পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় বালাকোটে জবাব পাকিস্তানের জন্য চরম শিক্ষা

42

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

পাকিস্তান লালিত জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি কনভয়ের ওপরে হামলা চালিয়ে ৪০ জনের বেশি সিআরপিএফ সদস্যকে হত্যা করে বলে ওই সংগঠনটি নিজেরাই দাবি করেছিল। তারপর থেকেই ভারতের নানা মহল থেকে দাবি উঠছিল যে ওই হামলার কড়া জবাব দেওয়া হোক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বলেছিলেন ওই হামলা যারা করেছে, তারা বড় ভুল করেছে এবং এর জন্য তাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে। এরপর ভারত সরকার সরাসরি হামলাতে না গিয়ে বারবার জঙ্গীদের অবস্থানের কথা জানিয়ে আসছিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান কৌশলে জঙ্গীদের মদদ দিয়ে যাচ্ছিল। এতে অবশ্য ভারত বিমানবাহিনী চরম শিক্ষা দিয়েছে।
একই মাসের ২৬ তারিখ ভোররাতে পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর জইশ-ই-মোহাম্মদ এর জঙ্গিশিবিরে বোমাবর্ষণে ৩শ থেকে ৪শ সদস্য নিহত হয়। আর হ্যাঁ, বালাকোটের ওই শিবিরটিই ছিল জইশ-ই-মোহাম্মদের সবচেয়ে বড় প্রশিক্ষণ শিবির। এমন জঙ্গীনিধন কর্মযজ্ঞে পাকিস্তানের চুপ থাকা ছাড়া কিছু করার ছিল না। কেননা ভারত শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগোয়নি, যুগের তালমিলিয়ে বৈশ্বিক সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে ভারত।
অন্যদিকে, পাকিস্তান বলেছিল যে আক্রান্ত হলে তারাও বসে থাকবে না। দুটো দেশের হাতেই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী এই দুই বৈরী দেশের কার কেমন সামরিক শক্তি রয়েছে ? গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সামরিক শক্তির দিক থেকে বিশ্বের ১৩৬টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান চতুর্থ, অন্যদিকে পাকিস্তানের অবস্থান সতেরোতম। এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে ৫৫টির বেশি উপাদান বিবেচনায় নিয়ে। ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, স্থানীয় শিল্প, প্রাকৃতিক সম্পদ, কর্মক্ষমতা এবং প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্বের দেশের মর্যাদার বিষয়গুলো এখানে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। জনসংখ্যার দিক থেকে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে ভারত। পাকিস্তানের জনসংখ্যা যেখানে সাড়ে ২০ কোটি, সেখানে ভারতের জনসংখ্যা ১২৮ কোটির বেশি। পাকিস্তানের সৈন্য সংখ্যা ৯ লাখ ১৯ হাজার হলেও ভারতের সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি- ৪২ লাখ। প্রতিরক্ষা বাজেটের দিকে নজর দিলে ব্যাপারটা আরও সহজ হয়ে উঠবে। ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট চার হাজার ৭০০ কোটি ডলার, অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ রয়েছে ৭০০ কোটি ডলার। সামরিক বিমানের সংখ্যা: ভারতের মোট সামরিক বিমান রয়েছে ২ হাজার ১৮৫টি, আর পাকিস্তানের রয়েছে ১ হাজার ২৮১টি বিমান। এসবের মধ্যে ভারতের যুদ্ধবিমান রয়েছে ৫৯০টি আর পাকিস্তানের ৩২০টি। সেই সঙ্গে ভারতের আক্রমণকারী বা অ্যাটাকিং বিমান রয়েছে ৮০৪টি, অন্যদিকে পাকিস্তানের আছে ৪১০টি। পরিবহনের জন্য ভারতের রয়েছে ৭০৮টি বিমান, পাকিস্তানের রয়েছে ৪৮৬টি। এসব ছাড়াও সামরিক খাতের প্রতিটি সূচকে ভারত এগিয়ে। তাই হয়ত সেই সময় পাকিন্তার পাল্টা আক্রামণ করার সাহস পায়নি। আমরা যদি আরও পেছনে ফিরে থাকায় তাহলে দেখতে পাবো। