পেঁয়াজ আমদানিতে নিয়ন্ত্রণহীন এলসি, ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে

41

ভারত থেকে রপ্তানি বন্ধের পর দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম তিনগুণ থেকে চারগুণ বেড়ে যায়। পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খুলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু পেঁয়াজের ঘাটতি মিটাতে নিয়ন্ত্রহীণভাবে এলসি প্রদান করায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক আমদানিকারক দেউলিয়া হওয়ার পথে। এ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সামনে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা আমদানি করা থেকে মুখে ফিরিয়ে নেবেন। এতে বাজারে সংকট লেগে থাকবে। ব্যাপক ক্ষতি হবে ভোক্তা সাধারণের।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনিটরিং করলে ব্যবসায়ীরা এতো ক্ষতি হতো না। আর বাজারেও পেঁয়াজ নিয়ে এতো অস্থিতিশীলতা বিরাজ করতো না। বাজার নিয়ন্ত্রণ না থাকায় চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেড়েছে। এতে বাজারে ‘ক্রেতাশূন্য’ অবস্থ বিরাজ করছে। পেঁয়াজ পচে যাওয়া ও আমদানি মূল্যের চেয়ে অর্ধেক মূল্যে বিক্রি করায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। তাই এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর বিশেষ প্রণোদনার দাবি করেন ব্যবসায়ীরা।
সরকারি হিসেবে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৩ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। তবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর প্রায় ১৯ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ থাকে। অথচ চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজের। বাকি ১১ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়, যার বেশিরভাগই ভারত থেকে আসে।
তবে সেখান থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। কারণ মিয়ানমার, তুরস্ক বা মিশর থেকে পেঁয়াজ আনতে হলে অনেক সময় লেগে যায়। এসব দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য পৌঁছতে ১৫ থেকে ২০ দিন বা একমাস সময় লেগে যায়।
এবার আমদানিকারকরা পেঁয়াজের দাম ঊর্ধ্বমুখি থাকা অবস্থায় বেশিরভাগ এলসি খুলেছে। তখন বাজারে পেঁয়াজের সংকট ছিল প্রকট। বিকল্প দেশের আমদানিকৃত পণ্য সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দাম কমে যায়। তাই এখন আমদানিকারকরা কেনা দামের চেয়ে অর্ধেক কমে পেঁয়াজ বিক্রি করছে।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর উদ্ভিদ সংঘ নিরোধ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বুলবুল জানান, সেপ্টম্বর থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত আমদানি অনুমতিপত্রের বিপরীতে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা ৬৬ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজের পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে ছাড়পত্র ইস্যু করা হয়েছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রে থেকে এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৮ হাজার ১৮৪ মেট্রিক টন পেঁয়াজের আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১ দেশ থেকে পেঁয়াজ এসেছে, তার সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে পাকিস্তান, মিশর, চীন, তুরস্ক ও নেদারল্যান্ডস থেকে। এখন আর কেউ আমদানির জন্য অনুমতি নিচ্ছে না, তবে আগের অনুমতি নেওয়া পেঁয়াজ আসা অব্যাহত রয়েছে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও আমদানিকারক মো. মহিউদ্দীন বলেন, গত অক্টোবরে পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খুলেছি। গত সপ্তাহ থেকে বিভিন্ন সময়ে আমদানি পণ্য খাতুনগঞ্জে ঢুকে। বন্দরে অনেক পণ্য পড়ে আছে, বিক্রি করতে পারছি না। আর যা খালাস করে এনেছি, তা অর্ধেক মূল্যে আড়তদারকে বিক্রি করতে হয়েছে। অনেক টাকা ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের কাছে দাবি, প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ কোন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। একই সাথে ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ করে আবার স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা আমদানি করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
আমদানিকারক মো. আবুল বশর বলেন, মিশর ও চায়না থেকে ৫০০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়ে ছিলাম। প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানির খরচ পড়েছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। কিন্ত আড়তদারকে বিক্রি করতে হয়েছে ২২ থেকে ২৩ টাকা দরে। আর আমদানি করা ৫ থেকে ৬ কন্টেইনার পেঁয়াজ বন্দরে পড়ে আছে, বিক্রি হচ্ছে না। পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দুশ্চিতায় আছি।
একইভাবে পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বশর মোল্লা বলেন, সরকার বলছে পেঁয়াজ আমদানি করতে। এখন পেঁয়াজ আমদানি করে ক্ষতির মুখে পড়েছি। আমদানি করা পেঁয়াজ বন্দরে পড়ে আছে। বন্দর থেকে খালাস করে আনবো, গাড়ি ভাড়া পর্যন্ত হবে না। আড়তদারের কাছে অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
পেঁয়াজের সংকট নিরসনে সরকারের আহŸানে সাড়া দেন চট্টগ্রামের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রূপ। এ গ্রূপের কমার্শিয়াল জিএম আকতার হাসান বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ৫০ হাজার টন পেঁয়াজের আমদানির অনুমতি নিয়েছিলাম। এখন পর্যন্ত ৩৩ হাজার ৫০০ টন পেঁয়াজ পুরোটাই শিপমেন্ট হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় আছে ১৩ হাজার টন। আর টিসিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৫ হাজার ২০০ টন।
তিনি বলেন, প্রতিকেজি পেঁয়াজে আমদানির খরচ পড়েছে ৪৫ টাকা, তবে আমরা সরকারকে ৪০ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি করেছি।
খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, সরকারের কাছে কোন পরিসংখ্যান নেই। সরকার তো বড় বড় গ্রূপকে আমন্ত্রণ করছে। তাদের কথা তো আলাদা। আর সরকার নিজেও টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আনছে। কিন্তু কি পরিমাণ পণ্য আনার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, আর কি পরিমাণ নিচ্ছে, এসব তথ্য সরকারের কাছে থাকা উচিৎ।
তিনি বলেন, পেঁয়াজের সংকটকালীন মূহুর্তে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের অনেক বড় ভ‚মিকা রয়েছে। কিন্তু এসব ব্যবসায়ীদের দিকে সরকারের কোন নজর নেই। তারা পেঁয়াজ আমদানি করে একদম লাশ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের টাকা পর্যন্ত দিতে পারছে না।