পুরুষ নির্যাতন : সমাজ কি এড়িয়ে যাচ্ছে?

263

বিশ্বের অনেক দেশে কিছু বেসরকারি সংগঠন ১৯ নভেম্বর ‘আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস’ পালন করে। বাংলাদেশে এই উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে ‘বাংলাদেশ মেন’স রাইট্স ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন। ঢাকায় মানববন্ধনের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জেও কর্মসূচি পালন করেছে এই সংগঠনটি, যাদের দাবি ‘বাংলাদেশে পুরুষরাই বেশি নির্যাতিত হয়’। আর সে কারণে তারা মনে করেন ‘পুরুষ নির্যাতন’ প্রতিরোধে আইনি সুরক্ষা থাকা দরকার।
সংগঠনের সভাপতি শেখ খায়রুল আলম বলেন, তারা মৌখিক ভিত্তিতে জরিপ করেছেন ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে- আশি ভাগ পুরুষই নানাভাবে নির্যাতনের শিকার। বিশেষ করে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েও তারা তা বলতে পারেন না। এছাড়া মামলা বা প্রতারণা শিকার তো অনেকেই হচ্ছেন।
শেখ খায়রুল আলম বলেন, তিনি নিজেও ব্যক্তিগত জীবনে ‘ভুয়া’ যৌতুক মামলার শিকার হয়ে জেল খেটেছেন, হয়রানির শিকার হয়েছেন। এক মামলায় জামিন নেয়ার পর আবার নারী নির্যাতনের মামলা করেছিলো। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে এই অভিযোগের তদন্তে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি। তারপরও আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে। তারপর আমি ৭৭ দিন হাজত খেটেছি, বিনা অপরাধে। খবর বিবিসি বাংলার
নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকার অধিবাসী ইমরান হাসান বলেন, বিয়ের নামে তিনি প্রতারণার শিকার হয়ে উল্টো মামলার মুখে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিয়ে করেছিলাম ২০১৮ সালে। মেয়ে ছিলো আমেরিকান নাগরিক। তথ্য গোপন করে সে আমাকে বিয়ে করেছিলো। পরে সে আরেকজনকে বিয়ে করে আমেরিকা চলে যায় এবং সেখান থেকে ১০ লাখ টাকা দাবি করে। এক পর্যায়ে আমি ডিভোর্স দিলে আমার নামে যৌতুক ও নারী নির্যাতনের মামলা করে। আমার বাবা, মা ও আমার নামে ওয়ারেন্ট করালো। শেষে খোরপোশের মামলা। এখনো মামলা চলমান আছে। আরও কয়েকটি থানায় আমার নামে অভিযোগ করেছে’।
মাজেদ ইবনে আজাদ নামে আরেকজন বলেন, আমি প্রেম করে দুঃসম্পর্কের এক মামাতো বোনকে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু এক বছর পর আমার স্ত্রী আমাকে পরিত্যাগ করেছে। সে আরেকজনকে বিয়ে করার জন্য গোপনে আমাকে ডিভোর্স দিলো। তার সাথে আগে থেকেই তার সম্পর্ক ছিলো। সে যদি তাকেই বিয়ে করবে তাহলে আমার সম্মান নষ্ট করলো কেনো? এমনকি আমার বিরুদ্ধে পরে পর্ণোগ্রাফীর মামলা করেছে। আমি পুলিশকে জানিয়েছি। আমি তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
‘বাংলাদেশ মেন’স রাইট্স ফাউন্ডেশন’ এর সভাপতি শেখ খায়রুল আলম বলেন, নারীদের যেমন আইনি সুরক্ষা আছে পুরুষদেরও নির্যাতন থেকে সুরক্ষার জন্য তেমন আইন দরকার। তিনি বলেন, আমরা চাই প্রচলিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ও যৌতুক আইনের সংশোধন করা হোক। এখন অভিযোগ করলেও সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে ব্যবস্থা নেয়া হয়। ফলে এটি পুরুষদের হয়রানির একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, নারী নির্যাতন ও যৌতুক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া দরকার ও কেউ মিথ্যা মামলা করেছে প্রমাণ হলে তার কঠিন শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা থাকা উচিত। কেউ বিনা অপরাধে জেল খাটালে ক্ষতিপূরণসহ শাস্তি দিতে হবে এবং সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যাবে না। এবং কোনোভাবেই সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া শাশুড়ি, ননদ, শ্বশুর বা দেবরকে আসামি করা যাবে না।
তার দাবি অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মাকে পরিত্যাগের জন্য অনেক স্ত্রী চাপ দিয়ে থাকেন যা একজন পুরুষের জন্য বড় মানসিক নির্যাতন। তাই এটি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
সমাজ কি এড়িয়ে যাচ্ছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, পুরুষরা নির্যাতনের শিকার হতে পারেন, তবে কতটা হচ্ছেন তা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি বা গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত এখনো নেই। তবে মনে রাখতে হবে আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। এখানে কিন্তু ব্যক্তি পুরুষের কথা বলা হচ্ছে না। অনেক পুরুষই সমতার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তবে সমাজে কিছু প্রচলিত ধারণা আছে যেমন পুরুষের কান্না করা মানায় না বা বিয়ের সময় বলা হয় ছেলে কি করে আর মেয়ে দেখতে কেমন। এগুলো পুরুষতান্ত্রিকতারই ফল।
সালমা আক্তার বলেন, ‘পুরুষরা নির্যাতনের শিকার হলে সেটিও মানবাধিকার ইস্যু। তবে দেখতে হবে কি কারণে হচ্ছেন। তিনি কি পুরুষ দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন নাকি নারীর দ্বারা। শুধু নারী হওয়ার কারণে অনেক নারী যেমন সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। তেমনি পুরুষ যদি পুরুষ হওয়ার কারণে নির্যাতনের শিকার হন তাহলে এটাও জেন্ডার ইস্যু। একই সাথে দেখতে হবে পুরুষ নির্যাতনের শিকার হলে সেটি কি কারণে হচ্ছেন। সেটি কি অর্থনৈতিক নাকি অন্য কোনো কারণে। কারণ ও ধরণ বের করে সেভাবেই সেটিকে বিবেচনা করতে হবে। তবে সমাজে পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টিকে পুরোপুরি ফেলে দেয়া যাবে না। এর অস্তিত্ব স্বীকার করেই দেখতে হবে কতটা ব্যাপক ও এর কারণ ও ধরণ কি। তাহলেই বোঝা যাবে কোন ধরণের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কারণ কোনো ধরনের সহিংসতাকেই এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়’।
রংপুরে ‘বাংলাদেশ মেন’স রাইট্স ফাউন্ডেশন’ এর আইনি পরামর্শক রিজওয়ানা আখতার শিরিন বলেন, আমি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন পুরুষকে পেয়েছি যাদের নির্যাতিত বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। এমন অনেক ঘটনা পাচ্ছি যেখানে পুরুষরা নির্যাতিত হচ্ছেন। কিন্তু লজ্জায় বা ভয়ে বলতে পারছেন না। লোক হাসাহাসির ভয়ও কাজ করে তাদের মধ্যে। সম্প্রতি একটি ঘটনা পেয়েছি যেখানে স্ত্রী পরকিয়া করতে গিয়ে স্বামীর টাকা পয়সা নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে উল্টো নির্যাতন ও দেনমোহরের মামলা করেছেন। এমন নানা ধরণের ঘটনা আমরা এখন পাচ্ছি। এসব কারণেই আইনি সুরক্ষার দাবি জোরালো হচ্ছে যাতে পুরুষ অকারণে ভিকটিম না হন।