিচে বসে পড়ে, তারপর ডাকেÑ ‘গুতু বাজান, ঘরে আছো নি?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে নাকি সুরে বলে, ‘কলি যুগ পড়ছে গো, কলি যুগ।’ গুতু ফকিরের স্ত্রী দুধজান উঠান ঝাড় দিচ্ছিল। ধলাবুড়ির কথা কানে যেতেই দুধজানের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। এ গ্রামে যত রকম ঘটনা ঘটুক, সব খবর প্রথম পাওয়া যায় এ বুড়ির কাছে। এজন্য এ গাঁয়ের অনেকেই তাকে সাংবাদিক বলে ডাকে।
দুধজান ঝাঁটা হাতে ধলাবুড়ির সামনে এসে থতমত খেয়ে বলে, ‘চাচি আম্মা, কী হইছে?’
‘কী আর অইবো! কলি যুগ! আমার বাপজান কইছে, কলিযুগে যে কী অইবো! বাপজান দেইখা যায় নাই, আমি দেখতাছি নিজ চোখে।’ বুড়ির কথা শুনে পানসি, পাতা ও পুতিÑ এই তিন কন্যা এরই মধ্যে পাশে এসে দাঁড়ায়। ‘দেশে গজব পড়ছে গো পানসির মাও, দেশে গজব পড়ছে।’ ধলা বুড়ির কথা শুনে আশঙ্কায় উপস্থিত সবার মুখ-চোখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। পানসি মায়ের দিকে তাকায়, দুধজান পানসির দিকে তাকায়। পাতা ও পুতি বুড়ির কাছ ঘেঁষে মুখ উঁচিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ঘটনা শোনার জন্য সবাই উদ্গ্রীব। সবারই মনের মধ্যে আতঙ্ক! সামনে হয়তো কঠিন কিছু অপেক্ষা করছে। দুধজানের বুকটা ধুকধুক করছে। পাতা ও পুতির তর সইছে না নতুন খবর শোনার জন্য। ঘটনাটা বলতে বুড়ি কেন এত দেরি করছে! অতঃপর বুড়ি মুখ খোলে, ‘তেলিরে কুহপডরায় বিয়া দিছে না?’
‘চাচি আম্মা! তেলির কী হইছে?’ জানতে চায় দুধজান। বুড়ির কথা শুনে পাতা ঢোক চিপে।
‘হেই তেলির ননদ বিদেশে থাহে।’
দুধজান বিস্ময়ে তাকায় বুড়ির দিকে। ‘এইডা কী কইন চাচি আম্মা! ম্যায়ামানুষ! ম্যায়ামানুষ বিদেশে থাকে?
ধলাবুড়ি ফোকলা দাঁতে হেসে উওর দেয়, ‘পানসির মাও, আমি তো হুইনা টাসকি নাগছি। পুরুষমানুষ বিদেশ যায়…’
‘চাচি আম্মা, তাই তো জানতাম। পুরুষরা বিদেশে যায়। ম্যায়ামানুষ বিদেশ যায়! আজগবি কিচ্ছা।’
‘পানসির মাও, আজগবি কিচ্ছা সত্য হইছে। হেই তেলি কাইল আইছে, নগে বিদেশি ননদ। যাওনের পথে পাংকির বাড়ি যাইমু। আজগবি কিচ্ছা দেখতে।’
গুতু ফকির এতক্ষণ চুপচাপ পাশে বসে ছিল, এবার সে মুখ খোলে, ‘চাচি, শুনছি ম্যায়ারা বিদেশে গিয়া খারাপ কাম করে।’
বুড়ি দুই হাত দুই গালে ছুঁয়ে বলে, ‘তওবা তওবা। কী কও গো বাজান, কী কও? দেশে তো কিয়ামত অইবো। দেশ তো আর টিকব না।’
দুধজান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ‘চাচি আম্মা, গজব তো পড়তাছেই। জমিতে ফসল কইমা গেছে। নদীতে চর পড়ছে। বৃষ্টি হয় না। আর কী দেখমু!’
বুড়ি মাথা নাড়ে, আর পান চিবুতে চিবুতে বলে, ‘ঠিক কইছো গো পানসির মাও, ঠিক কইছো। দেখছো না ম্যায়ারা ইশকুলে যায় পর্দা ছাড়া, শরম-হায়া নাই। কিয়ামত আইছে কাছাই। যাউক, অনেক কথা। অহন বিদেশি বেলাজ দেইখা আসি।’
বুড়ির কথা শুনে পানসি, পাতা আর পুতি আবদার ধরে, ‘ধলাদাদি, আমরাও যাইমু।’
পানসির মা ধমকে ওঠে, ‘থাউক, চাচি আম্মায় না চাইলে যাওনের দরকার কী?’
বুড়ি জিব কেটে, ‘নাগো পানসির মাও, আমার কোনো অসুবিধা নাই। হেরা নগে গেলে আমার আরো ভালা।’
সকালের রোদে গাছের পাতাদের ঝিলিমিলি, বসন্ত-বাতাসের ঝাপটায় গুতু ফকিরের বাড়ির উঠানের কোণে তিনকোনা লাল নিশান উড়ছে। এ লাল নিশান পিরবাবার প্রতি সম্মানের প্রতীক। এলাকায় আধ্যাত্মিক পির হিসেবে পরিচিত ফাইলা পাগলার শিষ্য গুতু ফকির। যদিও ফাইলা পাগলা বেঁচে নেই, কিন্তু এলাকার মানুষ এখনো ভক্তির সঙ্গে তার পথ অনুসরণ করে। ফাইলা পাগলার কবরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মাজার। তার ভক্তরা দলে দলে মাজারে জিকির করে, অনেকেই মনের বাসনা পূরণের জন্য মানত করে। প্রতি বছর মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে ফাইলা পাগলার মাজারে মেলা বসে। মেলায় নারী-পুরুষ মিলে মাজারের চারদিকে নৃত্য করে আর জিকির করেÑ
আমি নাচি না
ফাইলা নাচে
হেল হেল।
নাচ ও জিকিরের তাÐবে অনেক ভক্ত অজ্ঞান হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভক্তরা মানত করা গরু, ছাগল, মহিষ নিয়ে আসে মাজারে। তারা জিকির-আজগার করে, মানত করা পশু জবাই করে খায়। ফাইলা পাগলার শিষ্যরা সম্মানের প্রতীক হিসেবে বাড়ির উঠানে লাল নিশান ওড়ায়। গুতু ফকিরও ভক্তির প্রতীক উড়িয়েছে উঠানে। ওদিকে পথ পড়বে না, পংকির বাড়িটা পড়ছে ডানে। খেতের আল ধরে যেতে হয়। ওরা চারজন হাঁটতে হাঁটতে আরো কজন বউ-ঝিকে দেখতে পায়। এক প্যাঁচে শাড়ি পরে সবাই যেন ছুটছে। সবারই কি একই গন্তব্য? কে জানে!
যা অনুমান করছিল বুড়ি, ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে। টুলের ওপর প্যান্ট-শার্ট পরা একটি মেয়ে বসে আছে। আর তাকে ঘিরে দুনিয়ার মেয়েমানুষ। সবাই যেন আজব কোনো প্রাণী দেখছে অবাক বিস্ময়ে! ধলাবুড়ি ভিড় ঠেলে ঠকঠক করতে করতে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সে ঘুরে ঘুরে মেয়েটিকে দেখতে থাকে। পাতা আর পুতি তো মহা খুশি। পাতা পানসিকে খোঁচা দিয়ে আস্তে করে বলে, বড়ো বু দেখছ, বিদেশি ম্যায়াডা কী সুন্দর! যেমন তার ঢকডিল (রূপ) তেমনি তার পোশাক।’
ধলাবুড়ি ঠোঁটকাটা স্বভাবের। তার কাছে যেটা খারাপ মনে হবে, সেটা সবার সামনেই ঠাস করে বলে বসবে। এই গাঁয়ের একমাত্র বয়োজ্যেষ্ঠা হিসেবে সবাই তাকে সম্মান করে। তার কথার ওপর কেউ কথা বলে না। মেয়েটির মাথার চুলগুলি ছোটো। গায়ে টাইট জামা, পরনে জিনস প্যান্ট। ধলাবুড়ি বলে, ‘এই ম্যায়া, তুমি বিদেশ থিকা এইরকম বেলেহাজ হইয়া আইছ কেন?’ তেলি লজ্জায়-ভয়ে আস্তে করে ননদের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘রূপী, ঘরের ভিতরে চইলা আসো।’ তেলির মা ভেতরে ভেতরে গজগজ করছে। হায়-হায় রে, বুড়ি তো দেখি এইবার আমার ম্যায়ার সংসার ভাঙব!
