পেছনে হাঁটছে গণতন্ত্র : ফ্রিডম হাউস

40

বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যে নতুন মেরুকরণের ফলে আগের তুলনায় বেশি দেশ এখন কর্তৃত্ববাদী শাসনের পথে যাচ্ছে, আর তাতে গণতন্ত্র পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে বলে উঠে এসেছে ফ্রিডম হাউসের এক প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই পর্যবেক্ষক ও গবেষণা সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের জায়গাগুলো ক্রমাগত সঙ্কুচিত হচ্ছে। ফ্রিডম হাউসের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সূচকে প্রতি বছরই বৈশ্বিক গড় স্কোর কমছে। তাদের বিচারে, ২০১৮ সালে ৫০টি দেশে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা বেড়েছে, তার বিপরীতে কমেছে ৬৮টি দেশে।
বিশ্বের ১৯৫টি দেশ ও ১৪টি অঞ্চলের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ‘ফ্রিডম অব দি ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফ্রিডম হাউস। খবর বিডিনিউজের
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আগের চেয়ে বেশি দেশে এখন কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে। বিরোধী মতকে দমন করা হচ্ছে, তাদের নেতাদের বন্দি করে রাখা হচ্ছে। স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণও অব্যাহত রয়েছে’। এই প্রবণতার কারণ খুঁজতে গিয়ে ফ্রিডম হাউস বলছে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের কথা।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পথে সত্তরের দশক থেকে দেশে দেশে গণতন্ত্রের মুক্তির পথ তৈরি হতে শুরু করে। ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর এবং ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউরোপের পাশাপাশি দুই আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পথ সুগম হয়।
১৯৮৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই পরিবর্তনের চিত্র ধরা পড়ে ফ্রিডম হাউসের সূচকে। ‘গণতান্ত্রিকভাবে মুক্ত নয়’ এমন দেশের হার ওই সময়ে ৩৭ শতাংশ থেকে কমে ২৩ শতাংশ হয়। আর ‘গণতান্ত্রিকভাবে মুক্ত’ দেশের হার ৩৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ৪৬ শতাংশ। ফ্রিডম হাউস বলছে, ওই অবস্থা থেকে বিশ্ব এখন উল্টো পথে হাঁটছে। ২০০৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ‘গণতান্ত্রিকভাবে মুক্ত নয়’ এমন দেশের হার বেড়ে হয়েছে ২৬ শতাংশ। আর ‘মুক্ত’ দেশের হার নেমে এসেছে ৪৪ শতাংশে।
‘বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যে যে পরিবর্তন আসছে, তার সঙ্গে এ সঙ্কটের যোগসূত্র রয়েছে। শিল্পোন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর হাতে যে ক্ষমতা এতদিন কেন্দ্রীভূত ছিল, চীন, ভারতসহ নতুন অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর উত্থানে সেই আধিপত্যে ক্ষয় ধরেছে’।
এই পরিস্থিতিকে বিশ্বায়নের একটি নতুন পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করে ফ্রিডম হাউস বলছে, নতুন অর্থনৈতিক শক্তির উত্থানে বিশ্বের বিভিন্ন অংশ বিপুল সম্পদের দেখা পাচ্ছে। কিন্তু সেই সম্পদের সুবিধা সবাই সমানভাবে পাচ্ছে না।
আবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে আস্থার সঙ্কট। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আদৌ তাদের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে কি না।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করা অনেক দেশকে এখন ব্যাপক দুর্নীতি, রক্ষণশীলদের আন্দোলন এবং সুশাসনের অভাবের কারণে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এর ফলে উগ্র ডানপন্থি ও জাতীয়তাবাদীরা সুবিধাজনক জায়গা পেয়ে যাচ্ছে। ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, অভিবাসীদের অধিকারের মত মৌলিক গণতান্ত্রিক চর্চার জায়গাগুলোতেও চাপ আসছে।
বাংলাদেশ এখনও ‘আংশিক মুক্ত’
