পেঁয়াজ নিয়ে অদৃশ্য ব্যবসা করলে কঠোর ব্যবস্থা

48

পেঁয়াজের বাজারে চলমান অস্থিরতা নিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার আমদানিকারক, কমিশন এজেন্ট ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। তবে এ সভায় উপস্থিত ছিলেন না চট্টগ্রামের আমদানিকারকরা। আর এ নিয়ে জেলা প্রশাসক জানান, ‘তারা সভায় কেন আসেননি এবং ভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে পেঁয়াজ আমদানি করছেন কী না তা খতিয়ে দেখবো।’
অন্যদিকে পেঁয়াজের পাইকারিতে কিছু নিয়ন্ত্রণে থাকলেও খুচরা বাজারে লাগাম টানা যাচ্ছে না। ভারতের পেঁয়াজ পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি ৮৫ টাকা বিক্রি করলেও খুচরা বাজারে ১০৫ টাকায় বিক্রি করছে। আবার খাতুনগঞ্জে প্রশাসন মনিটরিংয়ে থাকলে পাইকারিতে দাম কমে এবং মনিটরিং শেষ হলে পুনরায় বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ খুচরা ব্যবসায়ীদের।
জেলা প্রশাসক বলছেন, পেঁয়াজ বিক্রিতে অতিরিক্ত মুনাফা বা সিন্ডিকেট করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে উক্ত মতবিনিময় সভায় আমদানিকারকরা উপস্থিত না থাকলেও পেঁয়াজের পাইকারী আড়তদার, কমিশন এজেন্ট এবং ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমদ বলেন, আমাদের দেশে যখন পেঁয়াজের উৎপাদন বেশি হয়, তখন ভারতেও উৎপাদন বেশি থাকে। তাই তখন আমদানি করতে সমস্যা হয় না। আবার এখানে সংকট দেখা দিলে ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানিও কমে যায়। সুতরাং আমাদের দেশে পেঁয়াজের আরও উৎপাদন বাড়াতে মনোযোগ দিতে হবে। তাহলে কোনো অসাধু ব্যক্তি এমন কারসাজি করতে পারবে না।
এসময় তিনি টিসিবির মাধ্যমে সরকারকে পেঁয়াজ বিক্রি বাড়ানোর তাগিদ দেন। পাশাপাশি দিনের বেলায় পেঁয়াজের ট্রাক প্রবেশে অনুমতি প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, ব্যবসায়ীরা কার থেকে (আমদানিকারক) পেঁয়াজ কিনছেন তা বললে সমস্যা কোথায়। এখানে এতো লুকোচুরি কেন? আমার মনে হয় সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য একটি চক্র কাজ করছে। তারা চায় সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হোক।
প্রতিউত্তরে জেলা প্রশাসক বলেন, এ সভায় জেলা পুলিশ, সিএমপি এবং হাইওয়ে পুলিশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত রয়েছেন। সবাইকে অনুরোধ করবো- পেঁয়াজের গাড়ি যাতে ২৪ ঘণ্টা সড়কে চলতে কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
বন্দরের কাস্টমসে দ্রুত পণ্য খালাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম কিংবা টেকনাফের বন্দর দিয়ে যেসব পেঁয়াজ আসছে, তা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যাতে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে খালাস করে দেন সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা তাদেরকে বিষয়টি জানাবো। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের বিরুদ্ধেও কিছু অভিযোগ পেয়েছি। এসব অভিযোগ যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক বলেন, পাইকারি ও খুচরা দোকানে মূল্য তালিকা প্রদর্শন বাধ্যতামূলক। কমিশন এজেন্টদের দোকানে অবশ্যই আমদানিকারকের নাম ফোন নম্বর ও রশিদ রাখতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসন ও মন্ত্রণালয় আমদানিকারকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করবে। আমরা যদি হোয়াটস অ্যাপে চাই তাহলে সাথে সাথে পাঠাতে হবে।
তিনি বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে অদৃশ্য ব্যবসা করা যাবে না। অদৃশ্য ব্যবসা মানে কালোবাজারি। এটা হলে অবশ্যই অ্যাকশন নেওয়া হবে। আমরা ব্যবসায়ীদের প্রতিপক্ষ নই, তাদের সহায়ক। যখন মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে তখনই আমরা ব্যবস্থা নিই। অতি মুনাফা চাই না, আবার কারও ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হোক সেটাও চাই না।