বুড়ির কথায় রূপীর রাগ হওয়ার কথা। কিন্তু সে উলটো হেসে-হেসে বলে, ‘আপনি অবশ্যই ধলাদাদি? ভাবির কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আপনি অনেক মজার। ভালোই হলো। আমিও আপনার কাছ থেকে মজার মজার গল্প শুনব।’
ধলাবুড়ি রূপীর কথায় থমকে যায়। নিজে নিজেই যেন লজ্জিত হয়। এত খারাপভাবে কথা বলার পরও রূপী হেসে-হেসে বুড়ির গায়ে হাত বুলিয়ে কথা বলছে। ধলাবুড়ি যে-সমাজে বেড়ে উঠেছে, সে-সমাজের সুরটাই তার মননে গেঁথে আছে। বুড়ির বয়স শতকের কাছাকাছি। এখনো লাঠিতে ভর করে এবাড়ি-সেবাড়ি হেঁটে বেড়ায়। আর তার বেড়ে ওঠা সমাজের রীতিনীতিকে বর্তমান সমাজে ফলাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। সেটা অনেক ক্ষেত্রেই পুরোপুরি সম্ভব হয় না। তাই তো তার চোখে সবকিছুই অনিয়ম। এ কারণেই যেখানে যা দেখবে, সেখানেই বকবক করে তার অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে যাবে। ধরা যায়, ধলাবুড়ি সমাজের কালের পাÐুলিপি। কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছে আজও। পাÐুলিপি মেলে ধরলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখনকার সমাজব্যবস্থার রীতিনীতি, কীর্তি-কাহিনি।
রূপী ধলাবুড়িকে কাছে টেনে নিয়ে টুলে বসাতে বসাতে বলে, ‘ধলাদাদি, আপনাকে একটা কথা বলি?’
এরই মধ্যে বুড়ির গলার স্বর কিছুটা নরম হয়ে আসে। বলে, ‘কও গো গেদি, কও।’
‘ধলাদাদি, এখন ঢুলী কেমন তা আমরা জানি না। আগে ধনী লোকের বউরা ঢুলীতে করে যাতায়াত করত। এখন যাতায়াতের জন্য গাড়ি, রিকশা, ভ্যান আছে। যাতায়াত-ব্যবস্থা কত সহজ হয়েছে। আগে এখান থেকে টাঙ্গাইল শহরে যেতে সারা দিন লাগত। আর এখন আধঘণ্টায় টাঙ্গাইল যাওয়া যায়। আমার বাবার কাছে শুনেছি, জ্বর হলে টাঙ্গাইল শহরের পাশে বরইল্লা গিয়া পাঁচন নিয়ে আসত। পাঁচন খেলেই নাকি জ্বর ভালো হয়ে যেত। সেই বরইল্লার উদ্দেশে অর্ধেক রাতেই ঘুম থেকে উঠে রওনা দিত আবার পাঁচন নিয়ে ফিরত মধ্যরাতে। আর এখন জ্বর হলে পাঁচ টাকার প্যারাসিটামল খেলে ভালো হয়ে ওঠে। অতি সহজেই হাতের কাছে ওষুধ পাওয়া যায়।’
‘হু গেদি, আমরাও জানি। বরইল্লার পাঁচন খাইলে জ্বর ভালা হইত। গেদি, কথা যহন উঠাইলা, তয় একটা ঘটনা শুনো।’ বুড়ি গড়গড়িয়ে বলতে থাকে, ‘বরইল্লার পাঁচন বানাইত গাদু কবিরাজ। গাদু কবিরাজের নগে আমাগো উনির খুব ভালা ভাব আছিল। একবার আমার শ^শুর কঠিন জ্বরে পড়ছে। ছয়-সাত দিন হইছে তাও জ্বর ছাড়ে না। আমাগো উনি বরইল্লা গেল পাঁচনের জুন্যে। মাঝরাইত। উনার আসার কোনো খবর নাই। বাড়ির সবাই চিন্তায় অস্থির। হঠাৎ একটা আওয়াজ হইল। আমার ভাশুরের নাম জালাল। খালি শুনলাম, জালাল ভাই রে জালাল ভাই। আর কোনো শব্দ নাই। ভাশুর হারিক্যান নইয়া বাইর বাড়ির কাছারে দেখে, উনি পইড়া রইছে। পাঁচনের বোতল থেকে পাঁচন ছিটকা পড়ছে। ধরাধরি কইরা বাড়ি নিয়া আসলো। চোখে-মুখে পানি দিলে, করমচার মতো লাল টকটকা চোখ খুইলা চাইল, ভাশুর কয়, কী দেখলাম। খালি শুনছি মেঘাখালি বটগাছটা ভালা না। ঐ গাছে বড়ো একটা দেও থাকে। আইজ নিজের চোখে দেখলাম। ভাশুড় জিগায়Ñ কী দেখছো? উনি বলেÑ বড়ো ভাই, ঘুটঘুটা আন্ধাইর। কিছুই দেখা যায় না। মেঘাখালি আসলেই ডরে গাও কাঁপতাছে। ডরে-ডরে বটতলা পার হইয়া গাঙের পাড় দিয়া হাঁইটা আসার সময় মুনে হইতাছে, পাছে যান কেউ আমার নগে নগে হাঁটতাছে। কিন্তু, ডরে পিছনে দেখার সাহস হয় না। সামনে দেখি গাঙে ক্যারা জানি খুইয়া দিয়া মাছ ধরতাছে। দেইখা সাহস পাইলাম। আগাইতে থাকলাম। ওমা! একটু পর দেখি, মাছওয়ালা নাই। গাঙের ওপারে এক ঠ্যাং আর এইপাড়ে এক ঠ্যাং দিয়ে বিশাল এক মর্দ খাড়াইয়া রইছে। এক ঝলকেই ওপারের ঠ্যাং এই পাড়ে আইনা পিছনে কারে যান ঠাস কইরা থাপ্পড় দিল, আর কইল, এই হারামজাদা, এই মানুষটার পিছনে ক্যান নাগছ? ও বড়ো বিপদে পইড়া বাপের জুন্যে ওষুধ নিয়া যাইতাছে। ও ডরাইব না? আমারে কইল, যাও বাছা, তোমার ডর নাই। ডরে তো গাও কাঁপতাছে। কোনোরকম বাড়ির কাছারে আইসা তোমারে ডাক দিয়া পইড়া গেছি।’ ধলাবুড়ি তার গল্প শেষ করে।
রূপী বলে, ‘ধলাদাদি ফাইন একটি কাহিনি জানলাম। দেখেন তখন কত কষ্ট হইত। আর এখন টাঙ্গাইল হাতের মুঠোয়। কালিহাতী থেকে টাঙ্গাইল গিয়ে কুলি ফেলা যাবে। আগে কেউ মরলে সবাইকে খবর দেওয়া সম্ভব হতো না। আর এখন একজন মানুষ মারা গেলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মোবাইলে সব জায়গায় খবর দিতে পারে। ঘরে বসেই দেশে-বিদেশে কথা বলা যায়। এটা কি ভালো না, খারাপ?’
‘হু গেদি, মোবাইলে খবর পাঠাইছে। তোমার কথা তো ভালা লাগতাছে। তয় তুমি পুরুষের মতোন দুঠেংলা পিন্দিছো কেন? এইডা তো ভালা না। এইডা পাপ। একটা হাদিস আছে, যে-মাইয়া পুরুষের পোশাক পিন্দিুবো তার জন্য দোজখ।’
‘ধলাদাদি, আপনার কথা ঠিক না। এগুলি ছেলেমেয়ে সবাই পরে। মুসলমান দেশের মেয়েরাও পরে। এর মধ্যে কোনো পাপ নেই।’
‘গেদি, একটা কথা জিগাই?’