একটি দেশের মানুষ কতটা রাজনৈতিক অধিকার ও কতটা নাগরিক স্বাধীনতা ভোগ করছে, তার ভিত্তিতে প্রতিটি দেশ ও অঞ্চলের ‘ফ্রিডম রেটিং’ ঠিক করা হয়েছে এ গবেষণায়। আর সেই রেটিংয়ের ভিত্তিতে দেশগুলোকে ভাগ করা হয়েছে ‘ফ্রি’, ‘পার্টলি ফ্রি’ ও ‘নট ফ্রি’- এই তিন ভাগে।
ফ্রিডম হাউসের বিচারে এবারও এ তালিকায় বাংলাদেশের স্থান হয়েছে ‘আংশিক মুক্ত’ দেশের তালিকায়। এ ধারণা সূচকের মূল দুই মানদÐ- রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা নিরূপণের ক্ষেত্রে কতগুলো প্রশ্নের ভিত্তিতে ১০০ নম্বরের মধ্যে একটি দেশের প্রাপ্ত স্কোর হিসাব করা হয়েছে। পরে মোট স্কোরকে রূপান্তর করা হয়েছে সাত ভিত্তিক একটি স্কেলে, যেখানে রেটিং ১ মানে সবচেয়ে ভালো গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি; আর ৭ মানে সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি। তারপর দুই মানদÐের রেটিংয়ের গড় করে ঠিক করা হয়েছে একটি দেশের ‘ফ্রিডম রেটিং’।
ফ্রিডম রেটিংয়ে একটি দেশের রেটিং ১ থেকে ২.৫ এর মধ্যে হলে তাকে ‘ফ্রি’, ৩ থেকে ৫ হলে ‘পার্টলি ফ্রি’ এবং ৫.৫ থেকে ৭ এর মধ্যে থাকলে ‘নট ফ্রি’ ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এবারের ‘ফ্রিডম অব দি ওয়ার্ল্ড’ প্রতিবেদনে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের স্কোর হয়েছে একশ’র মধ্যে ৪১। রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা- দুই মানদÐেই বাংলাদেশের রেটিং হয়েছে ৭ এর মধ্যে ৫।
ফলে ফ্রিডম রেটিংয়েও বাংলাদেশ ৫ পেয়েছে। এই হিসাবে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার দিক দিয়ে ‘আংশিক মুক্ত’ দেশ বলছে ফ্রিডম হাউস। গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশকে তারা এই ক্যাটাগরিতে রেখেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পুলিশি দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভোটের দিনও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘাতের তথ্য এসেছে, ডজনখানেক লোকের প্রাণ গেছে সহিংসতায়’।
কার কি অবস্থান
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র ভারতকে গণতান্ত্রিকভাবে ‘মুক্ত’ দেশের তালিকায় রেখেছে ফ্রিডম হাউস। ভারতের মোট স্কোর ৭৫, ফ্রিডম রেটিং ২.৫। ৫৯ স্কোর ও ৩.৫ রেটিং নিয়ে ভুটান, ৫৬ স্কোর ও ৩.৫ রেটিং নিয়ে শ্রীলঙ্কা, ৫৪ স্কোর ও ৩.৫ রেটিং নিয়ে নেপাল, ৩৯ স্কোর ও ৫ রেটিং নিয়ে পাকিস্তান, ৩৫ স্কোর ও ৫ রেটিং নিয়ে মালদ্বীপ এবং ৩০ স্কোর ও ৫ রেটিং নিয়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের মতো ‘আংশিক মুক্ত’ দেশের তালিকায় রয়েছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ২৭ স্কোর ও ৫.৫ রেটিং পাওয়া আফগানিস্তান গণতান্ত্রিকভাবে ‘মুক্ত নয়’ বলেই ফ্রিডম হাউস মনে করছে। এবারের সূচকে ইউরোপের তিন দেশ সুইডেন, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড ১০০ তে ১০০ স্কোর নিয়ে ১ নম্বর রেটিংয়ে রয়েছে। আর সবচেয়ে বাজে অবস্থায় থাকা সিরিয়ার স্কোর শূন্য, রেটিং ৭।
গণতান্ত্রিকভাবে মুক্ত নয়- এমন দেশের তালিকায় রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, ইরান, তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্র ‘মুক্ত’ দেশের তালিকায় থাকলেও গণমাধ্যমের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক ভূমিকা এবং অভিবাসীদের ক্ষেত্রে তার ‘অন্যায্য’ নীতির কারণে সেখানে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছে ফ্রিডম হাউস।
এ সংস্থার প্রেসিডেন্ট মাইকেল জে আব্রামোভিচ বলেন, ‘এ থেকে সবচেয়ে বড় যে বিপদের সংকেত আমরা পাচ্ছি, তা হলো, আমেরিকার গণতন্ত্র চিরকাল টেকসই হবে- সে নিশ্চয়তা নেই, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট পদে যদি এমন কেউ থাকেন, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি যার ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ নেই’।