চট্টগ্রামের আটটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে পেঁয়াজ আমদানির তালিকায়। সেগুলো হলো- এফ এইচ এ ট্রেডার্স, ফরহাদ ট্রেডিং, এম এন্ড এম ট্রেডিং, শওকত এন্টারপ্রাইজ, আরটিএস ট্রেডিং এজেন্সি, মেসার্স এ আর ট্রেডার্স, মেসার্স বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল এবং প্রগ্রেস ট্রেড ওভারসিজ। এসব প্রতিষ্ঠানের কেউ প্রশাসনের বৈঠকে উপস্থিত হননি।
পরে সেসব আমদানিকারকদের অফিসে যান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম। সেখানে গেলে প্রগ্রেস ট্রেড ওভারসিজের মালিক পেঁয়াজ আমদানি করার বিষয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিতভাবে জানান যে, গত বছরের (২০১৮) জুন মাস হতে আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত কোন পেঁয়াজ আমদানি করেননি। শওকত এন্টারপ্রাইজের মালিক জানান, গত ৯ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে ২১ টন পেঁয়াজ আমদানি করার পরে আর কোন পেঁয়াজ আমদানি করেননি। এ আর ট্রেডার্সের মালিক জানান, গত ৬ জানুয়ারির আগে পেঁয়াজ আমদানি করলেও তারপর থেকে কোন প্রকারের আমদানি করা হয়নি। বাকি আমদানিকারকদের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানালেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, তাদেরকে সভায় আহব্বান করার পরও কেন আসেনি তার জন্য আগ্রাবাদের আশপাশে অবস্থিত তাদের অফিসে গিয়েছিলাম। পরে তারা আমাদের লিখিত আকারে আমদানি না করার বিষয়টি জানালেন।
ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম আরও বলেন, গত মঙ্গলবারে যখন খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারে গিয়েছিলাম তখন ৪২ টাকার পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি করাতে জরিমানা করেছিলাম। তারপরে তারা ভারতের পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় নিয়ে আসে। কিন্তু তারা যদি ফের দাম বাড়িয়ে দেন তাহলে অবশ্যই ডিসি স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে সরেজমিনে খাতুনগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পাইকারিতে প্রতিকেজি ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায় আর মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।
এ ব্যাপারে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি সোলায়মান বাদশা বলেন, পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক হলে এমনিতেই দাম কমে যাবে। এখন যে দাম বেশি তার অন্যতম কারণ হচ্ছে সরবরাহ নেই আর যা আছে তা আনতে আনতে পচে যাচ্ছে। সেজন্যেই ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করছে।
তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষের কতটুকু পেঁয়াজ দরকার তার আগাম ব্যবস্থা নেয়া উচিত সরকারের। তারপরই সংকটের সময় সেটিকে কীভাবে মোকাবেলা করা উচিত তার প্রস্তুতি নিলে আজকে এ দশা হতো না।
প্রশাসন যদি বারবার ভ্রাম্যমাণ আদালত করে আমাদের জরিমানা বা সিলগালা করে দেয় তাহলে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ বিক্রি ছেড়ে দিবে। অন্যান্য মসলা বিক্রি করবে বলেও জানান এ ব্যবসায়ী নেতা।
এদিকে খুচরা দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিকেজি ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি করছে ১০০ টাকা থেকে ১০৫ টাকা আর মিয়ানমারের পেঁয়াজের মূল্য ভারতের পেঁয়াজ থেকে পাঁচ টাকা কম।
আন্দরকিল্লা এলাকার খুচরা দোকানি মো. মামুন বলেন, এক বস্তা পেঁয়াজ কিনলে দুই থেকে তিন কেজি পচে যায়। তাহলে ক্ষতির দায়ভার তো আমরা নিবো না। আর পাইকারিতে ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট করলে দাম কমায় আর ম্যাজিস্ট্রেট চলে গেলে দাম বাড়িয়ে দেয়। তাই আমরাও যে দামে কিনি তার থেকে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দিয়ে বিক্রি করি।
তবে ভোক্তা সাধারণ জানান, পেঁয়াজের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারের আরও কঠোর হওয়া উচিত।