‘বলুন দাদি।’
‘কানে-কানে কইমু। কানডা বাড়াও।’ বুড়ি কানের কাছে বিড়বিড় করে বলে, ‘যহন…ধরে, তহক্ষণ দুঠেংলা খুলো কেমুন কইরা?’
রূপী খিলখিল করে হাসতে হাসতে উওর দেয়, ‘যহন…ধরব তহন আপনাকে সিস্টেমটা দেখাব।’
রূপীকে নিয়ে হরিপুর গাঁয়ের মানুষের কৌত‚হলের শেষ নেই। বাড়ি বাড়ি আলোচনা। রাস্তায়-মাঠে-ঘাটে পুরুষদের আলোচনার বিষয় বিদেশে থাকা রূপী। গুতু ফকির মসজিদ থেকে আসরের নামাজ পড়ে বের হয়ে পংকুর কাছে জানতে চায়।
‘ও গ্যাদা, কীসব শুনতাছি। তেলির ননদ নাকি বিদেশ ঘুইরা আইছে?’
‘পংকু মাথার টুপি খুলতে খুলতে বলে, ‘হু চাচা, ঘটনা সত্য।’
‘তা গ্যাদা, তেলিরে যান ঐ পথে না নেয়।’
‘চাচা, আমি বাঁইচা থাকতে তা হইতে দিমু না।’
কিছুক্ষণ পর মনু মিয়া গুটি-গুটি পায়ে পংকুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়, ডাক দেয় তেলিকে, ‘কিরে তেলি, বিদেশি কুটুম নাকি আইছে। তাই দেখতে আইলাম।’
‘মনুভাই বসো। বিদেশি কুটুমরে ডাক দিই।’ মনু মিয়া টুলের ওপর আরাম করে বসে তাকিমুকি করে। ‘রূপী, ও রূপী বাইরে আসো। আমার এক ভাই আসছে। তোমারে দেখব।’ রূপী ঘর থেকে বের হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। মনু মিয়া অবাক হয়! এ কী! ব্যাটাছেলের মতোন প্যান্ট পিন্দিছে! হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে রূপীর দিকে।
রূপী মুচকি হাসে আর বলে, ‘ভাবি, পানি নিয়ে আসো। তোমার ভাই কিন্তু অজ্ঞান হয়ে যাবে।’ মনু মিয়ার ঘোর কাটে। লজ্জিত হয়।
‘মনুভাই তো বিদেশি মেম আগে দেখে নাই, তাই তোমারে দেইখা টাসকি নাগছে!’ রূপীর কথায় তাল রেখে উত্তর দেয় তেলি।
মনু মিয়া নড়েচড়ে স্বাভাবিক হয়ে উত্তর দেয়, ‘তেলি, তোর কথা ঠিক, বিদেশি কুটুম দেইখা ঘোরের মধ্যেই পইড়া গেছি। তা কুটুম কন, বিদেশের খবর কী? কোন দেশে গেছিলেন?’
‘আমি সৌদি আরব গিয়েছিলাম, তিন মাসের জন্য ছুটিতে এসেছি। ভালো লাগছে না।’
‘বিয়ান সাব, সৌদি আরবের অবস্থা কেমন?’
‘মনুভাই সেটা তো বেহেশতের দেশ। তিন মাসের জন্য এসেছি। ভালো লাগছে না। আমাদের দেশে বাস করা আর নরকে থাকা সমান। আর ঐ দেশে অভাব নাই, যন্ত্রণা নাই, কী আরম! গরমের সময় গরম টের পাই না। শীতের সময় শীত টের পাই না।’
‘কেন? সৌদি আরব তো মরুভ‚মি। গাছপালা নাই। শীতের দিনে খুব শীত, গরমের দিনে খুব গরম হওয়ার কথা।’
‘হ্যাঁ ভাই, তা ঠিক। কিন্তু গরমের দিনে এসি ব্যবহার করা হয়। এতে ঠান্ডা লাগে। আর শীতের দিনে রুমহিটার ব্যবহার করা হয়। এতে রুম গরম থাকে।’
‘বিয়াইন সাব, হেভি ব্যাপার তো। আমারে বিদেশ নেওন যাইব না?’
‘হ্যাঁ ভাই, অবশ্যই নেওয়া যাবে, যদি আপনার ইচ্ছা থাকে তবে এই মুহূর্তে আমার কাছে কিছু মেয়েদের ভিসা আছে। খুব সহজেই মেয়েদেরকে আমি সাথে নিয়ে যেতে পারব।’
‘বেয়াইন সাব, ম্যায়াগো কাম কী?’
‘মেয়েদের অনেক কাজ। গার্মেন্টেসে চাকরি আছে। বাসাবাড়ির কাজ আছে। কেউ দোকানে কাজ করে, হাসপাতালে ক্লিনারের কাজ করে। গার্মেন্টসে ও হাসপাতালের কাজে গেলে টাকা লাগবে ২ লাখ। আর বাসাবাড়ির কাজে গেলে ৮০ হাজার টাকা।’
‘বেতন কেমুন?’
(চলবে)
‘বাসাবাড়ির কাজে বেতন ১০ হাজার টাকা। থাকা-খাওয়া ফ্রি। আর গার্মেন্টসে ও হাসপাতালের কাজে বেতন ২০ হাজার টাকা।’
‘বেয়াইন সাব, একটা কথা জিগাই?’
‘হ্যাঁ বলেন।’
‘মানুষ কয়, ম্যায়ারা খারাপ কামে যায়, বাংলাদেশ গরিব দেশ। এই সুযোগে গাঁয়ের মেয়েদের অধিক আয়ের লোভ দেখাইয়া বিদেশে নেয়।’
‘ভাই, মানুষ তো কত কিছুই বলে। সব মিথ্যা। আমাদের দেশের ভিতরের কথাই ভাবেন। প্রথম যখন মেয়েরা গার্মেন্টেসে চাকরি করতে গেছে, তখনো মানুষ অনেক আজেবাজে কথা বলত। এখনো বলে। তবে বলার ভাগটা কমে এসেছে। বিদেশে মেয়েরা যায়। টাকা রোজগার করে। মেয়েরা স্বাবলম্বী হোক, এটা আমাদের দেশের পুরুষশাসিত সমাজ মানতে নারাজ। তারা চায়, নারীরা কারাবাস করবে। কেন নারীরা অর্থ উপার্জন করে পুরুষের ওপর হাত ঘোরাবে, আমি পাঁচ বছর যাবৎ বিদেশে থাকি। বাড়ি করেছি, জমি করেছি। মাসে-মাসে টাকা পাঠাই। গ্রামের মানুষ হিংসায় জ্বলে-পুড়ে মরে। আর তো কিছু করতে পারে না। আজেবাজে কথা বলে বেড়ায়। যাতে আমি ওদের কথায় দমে যাই। কিন্তু আমি কখনো পুরুষের কথায় পাত্তা দিব না। একটা সময় ওরাই আমার কাছে হাত পাতবে। কেউ-কেউ হাত পাতা শুরু করেছেও। টাকার সামনে সবার মুখ বন্ধ।’
‘বিয়াইন সাব, অনেক প্যাঁচাল পারলাম। আমার বাড়ি আসবেন। অহন যাই।’
মৃদু হেসে রূপী বলে, ‘আচ্ছা ভাই, যাওন নাই। আসবেন।’

পানসি পুকুরঘাটে বসে আছে। রূপীর কথাগুলি তার হৃদয়ের ভেতর নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। ওর বিদেশি গল্প শুনে পানসির মধ্যে ক্ষীণ আশার আলো জাগে। বিদেশ স্বর্গের মতো। মেয়েটা কেমন বিরামহীনভাবে কথা বলতে পারে। রূপীর মুখটা তার চোখের সামনে ভাসে। কী সুন্দর! স্বর্গভাবনায় বিভোর পানসি। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পায় সে। মা তো বাসায় নেই! চুলায় ভাত বসাতে হবে। নিজ কাজে মনোযোগ দেয় সে। ঘরের সামনে উঠানের এক কোণে চাটাই দিয়ে ছোট্ট একটু ছাউনি। ছাউনির নিচে দুটো চুলা। এই এলাকায় এটাকে বলে ছায়লাঘর। প্রত্যেক বাড়িতেই রান্নার জন্য এমন ছায়লাঘর আছে। পানসি মাটির হাঁড়িতে ভাত চাপিয়ে দেয় চুলার ওপর। শুকনো পাতা দিয়ে জ্বাল দিতে থাকে চুলায়। টগবগ করে ভাত ফুটতে থাকে। এক রাখাল উঠানে এসে দাঁড়ায়। রাখালকে দেখামাত্রই ওর ভেতরটা কেমন ছ্যাৎ করে ওঠে। এ রাখালকে আগে কখনো দেখেনি ও। পুতি ও পাতা ছাগল নিয়ে মাঠে গেছে। বলতে গেলে এখন শূন্য বাড়ি। পানসি চোখ তুলে তাকাতে পারে না। ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপতে থাকে। এমন হচ্ছে কেন তার? লজ্জা, নাকি ভয়? নাকি অন্যকিছু। রাখাল এদিকে-সেদিক তাকিমুকি করে। পানসি ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না। অগত্যা সমস্ত নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে রাখাল, ‘গুতুচাচা বাড়ি নাই?’
