বিশ্বের বহু মানুষ তাদের খাবার রসনায় পেঁয়াজকে অনুষঙ্গ হিসাবে রাখলেও বাঙালির খাদ্য-সংস্কৃতির রন্ধনশিল্পে এটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। বাংলা ও ভারতের সাথে সুদূর প্রাচীনকালে প্রাচ্য ও পশ্চিমের বাণিজ্য সম্পর্কেও অন্যতম পণ্য ছিল পেঁয়াজ ও অন্যান্য মসল্লা। বিশেষ করে শাক-সবজি, মাছ, মাংস রান্নায় প্রধান উপাদানের একটি হচ্ছে পেঁয়াজ। এই পেঁয়াজ নিয়ে প্রায় দুইমাস বাজারে চলছে অস্থিরতা। এ অস্থিরতা থামাতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস্তবে পেঁয়াজের দাম এখন সোনার হরিণকে হার মানাচ্ছে।
গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে হঠাৎ ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর আমদানিনির্ভর এই দেশে পেঁয়াজের মূল্য ঊর্ধ্বগতি ধারণ করে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদসূত্রে জানা যায়, ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ টাকা। রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির পর দাম বেড়ে হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এরপর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির উদ্যোগ নেয়া হলেও সব উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিয়ে এখন এই পেঁয়াজ প্রায় তিন গুণ দামে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় উঠে এসেছে। যদিও পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা কমার সংবাদ পাওয়া গেছে কিন্তু এর প্রভাব খুচরা বাজারে এখনো পড়েনি। প্রশ্ন হচ্ছে, এত চেষ্টা ও আমদানি তৎপরতার পরও কেন পেঁয়াজের দাম নেমে আসছে না? ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ার পর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তুরস্ক ও মিসর থেকে আমদানি করা হয়েছে। একই সঙ্গে মিয়ানমার থেকে যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে, তাতে বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এতে পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল তো হয়ইনি বরং লাফিয়ে লাফিয়ে আরো বেড়েছে। ২৫-৩০ টাকার পেঁয়াজ ৫০-৬০ টাকা থেকে পর্যায়ক্রমে ১০০ টাকায় এসে কিছুটা থিতু হয়েছিল। ভোক্তা সাধারণ ভেবেছিলেন এখান থেকেই বুঝি পেঁয়াজের দাম নিম্নমুখী হবে। কিন্তু না, সর্বসাধারণের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে পেঁয়াজের দাম এখন ১৫০ টাকায় এসে ঠেকেছে। এ অবস্থায় দেশের প্রধান মসল্লার পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের নিয়ে বৈঠকে বসেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সাথে সাথে প্রশাসন পেঁয়াজের আড়ত ও পাইকারি দোকানে অভিযান করে কয়েকজন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছেন।
প্রশাসনের এসব উদ্যোগ কিছুটা ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন প্রশাসন ও ভোক্তা সাধারণে। জানা যায়, বৈঠকে খুচরা পর্যায়ে আগামী দুই-তিনদিনের মধ্যে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকার নিচে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন আড়তদাররা। পাশাপাশি কাগজ ছাড়া আমদানিকারকদের কাছ থেকে আর পেঁয়াজ না কেনার অঙ্গীকারও করেছেন তারা। পেঁয়াজের বাজার তদারকি করতে একটি মনিটরিং টিম গঠনেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সভায়। এ বৈঠক আরো আগেই হওয়া প্রয়োজন মনে হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় এ উদ্যোগের জন্য জেলা প্রশাসন প্রশংসা পেতে পারেন। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে কঠোর মনোভাব সভায় দেখানো হয়েছে তা মাঠ পর্যায়ে কার্যকর করতে পারলে পেঁয়াজের দাম আবারও সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে- তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আমরা লক্ষ্য করে আসছি, সরকার পেঁয়াজের উচ্চমূল্যের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট ও মজুতদারদের বিষয়ে বেশ নজরদারিতে আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে সিন্ডিকেটের সাথে জড়িতদের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। এসংবাদ প্রকাশের পরপর প্রশাসনের দ্রæত অভিযান খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের কিছুটা নমনীয় হতে বাধ্য করেছে। আমরা মনে করি, প্রশাসনের এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীরা কোন রকম সহযোগিতা না করলে দেশবাসীর সামনে পেঁয়াজ কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার। অভিযান চালানো দরকার তাদের গোপন গোডাউনগুলোয় এবং এই পেঁয়াজের উচ্চমূল্যের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে দ্রæত বিচার আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও নিশ্চিত করা জরুরি। নচেৎ এসব মোনাফালোভী ব্যবসায়ীদের দমানো সম্ভব হবে না।