পুলিশ-ছাত্রলীগ সংঘর্ষে চবি ক্যাম্পাস রণক্ষেত্র

140

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্রলীগের একাংশের ডাকা ছাত্র ধর্মঘটে পুলিশ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ক্যাম্পাস। এ ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মী, পুলিশসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ, জলকামান ব্যবহার, টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। ঘটনাস্থল থেকে দুইজনকে আটক করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশসহ ১৪ জন আহত হয়েছে। গতকাল রবিবার বেলা পৌনে ১২ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। প্রায় ৪৫ মিনিট পর পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ৭ টার দিকে নগরীর বটতলী স্টেশন থেকে চবির শাটল ট্রেনের চালককে অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ভোর রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় রুটের শাটল ট্রেনের হোসপাইপ কেটে দেয়া হয়।
সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে ১৪ জনের নাম পাওয়া গেছে। আহতরা হলেন-বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী গোলাম আজম আকাশ, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ফয়সাল আহমেদ, ইংরেজি বিভাগের মাইন উদ্দিন হাসান ও শাহরিয়ার, ইতিহাস বিভাগের আজাদ, নাট্যকলা বিভাগের আওয়াল হোসেন সোহাগ, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ফাইজুল করিম, ইয়াছিন আরাফাত, দোকানি মো. আব্দুল আজিজ ও জামাল উদ্দিন এবং পুলিশ সদস্য শরীফ, সাব্বির, ফরিদ আহমেদ ও আমিনুর রশিদ।
বিশ্ববিদ্যালয় স‚ত্র জানায়, গত ৩১ মার্চ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের বগি ভিত্তিক সংগঠন বিজয় ও সিএফসি গ্রæপের নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়ায়। পক্ষ দুটিই শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। টানা তিন দিনে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ অন্ততঃ ২০ নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এ সময় পাঁচটি আবাসিক হলে অভিযান চালিয়ে বিপুল সংখ্যক দেশীয় অস্ত্রসহ দুটি আগ্নেয়াস্ত্র, ১২৬ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পর গত মঙ্গলবার রাতে ছাত্রলীগের উভয় পক্ষের ছয় কর্মীকে আটক করে দেশীয় অস্ত্র আইনে মামলা দেয়া হয়। এ ঘটনার আটককৃতদের নিঃশর্ত মুক্তিসহ চার দফা দাবিতে রবিবার থেকে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘটে ডাক দিয়েছিল ছাত্রলীগের বিবাদমান পক্ষ দু’টি।
ধর্মঘটের সমর্থনে সকাল পৌনে ৯টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট এলাকায় প্রধান ফটক বন্ধ করে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা আটককৃত ছয় নেতাকর্মীর মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের পদত্যাগ, গত চার বছরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নামে দেওয়া বিভিন্ন মামলা প্রত্যাহার- এ চার দফা দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। বেলা ১১ টার দিকে শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সিনিয়র নেতাকর্মীরা পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বাসের কথা নেতাকর্মীদের জানিয়ে রাস্তা ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে এসে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা প্রদানের দাবি জানেিয় রাস্তা ছাড়তে নারাজি জানান।
পরে বেলা পৌনে ১২ টার দিকে পুলিশের একটি জলকামান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের জন্য প্রধান ফটক খুলতে চাইলে আন্দোলনকারীরা বাধা দেয়। এসময় পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। পুলিশের লাঠিচার্জে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হল সড়ক, কাটা পাহাড় সড়ক ও শিক্ষক ক্লাব সড়কে অবস্থান নেয়। দুই ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করা হয়। এসময় ছাত্রলীগের ছোড়া ইটের আঘাতে ডিবি পুলিশের একটি গাড়ি, জিরো পয়েন্টের পুলিশ বক্স, মহিলা সংসদ ও শিক্ষক ক্লাব ভাঙচুর হয়। ছত্রভঙ্গ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল ও বোতল নিক্ষেপ করলে জবাবে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ছুড়ে। প্রায় ৪৫ মিনিট পর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের আবাসিক হলে ঢুকিয়ে দেয় পুলিশ। পরে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আসে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। পুরো সংঘর্ষে ২৫-৩০ নেতাকর্মী আহত হয়েছে বলে দাবি ছাত্রলীগের।