পানসির মুখটা গোধূলির মতো, গোলাপি চোখ দুটি বুজে আসতে থাকে। বুকের মধ্যে উথালপাথাল ঢেউ। মনের ভেতর একটু সাহস সঞ্চার করে লাজরাঙা গোলাপি মুখটি তুলে আলতো করে নমনীয় দৃষ্টিতে তাকায় রাখালের গোটা-গোটা চোখে। কালো[ঢ়১} গাঙের জলের মতো গহিন দুটো চোখ প্রতিফলিত হয় চার চোখের চোরাবালিতে। চার চোখের প্রতিফলনের আভা ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিগ। সেই শুভ্র রঙিন ঠোঁট দুটো নেড়ে পানসি বলে, ‘বাজান গাওয়ালে (ফেরি করতে) গেছে।’ পানসি চুলার দিকে চোখ দুটি ফেরায়। দৃষ্টি যদিও আগুনের শিখায়, তথাপি মনের ভেতর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ।
‘আমারে একটু আগুন দেওন যাইবো? বিড়ি ধরাইমু,’ রাখাল পানসির দিকে এগিয়ে আসে। পানসির গহিন সমুদ্রে উত্তাল ঢেউয়ের তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে এরই মধ্যে। পাটখড়িতে আগুন ধরিয়ে রাখালে হাতে দেওয়ার সময় রাখালের হাতের এতটুকু ছোঁয়া লাগে অনিচ্ছাকৃত। পানসির ভেতর রাঙা ভ‚কম্পন ঘটে। এ কম্পনে তিলে তিলে গড়া সবুজ দ্বীপে নতুন জলের অনুপ্রবেশ ঘটে। ‘আর একটু কষ্ট দেই। একটু পানি দেওন যাইবো?’ রাখালের এ কথা পানসি যেন শুনতে পায়নি। রাখাল বেশ খানিক সময় অপেক্ষা করে। রাখাল পুনরায় পানি খেতে চাইলে পানসি কিছুটা হকচকিয়ে যায়। তার পাশেই মাটির কলসি থেকে পানি ঢেলে কাঁসার গ্লাসে খেতে দেয়। রাখাল ছায়লাঘরের দাওয়ায় মাটিতে ধপাস করে বসে ঢকঢক করে পানি খেয়ে গ্লাসটা মাটিতে রেখে দেয়। বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে জানতে চায়, ‘বাড়িতে আর কাউরে দেখতাছি না যে?’
পানসির হৃদয়ের সবুজ বনভ‚মিতে এখনো কীসের যেন অলৌকিক ডুগডুগি বেজে চলেছে। সে স্বাভাবিক হতে পারছে না। লজ্জায়, ভয়ে ঠোঁট দুটো আড়ষ্ট হয়ে আসে। অনেক কষ্টে উত্তর দেয়, ‘সবাই কামে গেছে।’
‘আইচ্ছা যাই। তোমারে অনেক কষ্ট দিলাম।’ একা একাই নিজের নাম জানায় সে, ‘আমি গহর। বাড়ি কুষ্টা। তোমাগো বাড়ির সামনে পাটখেতে কাম করতাছি। ও, তোমার নামডা কি বলা যাইব?’
লজ্জায় আরো যেন গলে যায় পানসি। মাথায় ঘোমটা বড়ো করে টেনে উত্তর দেয়, ‘পানসি।’
‘নামডা তো খুব ভালা। মায়ের কাছে শুনছি, আগে ধনী লোকেরা নাকি পানসি নৌকা দিয়া যাতায়াত করত। পানসি নাও, দেখতে নাকি খুব সুন্দর!’ গহরের চোখে স্মৃতির পানসি ভেসে ওঠে। হরিপুরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা ঝিনাই নদী। একসময় এই নদীর ওপর দিয়ে বড়ো বড়ো নৌকা মাল বোঝাই করে বিভিন্ন গঞ্জে যাতায়াত করত। বড়ো নৌকাগুলির নাম ছিল মাল্লার নাও। হয়তো মাল সরবরাহের কারণে এ ধরনের নাম। ছোটো ছোটো ছইওয়ালা নৌকা করে গাঁয়ের বউ-ঝিরা নাইয়র যেত বাপের বাড়ি। গাঁয়ের ধনী ব্যক্তিরা পানসিতে চড়ে বিয়ে করতে যেত। পানসি নৌকাটার মাঝখানে চারকোণা ঘরের মতো। কাঠের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। দেওয়ালগুলো বিভিন্ন রঙের কারুকাজ করা। বলা যায়, ধনীদের ভ্রমণবিনোদনের বাহন। সেই থেকে পানসি খানদানি নাম। মনে মনে বলে, পানসি দুর্লভ! এই পানসি আমি পাইমু!
পানসির হৃদয়ের অলৌকিক ডুগডুগি এখনো বাজছে। এদিকে পানসি নিজের কাছেই প্রশ্ন রাখে, গহরকে দেখামাত্র তার ভেতরে এমন ভ‚মিকম্প হলো কেন? এখনো তার কম্পন থামেনি। গহর চলে গেছে সেই কখন! রান্নাঘর থেকে বের হয়ে উঠানে পেয়ারাগাছের নিচে এসে দাঁড়ায় পানসি। এখান থেকেই দেখা যায় কুষ্টা গাঁও। হরিপুর ও কুষ্টার মাঝখানে বড়ো একটি মাঠ। মাঠের শেষ প্রান্তে কুষ্টা। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘরের দরজা খুললেই ওই গ্রাম চোখে পড়ে তার। এতদিন তো এ গ্রাম নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না। এখন গ্রামটার প্রতি এত মায়া হচ্ছে কেন? মায়াবী চোখে ভাসছে দুই গ্রামের মাঝে শুধু সবুজ আর সবুজ।
গহর অন্যমনস্কভাবে পাটখেতে নিড়ানি দেয় আর বিড়ি টানে। চোখের মাঝে ঝিলিক দিয়ে ওঠে পানসির লাজরাঙা গোলাপের মতো মুখটি। পাটগাছের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। পাটের পাতাগুলিতে আদরমাখা মায়াবী সবুজ রং। রোদের ঝিলিকে পাটপতাগুলো লাজুক-লাজুক ভঙ্গিতে হেলছে দুলছে পানসির রাঙা মুখটির মতো। হঠাৎ রোদের ঝিলিক নিভে যায়। গহর চোখ রাখে আকাশের দিকে, পানসির লাজরাঙা মুখটি বারবার মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায়। আবার হঠাৎ হঠাৎ মেঘের বুরুজ ভেঙে চাঁদ ওঠে। মাথাল মাথায় নিড়ানি হাতে মাঝে মাঝে স্তব্ধ হয়ে যায় গহর। নিজের সঙ্গে নিজের মৌন গল্পে গল্পে সময়টা কাটছে তার ভালোই। আবার চোখ নামায় সে সবুজ পাতায়। কখনো কখনো সবুজ পাতায় হাত রেখে সুখস্পর্শ নেয়। তন্ময় দুটো চোখ গহরের চোখে ডুবসাঁতার খেলে। যেন রাশি-রাশি কালো জল টলমল করছে মুগ্ধ চোখের নীরব চাহনিতে। হৃদয়ের ভেতর পতপত করছে ভালোবাসার নিশান। তাই তো বুকের তিমির ঠেলে জেগে ওঠে ভালোবাসার দ্বীপ। দুপুর গড়িয়েছে। বিকেলের লাবণ্যময় রোদের হাতছানিতে উঠে দাঁড়ায় গহর। মুগ্ধ চোখ রাখে আসমানে। একি! নীলিমার মতো শুভ্র স্নিগ্ধ মুখটি! নীল আসমানের ভাঁজে-ভাঁজে ভেসে বেড়াচ্ছে! মেঘের পাহাড়ে কালো চুল এলিয়ে নীল আঁচল বিছিয়ে বসে আছে স্বপ্নধোয়া সুখদ্বীপ।
এ সময় খেতের আল ধরে হেঁটে আসে মনু মিয়া। ‘গহর নাকি? এই চহে (মাঠে) মেলা দিন পর আসলি?’