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাস। অপরাজনীতির শিকার হয়ে একই ভূমিতে গড়ে উঠল দুটি রাষ্ট্র। একটি অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ লালনকারী ভারত, অপরটি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানো ধর্মীয় গোঁড়ামির দেশ পাকিস্তান। রাষ্ট্র পরিচালনার এ উদ্দেশ্যগত পার্থক্যই বিগত দশকগুলোতে দেশ দুটির মাঝে তৈরি করেছে বিস্তর ব্যবধান। পাকিস্তান বিশ্বের বুকে পরিচিতি পেয়েছে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে, আর বিশ্বের নেতৃত্ব নিকট ভবিষ্যৎে ভারতের হাতে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ পরিবর্তন কীভাবে এল তা বুঝার সহজ উপায় হলো ভারত আর পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে কোথায় বিনিয়োগ করছে তা বিশ্লেষণ করা। পাকিস্তানের জঙ্গীবাদের বিপরীতে ভারত বিনিয়োগ করেছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোর মতো জন উন্নয়নমূলক খাতে, তারপরও পাকিস্তানের জঙ্গীবাদী কার্যক্রম প্রতিহত করতে গিয়ে ভারতকেও সামরিক খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হয়েছে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী জঙ্গীবাদের বিস্তার কেবল ভারত, বাংলাদেশ বা বিশ্বের অপরাপর দেশের জন্যই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে তা নয়, পাকিস্তান এখন তার সৃষ্ট জঙ্গীবাদের গর্তে পড়ে নিজেই অসহায় হয়ে পড়েছে। খোদ দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আনন্দবাজারের সাথে সাক্ষাৎকারে শিকার করেছেন দেশটিতে ‘৩০-৪০ হাজার’ জঙ্গীর উপস্থিতির বিষয়টি। যদিও সংখ্যাটি আরো বড় হওয়ার পক্ষেই মত বেশি।
সাক্ষাৎকারটিতে ইমরানের দাবি করেন জঙ্গীবাদ প্রতিহতে তার সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে, যদিও এর স্বপক্ষে এখনো গুরুত্বপূর্ণ কোন সাফল্য পাকিস্তান দেখাতে পারেনি বলেই প্রতীয়মান হয়। বরঞ্চ পুরো পৃথিবীজুড়ে জঙ্গী রপ্তানি করছে দেশটি। ফলে ভারতের উন্নতি আর পাকিস্তানের পতন অনেকটা ব্যস্তানুপাতিক।
এবার একটু ভিন্ন দিকে থাকায়, যেখানেও তাদের জঙ্গী লালনের প্রমাণ পাওয়া যাবে।
গত এক দশক আগেও পলেস্তারা খসা, বিবর্ণ, ধুঁকতে থাকা স্কুলগুলো এখন ঝাঁ চকচকে। ক্লাসরুমে বসেছে প্রজেক্টের, ডিজিটাল বোর্ড, তৈরি হয়েছে গবেষণাগার। রয়েছে সুইমিং পুল। তৈরি হচ্ছে জিম, বাস্কেটবল কোর্ট, অডিটোরিয়াম। দিল্লিতে বন্ধ হওয়া ১৯ টি সরকারি স্কুলের পড়ুয়ারা এখানে পড়ছেন। অরবিন্দ কেজরীবালের শাসনে এটা অধিকাংশ সরকারি স্কুলের গড় ছবি। যে কারণে বেসরকারি স্কুল ছেড়ে সরকারি স্কুলে পড়তে ভিড় করছেন নিম্ন থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারের পড়ুয়ারাও। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। শিক্ষাক্ষেত্রে এমন নজির ঘটিয়েছে দিল্লির সরকার। আর যাঁর হাত ধরে এটা সম্ভব হয়েছে, তিনি হলেন আতিশী মারলেনা। তাঁর পরামর্শেই দিল্লি সরকার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে করে ২৪ শতাংশ। ২০১৯ -২০ সালে শিক্ষায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মোট বাজেটের প্রায় ২৬ শতাংশ। বিপুল বরাদ্দ হয় স্কুলগুলির পরিকাঠামো উন্নয়নে। চালু হয় মিশন বুনিয়াদ, যোগাযোগ বাড়ে স্কুল, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে। ৫০০০০ শিক্ষক শিক্ষিকা মিলে তৈরি করেন ‘হ্যাপিনেস কারিকুলাম’। রেজাল্টে সরকারি স্কুল পেছনে ফেলে প্রাইভেট স্কুলগুলিকে। যার ছোঁয়া পুরো ভারতবর্ষজুড়ে বয়ছে। শিক্ষায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ, সৃজনশীল উদ্যোগ এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন উপমহাদেশের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। শুধুমাত্র শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, স্যানিটেশন ক্ষেত্রেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে ভারত সরকার। ঠিক একই বিষয়ে পাকিস্তানের দিকে নজর দিলে সহসায় দেখা মিলবে ২শ মাদ্রাসা বন্ধ হয়েছে। কমেছে শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ। শুধু সামরিক বা শিক্ষাখাতে নয়, পুরো বিশ্বজুড়ে দৃষ্টান্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে ভারত। আর পুরো বিশ্ব যখন জঙ্গি-সন্ত্রাস নিমূর্লে বন্ধপরিকর তখন পাকিস্তান জঙ্গির তৈরির কারখানায় পরিণত হচ্ছে। হয়ত এমন দিন বেশি দূরে নয়, যখন পুরো বিশ্ববাসী পাকিস্তানকে জঙ্গীবাদের জন্য বয়কট করবে।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক