‘পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যা’

22

৩২ বছর আগে লালদীঘি মাঠ এলাকায় শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে গুলি করে ২৪ জনের হত্যার ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছে আদালত। সিএমপি’র তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে এবং কোতোয়ালী থানার পেট্রল ইন্সপেক্টর গোবিন্দ চন্দ্র মÐলের হুকুমে এই হত্যাকাÐ হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন বিচারক। ফলে ঘটনার ৩২ পর প্রমাণিত হল এটি একটি গণহত্যা।
আদালত পাঁচ আসামির মৃত্যুদÐের রায় ঘোষণা করেন। দÐিতরা হলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালি অঞ্চলের তৎকালীন পেট্রোল ইনসপেক্টর গোবিন্দ চন্দ্র, কন্সটেবল মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মো. আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন। এদের মধ্যে প্রথম জন পলাতক।
আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা বলেন, দেরিতে হলেও বিচার হয়েছে, এটা দৃষ্টান্ত।আদালতে সাক্ষীদের দেওয়া সাক্ষ্যের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, এই হত্যাকাÐের লক্ষ্য ছিলেন সে সময়ের আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
আইনজীবীরা জানান, চান্দগাঁও থানার তৎকালীন ওসি সাহাবুদ্দিন তার সাক্ষ্যে বলেন, ঘটনার আগের দিন সে সময়ের পুলিশ কমিশনার রকিবুল হুদা লালদীঘি সমাবেশে বলপ্রয়োগের কথা বললে অন্য কর্মকর্তারা বিরোধিতা করেছিলেন। তখন রকিবুল হুদা ক্ষিপ্ত হয়ে গালিগালাজ করেন।
‘বিভিন্ন কারণে’ মামলাটির বিচার কাজ শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগলেও সন্তুষ্টি জানিয়েছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরাও।
রায় ঘোষণা আগে সাক্ষীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনার একটি চিত্র তুলে ধরে বিচারক বলেন, এটা ‘মাস কিলিং’ (গণহত্যা)। আদালত বলেন, যা জানতে পেরেছি, সে সময়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দর থেকে পথসভা করতে করতে লালদীঘির দিকে আসছিলেন। জেলা পরিষদ এলাকায় পেশাজীবীদের সাথে মতবিনিময় হওয়ার কথা ছিল।”
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বন্দরনগরীর লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগের জনসভার দিন বেলা ১টার দিকে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাক আদালত ভবনের দিকে এগোলে নির্বিচার গুলি ছোড়া শুরু হয়।
আইনজীবীরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে ঘিরে মানববেষ্টনি তৈরি করে তাকে নিরাপদে আইনজীবী সমিতি ভবনে নিয়ে যাওয়ায় তিনি রক্ষা পান। কিন্তু ২৪ ছাত্র-জনতার প্রাণ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়।
ওই দিনের ঘটনার চিত্র তুলে ধরে বিচারক বলেন, (শেখ হাসিনার আসার) পথে তিনটি ব্যারিকেড দেওয়া হয়- কোতোয়ালী মোড়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ও লালদীঘি এলাকায়। কৌশলে প্রথম ব্যারিকেডটি সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর তারা (শেখ হাসিনার গাড়ি বহর) ভেতরে ঢুকলে জে সি মÐল ওয়ারলেসে জানায়, চলে আসছে।
“মীর্জা রকিবুল হুদা (সিএমপি কমিশনার) ওয়াকিটকির মাধ্যমে নির্দেশ দেয়, গুলি করে শোয়াইয়া ফেল, গুলি করে হামাইয়া ফেল (শেষ করে দাও)।”
রাষ্ট্রপক্ষে নিযুক্ত মামলার প্রথম কৌঁসুলি স্বভু প্রসাদ বিশ্বাস বলেন, ‘আদালত বলেছেন পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার উদ্দেশে জনগণের ওপর আঘাত করা হয়েছে। ঘটনার একদিন আগে অর্থাৎ ১৯৮৮ সালের ২৩ জানুয়ারি এই ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালত বলেছেন, এটি পরিকল্পিত গণহত্যা।’
আলোচিত এই মামলায় রায়ের শুধু সারসংক্ষেপ পাঠ করেছেন আদালত। সারসংক্ষেপে আদালত বলেন, ‘চট্টগ্রামের তদানীন্তন সিএমপি কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা কর্তৃক ওয়াকিটকির মাধ্যমে প্রদত্ত অবৈধ নির্দেশে কোতোয়ালী থানার পলাতক আসামি গোবিন্দ চন্দ্র মÐল ওরফে জে সি মÐলের অবৈধ হুকুমে আসামিগণ এলোপাতাড়ি রাইফেলের গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে। উক্ত আসামির নির্দেশে নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করলে মিছিলকারীদের মধ্যে ২৪ জন মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে হত্যাকাÐ সম্পর্কিত সাক্ষ্যপ্রমাণাদি গোপন ও বিনষ্ট করার জন্য নিহতদের মৃতদেহ ধমবর্ণ নির্বিশেষে অনেক মুসলিম ও হিন্দুদের তাদের আত্মীয়স্বজনের অগোচরে কোতোয়ালী থানার অন্তর্গত অভয়মিত্র শ্মশানঘাটে পোড়াইয়া ফেলে।’
সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, ‘ঘটনার তারিখ ও সময়ে ঘটনাস্থলে আসামি গোবিন্দ চন্দ্র মÐল, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর বিনা উসকানিতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শত, শত নিরীহ লোককে আহত ও পঙ্গু করে।’
রায় ঘোষণার সময় আদালত বলেন, ‘এটা গণহত্যা। বিভিন্ন কারণে এই মামলা বিঘ্নিত হয়েছে। ৫৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। সাক্ষ্যপ্রমাণে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দর থেকে ট্রাকে করে বিভিন্ন জায়গায় পথসভা করতে করতে লালদীঘির দিকে আসছিলেন। লালদীঘির মাঠে ছিল তৃতীয় কর্মসূচি এবং চতুর্থ কর্মসূচি ছিল পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়। ওইসময় পুলিশ তিনটি ব্যারিকেড দেয়। একটি ছিল লালদিঘীতে, একটি কোতোয়ালীর মোড়ে এবং আরেকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে। কোতোয়ালীতে প্রথম ব্যারিকেড সরিয়ে গাড়িবহর এগিয়ে যাবার পর জে সি মÐল ওয়াকিটকিতে বলেন, চলে আসছে। তখন পুলিশ কমিশনার ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দেন, হামাইয়া দাও, গুলি করে শোয়াইয়া দাও। কমিশনারের নির্দেশে গুলিতে ২৪ জন নিরীহ ছাত্র-জনতা মারা যান। শেখ হাসিনাকে আইনজীবীরা উদ্ধার করে আদালত ভবনে নিয়ে যান।’
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপত্তার কারণে আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসতে পারেননি উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘চার জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পরিষ্কার হয়েছে, কোনো ধরনের সহিংস ঘটনার আগেই হত্যাকাÐ ঘটানো হয়েছে।’