‘হু, মনুভাই, চুক্তিতে কাম নিছি। কামলা খাটা মানুষ। যেইখানে কাম পাই সেইখানেই যাই। তয় মনুভাই, তোমারে এত খুশি খুশি লাগতাছে যে?’
‘হু রে গহর। একটা সুখের খবর আছে।’
‘কী খবর ভাই?’
‘পংকুরে চিনস না?’
‘চিনুম না ক্যা? এই গাঁয়ের প্রায় সবাইরেই চিনি। তা কী হইছে? পংকুচাচার?’
‘পংকুচাচার ম্যায়া তেলির বিয়া হইছে কুহপডরা। হেই তেলির নোনদ রূপী, বিদেশ থাকে।’
‘ভাই, এইটা কী কও? ম্যায়ামানুষ বিদেশে যায়?’
‘আরে গহর, হেই বিদেশি মেম পংকু চাচার বাড়ি আইছে। হেই বিদেশি মেমসাবের লগে দেখা কইরা আইলাম। কী যে ভালা লাগল বিদেশি মেমরে। মেসসাব আমারে খুব খাতির করল। মেমসাব আমার বাড়ি অহিবো।’ ঠেঁটের কোণে মৃদু হাসি টেনে মনু বলে, ‘যাইরে গহর।’
গহর ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের ভেতর কথাটা বাজতে থাকেÑ ম্যায়া মানুষ বিদেশে যায়!

পানসি বাহিরবাড়ি কদমতলে বসে আছে। তার উদাস দুটো চোখ সবুজ মাঠে ওঠানামা করছে। হঠাৎ চোখ দুটি উচ্ছল হয়ে ওঠে। গহর! নীল আসমানে কী দেখছে!
পানসির হৃদয়ে জ্যৈষ্ঠের নূপুর বেজে ওঠে। ভালোবাসার গাঙে খেলা[ঢ়২} করে অজ¯্র সোনালি মাছ। রাশি রাশি সবুজ নাচানাচি করে ধূলিমাখা বাউকুড়ানিতে। এ সময় পুতি কোথা থেকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে পানসিকে! ওর ঝাঁকুনিতে বন্ধ হয়ে যায় পানসির সুখমাখা ভালোবাসার পাÐুলিপি। ভেঙে যায় ধ্যান। পানসির চোখ দুটো পতিত হয় সবুজ পাটের খেতে। অস্পষ্ট ছবির মতো লাগছে। মুখটা পুরোপুরি বোঝা না গেলেও গহরকে দেখা যাচ্ছে। গুটিগুটি পা ফেলে ফিরছে আপন আলয়ে।
‘বড়ো বু, বড়ো বু, আমার ছাগলটা দেখছো?’ পানসির দৃষ্টি গহরের গমনপথের দিকে। পুতির কথায় কর্ণপাত না করে সে তাকিয়ে থাকে। কুষ্টা গাঁয়ে ঢোকার আগ পর্যন্ত চোখের পলক ফেলে না। গহরের কোনো চিহ্ন আর পানসির দৃষ্টিতে পড়ে না এখন।
‘পুতি, কী হইছে?’
‘বড়ো বু, তোমার কী হইছে? নিরিখ বাইন্ধা কী দেখতেছিলা?’
পুতির নাকটা আলতো করে টেনে দিয়ে পানসি বলে, ‘বেশি পাকনা হইছো! তোমার এতকিছু বোঝার দরকার নাই। ছাগলের কথা কী কইছিলি?’
‘বড়ো বু, ছাগলডা পাই নাই। বাড়িতে আইছে?’
‘না তো, বাড়ি আসে নাই। ভালা কইরা খুঁইজা দেখ।’
‘সব জায়গায় খুঁজছি। পাই নাই।’
‘পাতা কোথায় রে, পুতি?’
‘পাতারে খোঁয়াড়ে পাঠাইছি দেখতে, ছাগলডারে কেউ ধইরা খোঁয়াড়ে দিছে নাকি। কয়েকটা গ্রাম মিলে ‘খোঁয়াড়’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। গায়ের গোরু-ছাগল কারো জমিতে ফসলের ক্ষতি করলে, সেই পশুটিকে খোঁয়াড়ে আটক রাখা হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে পশুর মালিক তার পশুকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে।
‘পুতি, তুই বস। কান্দিস না। পাতা খোঁয়াড় দেইখা তো ফিরা আইবো। তারপর দেখি, কী করন যায়?’
এরই মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে পাতা হাজির হয়। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে, ‘বড়ো বু, ছাগল পাই নাই।
‘পাতা দেখ তো। এইদিকে কে যান আইতাছে। জাগিরা। পাতা, আগাইয়া যা। জাগিরাকে জিজ্ঞাসা কর, ছাগলডা দেখছে নাকি?’
পাতা দৌড়ায় আর ডাকে, ‘জাগিরাভাই, ও জাগিরাভাই, আমাগো ছাগলডা দেখছ?’
জাগিরা জবাব দেয়, ‘ছাগলডা কি সাদা?’
‘হ ভাই।’
‘সাদা একটা ছাগল কুষ্টার আটায় (ময়দানে) দেইখা আইলাম। তাইলে, তাড়াতাড়ি যা পাতা।’
পাতা ওখানে থেকেই চিৎকার করে ডাকতে থাকে, ‘মেজো বু, মেজো বু, তাড়াতাড়ি আয়।’
দুই বোন দৌড়াতে থাকে কুষ্টার আটার দিকে। কুষ্টা গ্রামের একটা বড়ো জায়গা জুড়ে অনেক গাছপালা ও বাঁশঝাড় ঘেরা জঙ্গলের মতো। জঙ্গলের সামনের ফাঁকা জায়গাটাকে বলে কুষ্টার আটা।
দুধজান বলে, ‘বড়ো গেদি, অল্প চারডা চাইল আছে। ভাত বসাই দে। তোর বাজান সারা দিন গাওয়াল কইরা বাড়ি আইবো।’
গুতু ফকির গ্রামে গ্রামে ফেরি করে, আলতা, চুরি, ফিতা, সোনালি-রুপালি রং বিক্রি করে টাকা ও ধানের বিনিময়ে। প্রতিদিন বোঁচকা একটা কাঁধে নিয়ে ভোরে বের হয়। সারা দিন শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। কোনো কোনো দিন রোজগার ভালো হয়। তাতে কয়েক দিনের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো দিন আয় খুব সামান্য হয়। সমস্ত দিন শেষে গুতু হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ঘরে ফিরবে। অথচ ঘরে খাবারের ব্যবস্থা নেই। ঘরে যে চালটুকু আছে তাতে পেটের কোনাও ভরবে না। এটা নতুন নয়। এরকম সমস্যা তাদের প্রায়ই ঘটে। তাই কষ্টটা দুধজানের গা-সয়া হয়ে গেছে। দুধজান পানসিকে হাঁড়ি চড়াতে বলে ছিাগলের খোঁজে বের হয়।
পানসি ছায়লাঘরে চুলার ওপর ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে দেয়। চরদিকে সন্ধ্যার পিনপতন নীরবতা। আজানের সুর বেজে ওঠে। গুতু ফকির উঠানে এসে দাঁড়ায়। দুধজান এগিয়ে ধানের বস্তাটা ঘরে নিয়ে আসে। ‘বড়ো গেদির মাও, এক গিলাস পানি দেও।’ দুধজান ঝকঝকে কাঁসার গেলাসে পানি এনে দেয়। গুতু ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে। তারপর ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেয়। ‘বড়ো গেদি, পাতা-পুতিরে দেখতাছি না যে?’ বলতে বলতেই দুই বোন হাজির হয়।
পাতা বলে, ‘একজুনের ছাগলের সাথে চইলা গেছাল কুষ্টা।’
পুতি খুঁটির সঙ্গে ছাগলের দড়ি বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘ওরে বাবা! কুষ্টার আটায় এই ভরা সন্ধ্যায় মানুষ যায়? আমার যে কী ডর করছে!’