অপর দিকে চার পুলিশ সদস্য হালকা আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মশিউদ্দোলা রেজা। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারা অবরোধ করলে, আমরা তাদের দাবি মেনে নেয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছি। আমরা তাদের বুঝিয়ে বলেছি, নেতারাও আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন। কিন্তু কিছু বহিস্কৃত উশৃঙ্খল ছাত্র উস্কানি দিয়ে সংঘর্ষ বাধায়। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। দু’জনকে আটক করা হয়েছে, যাচাই-বাছাই করে ছেড়ে দেয়া হবে’।
আটককৃতরা হলেন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের মোকলেসুর রহমান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের একই বর্ষের মো. রমজান আরিফ।
শাটল ট্রেন বন্ধ, অচল ক্যাম্পাস :
এদিকে ধর্মঘটের শুরুতে সকাল সাড়ে ৭ টার দিকে নগরীর বটতলী স্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ট্রেনের লোকোমাস্টার আবদুল জলিলকে তুলে নিয়ে যায় একদল ছাত্র। এর আগেই ভোর রাতে শাটলের হোস পাইপ কেটে দেয়া হয়। ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তরে থাকা শিক্ষক বাসে সুপার গ্লু লাগিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দোকান মালিক সমিতিকে ডেকে সব বন্ধ রাখতে বলে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলগেট এলাকা থেকে সিএনজি অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয় ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসে অভ্যন্তরে চলাচলকারী রিকশা ও জোবাইক সার্ভিসও বন্ধ ছিল। এছাড়া কাটা পাহাড় রাস্তা দিয়ে শিক্ষার্থীদের চলাচলে বাধা দেয়া হয়। শাটল ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়ার ফলে এক প্রকার অচল ছিল ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগ-ইনস্টিটিউটের পূর্ব নির্ধারিত ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ট্রেন ছাড়ার প্রস্তুতির সময় একদল ছাত্র লোক মাস্টারকে তুলে নিয়ে যায়। পরে ট্রেন না চালাতে বলে ছেড়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সমাধানের বিষয়ে জানালে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সহসভাপতি এনামুল হক আরাফাত বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছিল। কিন্তু পুলিশ বিনা উস্কানিতে বর্বরোচিত হামলা চালায়। এতে আমাদের ২৫-৩০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। আমাদের পূর্ব ঘোষিত অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের কর্মসূচি চলবে। আমাদের নেতাকে বিষয়টি জানিয়েছি। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তা-ই চূড়ান্ত’।
আন্দোলনের পেছনে ষড়যন্ত্র দেখছেন উপাচার্য :
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়াগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছি। কিন্তু গুটি কয়েক শিক্ষার্থীদের কাছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জিম্মি হতে পারে না। এ ঘটনার পেছনে প্রশাসন ও সরকার বিরোধী লোকদের উস্কানি আছে। এর পেছনে কারা ইন্ধন দিচ্ছে- তদন্ত করে বের করে আনার আহব্বান জানাচ্ছি সরকারের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আজগর চৌধুরী বলেন, ‘একটি পক্ষ ফেসবুকে গুজব ছড়াচ্ছে, আলাওল হলের পেছন থেকে যে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, ছয় ছাত্রের বিরুদ্ধে এ অস্ত্রের জন্য মামলা করা হয়েছে। এটি বিভ্রান্তি কর। দেশীয় অস্ত্রের জন্য মামলা দেয়া হয়েছে। গত এক মাসে এই দু’টি পক্ষ সংঘাতে জড়িয়েছে। বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে অনেক বার। কিন্তু তারা বলে, মারের বদলে মার। তারা সংঘর্ষের সময় প্রতিপক্ষ সন্দেহে শিক্ষার্থীর ওপর হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করেছে। পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। এরপরও আমরা বলেছি, আটককৃতরা যদি নির্দোষ হয়, তবে আমরা সকল সহযোগিতা করব। তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে চেয়েছিল, আমরা বাধা দেইনি। কিন্তু রাতের আধারে শিবির স্টাইলে পরিবহন পুলের গাড়িতে সুপারগগ্লু, অনুষদের তালায় সুপারগ্লু লাগানোসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচ লাখ টাকার সম্পদের ক্ষতি করা হয়েছে’।