অজানা আশঙ্কায় গুতু ফকিরের মন দুলে ওঠে। দুধজানকে ডেকে বলে, ‘বড়ো গেদির মাও, ওগো দুইজনরে ঘরের বাইরে বাড়তি চালার নিচে খাড়া করাও। তার বাদে চালের উপুরে পানি ঢাইলা নাহাইয়া (গোসল) দেও। কুষ্টার আটায় বাঁশঝাড়ে বরমাদুষ্ট থাকে। এই ভরা সন্ধ্যায় ওরা বাহির হয়। এই সুময় যারে পাইবো তার উপুরেই ভর করবো।’
কুষ্টার আটা জায়গাটা হরিপুর ও কুষ্টা দুই গ্রামের মানুষের কাছেই ভয়ংকর স্থান। সবার বিশ্বাসÑ ওখানে বরমাদুষ্ট নামে ভ‚তের সর্দার বাস করে। তাই কার্তিক মাসের শেষ দিন হিন্দু স¤প্রদায় ভ‚তসর্দার বরমাদুষ্টকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য পূজা দেয়। আর মুসলমানরা ওইদিন সন্ধ্যায় একমুঠি পাটশোলার আটি বেঁধে মশাল জ্বালায়। দুই গ্রামের ছেলে-বুড়োরা দল বেঁধে মশাল হাতে কুষ্টার আটায় দৌড়াদৌড়ি করে আর ছড়া কাটেÑ
ভাড়া গেল
ভুড়া গেল
বোচার কান
মশায় খাইল।
সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মশালের আগুন নিভিয়ে দেয়। আগুনে পোড়ার পর যতটুকু পাটখড়ি থাকে তা ওখানে পুঁতে দেয় আর ছড়া কাটেÑ
ভাড়া দিলাম ভুড়া দিলাম
মশার গাও পুইড়া দিলাম
বরমাদুষ্ট, তোর জায়গা রাইখা দিলাম।
তিন বার ছড়ামন্ত্র পড়ে তিনটা পাটখড়ি পুঁতে দেয়। গ্রামবাসীর ধারণা, এতে বরমাদুষ্ট কারো ক্ষতি করবে না। তার পরও জায়গাটা সবার কাছে ভয়ের। ওখানে গেলে গা ছম ছম করে। কিন্তু ব্যতিক্রম পাতা। তিন বোনের মধ্যে ছোটো। স্বভাবটা ডানপিটে। ডাক দোহাই, নিয়মকানুন খুব একটা মানতে চায় না। কাজেই ওর কাছে এসব কিছু নয়। দুধজানকে বলে, ‘তোমরা ডরের কুবুতররে নাহাও, আমার কিছুই অইবো না।’

দুধজান পুতিকে গোসল করায় আর বলে, ‘ছোটো গেদি, তুই কী বুঝবি? তুই তো ডরপড়ার পাতা খাইছস। কথা বাদ দিয়া চালার নিচে খাড়া।’
‘মাইয়া (মা), আমার লাগব না। পুতিরে নাহাও।’
দুধজান একা-একাই গজগজ করে। ‘মুখপোড়া, বেহারা, তোর সাথে আমি কোনো দিনই পারলাম না। সগল কামেই গতরের জোর খাটাস। ম্যায়াগো এত বেহারাপনা ভালা না। তোরা পরের ঘরে যাইয়া কী করবি? এত বেলেহাজ হইলে পরের ঘর করতে পারবি? মুরুব্বিগো কথা না মানলে এক দরজা দিয়া নিব, আরেক দরজা দিয়া বাইর কইরা দিব।’
এসব কথায় পাতার কিছু যায়-আসে না। সে হাতমুখ ধুয়ে পানসির পাশে বসে গল্প জুড়ে দেয়।
রান্না শেষ হলে দুধজান ভাতের হাঁড়ি ঘরে এনে গুতু ফকিরকে ভাত বেড়ে দেয়। গুতু ফকির পিঁড়িতে বসে বলে, ‘বড়ো গেদি, মাইঝা গেদি, ছোটো গেদি, তোরাও বস।’
‘তুমি আগে খাও। ওরা পরে খাইবো,’ বলে দুধজান। গুতু ফকির কচুশাক দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে ফেলে। দুধজান আবার ভাত দেওয়ার উদ্যোগ নিলে, গুতুর চোখ পড়ে ভাতের হাঁড়িতে। হাঁড়িতে ভাতের পরিমাণ খুবই কম। গুতু আবার ভাত নিলে বাকিদের একমুঠ করেও হবে না। এতক্ষণে বুঝতে পারে, মেয়েদের খেতে না বসার কারণ। বুকের ভেতরটা তার ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে। দুধজানের চোখ দুটো ছলছল করে নোনাজলে। বাবা-মায়ের মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকে তিনটি মলিন মুখ। সমস্ত ঘরে পিনপতন নীরবতা। ঠান্ডা ঝড় বয়ে যাচ্ছে পাঁচটি হৃদয়ের গহিন গাঙে। এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুুক্ষণ।
গুতু নোনাজলে ভেজা চোখ দুটো মুছতে মুছতে পাতাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমি এমুনি নিঃস্ব বাপ হইছি! তোরা এক লুকমা কইরা খাইয়া পানি খা।’
পাতার চোখে আষাঢ়ের ঢল। পানসির চোখেও ছিটেফোঁটা বৃষ্টি। পানসি পাতার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, ‘আমার আইজ ক্ষুধা নাই। তুই আর পুতি খা।’ বাড়ির সবারই জানা, পেট ভরে খেতে না পারলে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয় পাতা। কিন্তু আজ ব্যাপারটা অন্যরকম।
পাতা পানসির হাত ধরে বলে, ‘বড়ো বু, তুমি সবটুকু ভাত শাক দিয়া মাখাও। আমরা সবাই মিলা খাইমু।’ পানসি ভাত মাখিয়ে, প্রথম লোকমা পাতার মুখের দিকে তুলে দিলে বলে, ‘মাইয়ারে আগে দেও।’
‘না, তোরা খা মা,’ বলে দুধজান।
‘মাইয়া, তুই আগে এক লোকমা খা। তুই না খাইলে আমরা কেউ খাইমু না। তুই আমাগো জুন্যে কত কষ্ট করস? মাইয়া, আমি আর দুষ্টোমি করমু না। তুমি যা কইবা, আমি তাই শুনমু।’ বলে পাতা। মেয়ের ব্যথাভরা কথায় বানের মতো পানি উপচে পড়ে দুধজানের চোখে বেয়ে। অথালি-ঝড়ের তাÐব শুরু হয়েছে হৃদয়ের গহিনে। পাতাকে বুকের ওপর জড়িয়ে ধরলে শান্তির নহর নেমে আসে তার হৃদয়ের রুক্ষ ভ‚মিতে।
গভীর হয়ে আসে নিস্তব্ধ কালো রাত। ক্ষুধার জ্বালার দাপাদাপিও স্তিমিত হয়ে আসে; অনাহারী শুকনো মলিন চোখগুলিতে নেমে আসে নিদ্রা।
সবারই চোখে ব্যথাভরা বিষাদের ঘুম। শুধু ঘুম নেই পানসির রুক্ষ দুটো ভেজা চোখে। দাপড়াতে দাপড়াতে একসময় স্তিমিত হয়ে যায় ক্ষুধা নামক জন্তুটা। চোখের সামনে মেলে দেয় ধ্যানের জানালা। কষ্টের তামাটে মাটির গন্ধ বুকে নিয়ে ধ্বংসের কবর ডিঙিয়ে মুখ রাখে সে জানালায়। পানসির চোখে-মুখে ঝলমল করে ওঠে রংধনুর সাত রং। অনাহারী হৃদয়ে পাঁজরে যেন সে পুষে রেখেছে পুষ্পের ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণে জেগে ওঠে স্বপ্নের নতুন বসতভ‚মি গহরকে ঘিরে।
বিজন রাতের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপন শেষে ভোরের স্নিগ্ধ আভায় চোখ মেলে নির্ঘুম পানসি। সজীব ভোরের সঙ্গে মিতালিতে মেতে ওঠে সে। কুয়াশাকাতর উষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আসমানের নীলিমায়। আজ তার কাছে ভোরের আসমান বর্ণময় রঙিন-বিষাদ চেতনার নীলে ছাওয়া। আলো-আঁধার লুকোচুরি খেলতে-খেলতে বাহিরবাড়ি এসে বসে পড়ে, কদমতলে সবুজ গালিচায়। উদাস চোখে সে তাকায় সবুজ বনভ‚মিতে। কানের ভেতর বেজে ওঠে নির্ঘুম বাঁশির সুর। আকাশের আঙিনায় উড়ছে অসহায় গাঙচিলটি। সবুজ বনভ‚মি থেকে নীল আসমানে উঁকি মারে পানসির দুটি চোখ। খাড়া হয়ে ওঠে কান দুটি। আরো গভীর হয়ে কানে বাজতে থাকে বাঁশির সুর। নিরাপদ আশ্রয়ের তৃষ্ণায় চোখ মেলে, তন্ন-তন্ন করে খুঁজে ফেরে গাংচিলটি। আসমানে ঠোঁট রেখে বলে, খড়কুটো বিছানো একটুখানি ঘর দাও, আমার নির্ঘুম রাতের অবসান করো। রোদে পোড়া মনটা জুড়িয়ে দাও, নির্জন ঘরের সুশীতল ছায়াতলে। আরো মায়াবী ও গভীর হয়ে ভেসে আসে বাঁশির সুর। পানসির দৃষ্টি আসমান থেকে প্রতিফলিত হয়, দক্ষিণের খোলা মাঠে। একি! বাঁশিওয়ালা আর কেউ নয়, তার স্বপ্নের মানুষ, গহর।
গহরের নির্ঘুম রাতের না-বলা কথাগুলো সুর হয়ে আছড়ে পড়ে পানসির হৃদয়গাঙে। দুটি হৃদয় যেন জড়াজড়ি করে বলছে, দিঘল রাতের না-বলা সমস্ত কথা, উষ্ণ সুন্দর সকালে। গুতু ফকির ফজরের নামাজ পড়ে এসে পানসির পাশে বসে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘মা রে, তোর মুখটা কেমুন শুকনা হইয়া গেছে। শরীরডা কাহিল। কাইল তো কিছু খাওয়া হয় নাই।’
পানসি বাপের মাথায় রেখে বলে, ‘বাজান, আমি ভালা আছি। জোয়ান মানুষ। এক দিন না খাইলে কী হয়? তুমি চিন্তা কইরো না।’
এ সময় জাগিরা উঠানে দাঁড়িয়ে ডাকে, ‘গুতুচাচা, ও গুতুচাচা, বাড়ি আছো?’
গুতু ওখান থেকেই জবাব দেয়, ‘কারা? এই দিকে আয়।’
‘চাচা, আমি।’ এক হাতে কলাপাতায় লবণ আর ফালি-ফালি করে কাটা আদা, আরেক হাতে এক কোষ্ঠা পাট।
‘চাচা, কাইল রাইতে সাপের বাতাস লাগছে। মাথা ঠিক রাখতে পারি না। ঘুইরা পইড়া যাই। বমিও হইছে কয়েকবার।’
গুতু পাটের কোষ্ঠায় ফুঁক দিয়ে গলায় পড়িয়ে দেয়। আদা ও লবণে ফুঁক দেয়। জাগিরার মাথাটা ধরে ঝাড়ফুঁক দিয়ে বলে, ‘লবণ-আদা যতটুকু পারো খাও। আর বাকিটুকু পরে খাইবা। যাও, ঠিক হইয়া যাইবো।’
দুধজান উদাস হয়ে বসে থাকে ছায়লাঘরে। হাতে শূন্য ভাতের হাঁড়ি। বেদনায় নড়ে ওঠে জাগিরার ভেতরটা। গুতুর সংসারে ঠিকমতো খাবার জোটে না, তা জাগিরার অজানা নয়। জাগিরার আপন বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়ে-শাদিও করেনি। খুব সাদাসিদে সে। সবাই নানাভাবে তার সঙ্গে দুষ্টুমি করে। তার উপাধি পাগলা জাগির।
এতে সে খ্যাপে না কখনো। দুধজানের করুণ মুখটা শেলের মতো আঘাত হানে তার হৃদয়ে। জাগিরা চলে যায় এবং কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। হাতে গামছার পুঁটুলি। ‘চাচি, ধরো, চাইল। ভাত পাক কইরা খাও। তোমার মুখ দেইখা বুঝছি। কাইল রাইতে খাওন হয় নাই।’
দুধজান জাগিরাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বাজান, তোরে মানুষ পাগল কয়। তোর ভিতরে যে এত দরদ, এইডা কেউ জানে না।’ বন্যায় ভেসে যায় দুধজানের শুকনো চোখ দুটো।
‘চাচি, তুমি তো আমার মায়ের মুতন। আমার মা নাই। তুমিই আমার মা। তোমার কোনো সমস্যা হইলে নিজের পোলা মুনে কইরা কইবা।’
পাতা ঘর থেকে বের হয়ে বলে, ‘জাগিরাভাই, খোদা তোমায় ভালা করব। কাইল সারা দিন পরে রাইতে এক লুকমা ভাত খাইছি। অখন নড়াচড়া করতে পারি না।’ মাকে বলে, ‘মাথা ঘুরতাছে মাইয়া, তাড়াতাড়ি ভাত পাক করো।’
‘চাচি যাই। মনু মিয়ার বাড়ি যাইমু।’ বলে জাগিরা চলে যায়।

মনু মিয়ার ছোট্ট ছনের ঘর। একচিলতে ভিটে। এই ভিটেটুক ছাড়া আর কিছুই নেই তার। পরের জমিতে শ্রম বিক্রি করে। তবে সে জন্মের অলস। এক দিন কাজ করবে তো অন্যদিন করবে না। স্বভাবটা উড়–উড়–। খেয়ে-না-খেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয় আর তাস খেলে দিন পার করে। তাই সংসারে অভাব-অনটন লেগেই আছে তার। একদিকে অভাব, অন্যদিকে সন্তান না হওয়ার কষ্ট। এর জন্য ঘরে এসে বউকে বকাঝকা করে। এমনকি মারধরও করে। এভাবেই কাটছে মনু মিয়া ও জয়তুনের সংসার। মনু মিয়া বলে, ‘জয়তুন, বিদেশি কুটুম রূপী আইবো। তোর আন্ডা পাড়া কালা কুরকাডা (মুরগি) জবাই কইরা পাক (রান্না) কর।’ জয়তুনের মুখটা কালো হয়ে যায়। তবু সে মুরগিটা ধরে। বলে, ‘জবাই কইরা দেন। কতগুনা আন্ডা বেইচা সদাই কিনা খাইছি। কুরকাডা ল²ী আছাল।’
মনু মিয়া ভেংচি দিয়ে বলে, ‘রাখ তোর ল²ী। তোর ঘরে তুই নিজেই তো পোড়াকপাইলা অল²ী। কুরকা ল²ী হইলে তোর লাভ কী? ল²ী কুরকা কি তোরে সন্তান দিব? নিজের মুরাদ হইল না একটা বাচ্চা দেওয়ার। আঁটকুড়া ম্যায়ালোকের মুখে আবার কথা।’
জাগিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনু মিয়ার কথা শোনে। জয়তুনের জন্য ভেতরটা কেঁপে ওঠে তার। মন খারাপ করে ফিরে আসে সে। মনু মিয়ার ঘরে প্রবেশ করতে তার রুচিতে বাধে। মানুষ এত জঘন্য হয় কী করে! জয়তুন মুরগি কাটছে। দুচোখে তার শ্রাবণের ধারা। মাঝেমধ্যে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছে, নাক মোছে আর মুরগি কাটে।
মনু মিয়া জয়তুনের গালে থুকনা মেরে বলে, ‘এই আটকুঁড়া অল²ী, কান্দন মারাও ক্যা? কাম কর। চোখের আলুনি (আহ্লাদি) পানি দেখার সুময় নাই আমার। পাক যান ভালা হয়। না হইলে খবর আছে।’
মনু মিয়া উঠানে পায়চারি করতে থাকে। জয়তুন ছায়লাঘরে রান্নায় ব্যস্ত। মনের ভেতর তার ভয়। পাক ভালো না হলে তুলকালাম কাÐ ঘটাবে। হঠাৎ মনু মিয়ার হৃদয়ের ঘুঘুটা খুশিতে নেচে ওঠে। মনু ও জয়তুনের মধ্যে এতক্ষণ যেন কিছুই হয়নি, মনু এমনভাবে দরদ মাখানো গলায় বলে, ‘জয়তুন দেখো, কারা আইতাছে!’
জয়তুন ছায়লাঘর থেকে বের হয়ে রাস্তার দিকে তাকায়। ‘আল্লা, ওডা কী? অমুন ক্যান? গায়ে পোলাগো গেঞ্জি আর পিন্দিছেও পোলাগো ফুলপ্যান্ট।’
‘আরে, তুই কী বুঝবি? হে তো বিদেশি মেম। বিদেশে ম্যায়ারা অমন পোশাক পিন্দে।’ দুজনের আলাপচারিতার মধ্যে রূপী এসে হাজির হয়।
‘কি মনুভাইয়া, খুব রোমান্টিক গল্প হচ্ছে বুঝি?’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই, প্রশ্ন করে, ‘এটা ভাবি?’
‘হ, আমার বউ, জয়তুন।’
‘বাহ্, নামটা বেশ সুন্দর। ভাবি দেখতেও কিন্তু চমৎকার।’
জয়তুন লজ্জা পেয়ে ঘোমটা টেনে দেয়। মনু বলে, ‘বসেন, মেম সাহেব।’
রূপী টুলের ওপর বসে। জয়তুন খাবার তৈরি করতে করতে রূপীর বেশভ‚ষা দেখে আর ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায়।
রূপী বলে, ‘মনুভাইয়া, আমাকে তুমি সন্বোধন করবেন। আপনে বললে, পরপর লাগে।’
মনুর পালটা প্রশ্ন, ‘আমার বেলায়ও তাই।’
মুচকি হেসে রূপী বলে, ‘ঠিক আছে। তা-ই হবে।’
‘রূপী, আমার বিদেশ যাওয়ার খুব শখ। তুমি যেভাবেই পারো আমার জুন্যে চেষ্টা করো।’
‘মনুভাইয়া, শোনো। এখন পুরুষদের বিদেশ যেতে লাগে ২ লক্ষ টাকা। আর বেতন ৮-১০ হাজার টাকা। তার মধ্যে নিজের থাকা-খাওয়া। শেষে দেখা যাবে মাস শেষে ৫-৬ হাজার টাকা থাকবে। তবে ভালো কাজ শিখে যেতে পারলে ভালো বেতনে চাকরি পাবে। তুমি ড্রাইভিং শেখো। আমি তোমার জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা করব।’
একটু থেমে রূপী আবার বলে, ‘মনুভাইয়া, তোমাকে প্রথম দেখার পর থেকে মনে হয় কত আপন। কত যুগের পরিচিত আমরা। তোমার চেহারাটাও আকর্ষণীয়!’ মনুর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, ‘তোমার হাত দুটো কত সুন্দর!’ মনু মিয়ার চোখ-মুখ ঝিলমিলিয়ে ওঠে রংধনুর সাত রঙে। মনুর কাছে এটা বিশাল স্বপ্ন। রূপীর মতো মেয়ে তাকে এত…!
জয়তুন খাবার নিয়ে আসে।
‘ভাবি, এত লাজুক কেন? বসুন। একসাথে খাব।’
জয়তুন জড়সড়ো হয়ে বলে, ‘আপনে খান। আমি পরে খাইমু।’
‘ভাবি, আপনাকে বসতেই হবে। খাব আর বিদেশের গল্প করব।’
মনু মিয়াও ভদ্রলোকের মতো সুন্দর করে বলে, ‘জয়তুন বসো। বিদেশি কুটুম তোমারে পছন্দ করছে। এইটা তোমার জুন্যে সৌভাগ্য।’
রূপী শুরু করে বিদেশের গল্প। ‘ভাবি, আমাদের দেশ বড়ো বড়ো গাছপালা ঘেরা সবুজ। কিন্তু আরবে তেমন বড়ো গাছ নেই। কোনো-কোনো জায়গায় ছোটো-ছোটো কাঁটাবন। বালি আর পাথর দিয়ে ঘেরা রুক্ষ ভ‚মি। আকাশ ধূসর বর্ণের। ধূসর আকাশের তলে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষহীন উলঙ্গ ভ‚মি। অথচ ওই রুক্ষ মরু দেশ, স্বর্গের দেশ। কী আরামে সেখানে থাকা যায়। গরমের দিনে সব সময় ঠান্ডা থাকে এসির কারণে। আর শীতের দিনে গরম থাকে, রুমহিটারের কারণে। ভাবি, আপনি কষ্ট করে পাটায় মসলা পিষলেন, চুলায় খড়ি দিয়ে ভাত রান্না করলেন, চোখমুখে ধোঁয়া লাগিয়ে এই পাখা দিয়ে বাতাস দিচ্ছেন। এগুলি সব কাজ সেখানে যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয়।’
গল্প শুনতে শুনতে জয়তুনের জড়তা কমে আসে। প্রশ্ন করে, ‘বুজি, তাইলে তো বিদেশ আরামের জীবন।’
‘ভাবি, ঠিক বলেছেন। বিদেশ তো স্বর্গরাজ্য। তিন মাসের ছুটিতে এসেছি। এক মাস হয়ে গেল। আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। কী গরম!’
‘বুজি, একটা কথা জিগাই?’
‘বলেন, ভাবি।’
‘আপনের বিয়া হয় নাই?’
‘না ভাবি। দেশে আসার পর বিয়ের জন্যে সবাই পাগল হয়ে গেছে। অনেকগুলি বিয়ের প্রস্তাবও এসেছে। কিন্তু আমার পছন্দ হয়নি।’ মনু মিয়ার দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলে, ‘একজনকে মনের ভিতর পুরেছি। দেখা যাক কী হয়।’
‘বুজি, আপনে তো বিদেশি মেম হইছেন। তাই তো দেশের পোলা পছন্দ হওয়ার কথা না। তয় বিদেশের পোলা একটা ধইরা নিয়া আসলেই হইতো।’
রূপী খিলখিল করে হেসে ওঠে। ‘ভাবি, আপনি তো বেশ মজার। ভাবি, চলেন, আপনাকে বিদেশ নিয়ে যাই।’
‘বুজি, কী যে কেন! আমার মুতন পোড়াকপাইলা অল²ীরে বিদেশে নিবো, কারা?’
‘আমি নিয়ে যাব। কে বলেছে আপনি পোড়াকপাইলা, আপনি তো রাজকপালী।’
‘বুজি, আমি বিদেশে কী করমু? আমি তো লেখাপড়া জানি না।’
‘কোনো অসুবিধা নেই। আপনি বাসাবাড়িতে চাকরি করবেন। আমি শিখিয়ে দেব তাহলেই পারবেন।’
‘বুজি, আপনের মাথা কি ঠিক আছে? সংসারের কামকাজ করলেই আমারে টাহা দিব?’
‘ভাবি, বিদেশ হলো স্বপ্নরাজ্য। ওই দেশে গেলে সব স্বপ্ন পূরণ হবে। বিদেশে সংসারের কাজের অনেক দাম। আমাদের দেশে সংসারের কাজ কোনো কাজই না।’
মনুকে লক্ষ্য করে রূপী বলে, ‘মনুভাইয়া, তোমার বউকে বিদেশ পাঠাবে? ভাবি বিদেশ থেকে টাকা পাঠাবে। সেই টাকা দিয়ে ড্রাইভিং শিখে তুমিও চলে আসবে।’ রূপী কথাগুলি বলে আর মিটিমিটি রহস্যময় হাসি দিয়ে মনুর দিকে তাকিয়ে থাকে। রূপীর চোখের রহস্যময় তির্যক রশ্মিতে মনুর হৃদয়ে সুনামি বয়ে যায়। সুনামির আঘাতে মনুর শিরা-উপশিরা পর্যন্ত নড়ে ওঠে। তার পরান জু