পুরুষের জীবনে ‘ব+উ’ অপেক্ষা ‘ব+ই’ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ

398

‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়া’র কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বই খানা অনন্ত যৌবনা।’ কবি ওমর খৈয়ম লিখেছিলেন এই কথাগুলো। তাঁর কথা একেবারে শতভাগ সত্যি; সুন্দরী প্রিয়তমা’র যৌবন একদিন হারিয়ে যাবে, কিন্তু বই অনন্ত যৌবনা, যার যৌবন কোনদিন হারিয়ে বা ফুরিয়ে যাবেনা।
এই সময়ে হঠাৎ অনন্ত যৌবনা বইয়ের কথা বলার মূল কারণ হচ্ছে, এই ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে চলছে বই মেলা। আর মাত্র কয়দিন পর এই মেলা শেষ হতে চলেছে। তাই বই মেলা প্রসঙ্গে কিছু বলতে গিয়ে ভূমিকায় লিখলাম এই কথা।
বই মেলা আমাদের জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যের একটি অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে স্থান করে নিয়েছে। যা ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকথা থেকে শুরু করে ’৭১ স্বাধীনতা পর্যন্ত সংগ্রামী দিনগুলো, আমাদের বারে বারে স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই বই মেলা ১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে, মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামনে বর্ধমান হাউজের বট তলায় প্রথম সুত্রপাত হয়। তিনি ঐ সময় এক টুকরো চটের উপর সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের স্বাধীনতা সম্পর্কীয় ৩২ টি বই সাজিয়ে শুরু করেছিলেন এই মেলা। আজ কালক্রমে সেই মেলা বিশাল আকারে রূপ নিয়েছে। এই সময়ের বইমেলায় আছে শত শত স্টল। এখন লেখক প্রকাশক পাঠক ও দর্শকের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে এই বইমেলা। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উৎসাহ ও উৎসব মুখর আনন্দের ঘনঘটা পরিবেশ।
চলতি বছর থেকে চট্টগ্রামে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন, জিমনেশিয়াম মাঠে অমর একুশে বই মেলা শুরু হয়। ১ম বারের মত অনুষ্ঠিত হওয়া এই মেলায় দেড় শতাধিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ গ্রহন করেছে এবং প্রায় সহস্রাধিক প্রকাশিত বই এনেছে। উল্লেখ্য চট্টগ্রামে অনেক বছর ধরে বিচ্ছিন্নভাবে বইমেলা হয়ে আসছিল। কিন্তু মেলা আয়োজক ও প্রকাশকের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের বিভক্তি, সমন্বয়ের অভাব ও কিছু অসঙ্গতির কারণে এবং মেলার কোন সুনির্দ্দিষ্ট তারিখ না থাকায় বই মেলাগুলো সাধারণ মানুষের মনে বিশেষ স্থান করে নিতে পারেনি। এবার থেকে চট্টগ্রামে প্রতিবছর ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে, যা আয়োজক কমিটি এমন সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে।
বাংলা একাডেমীর বইমেলার মত, নতুন শুরু হওয়া চট্টগ্রামের বইমেলাও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা সাধারণ পাঠকের উপস্থিতি, এটাই প্রমাণ করে। একটা সময় ছিল সাহিত্য চর্চার বিশেষ স্থান ছিল চট্টগ্রাম। অথচ সময়ের পরিক্রমায় অন্যান্য বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তর অধিদপ্তরের মত, বইমেলাও এখন রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। ১৯৯৭ সালে জীবনের প্রথম বারের মত ঢাকায় বাংলা একাডেমীর বই মেলায় গিয়ে, চট্টগ্রামেও এই রকম একটি বই মেলার অভাব অনুভব করেছিলাম।
প্রথম ঢাকা বই মেলায় যাবার প্রসঙ্গটা উল্লেখ না করলে, মনে কেমন জানি শূণ্যতা বা অপূর্ণতা থেকে যেতে পারে, যা আমার মনই আশঙ্কা করছে। সালটি ছিল ১৯৯৬ ইং; আমার লেখা কবিতা গুলো নিয়ে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের তীব্র আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বই প্রকাশের ভাবনা ভালোভাবে মাথায় ঝেঁকে বসে। প্রকাশনার বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ আমি। ১৯৯৭ সালে ঢাকার বই মেলায় গিয়ে প্রকাশক খুঁজতে থাকি। এসময় স্বাভাবিকভাবে ব্যর্থ হয়ে চট্টগ্রামে ফিরে আসি। শেষপর্যন্ত চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় সিগনেট প্রকাশনী নামে এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বত্ত¡াধিকারী পিকলু’র সাথে পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে বরিশালের আশীষ বসু নামে জনৈক প্রকাশককে, জীবনের প্রথম বই প্রকাশের জন্যে বিশ হাজার টাকা প্রদান করি। ১৯৯৮ সালে জীবনের প্রথম বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তাই খুশিতে চোখে ঘুম নেই, মুখে ভাষা নেই একেবারে আনন্দে আত্মহারা। সেই সময় ব্যয়বহুল মোবাইল চার্জ আর দুর্বল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঘন ঘন কথা বলে আশ্বস্ত হতে থাকি। তার থেকে বইয়ের প্রচ্ছদ সম্পর্কে ধারণা পেয়ে, নিশ্চিন্তে শতভাগ নিশ্চিত হয়। অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা ও কৌতুহল নিয়ে এই বছর (১৯৯৮ইং) বই মেলায় গিয়ে দেখি আমার কোন বই প্রকাশিত হয়নি। সব ঠিক ঠাক ছিল, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আশ্বস্ত করেছিল কিন্তু বই প্রকাশ করলনা, বিভিন্ন প্রকার অজুহাত দেখাতে থাকে। অতঃপর আরো অনেক চড়ায় উৎরায় পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালে আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়। ৫১টি কবিতা নিয়ে, প্রিয়’র প্রতি প্রীতি প্রিয়া’র নামে জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেল।
যা হোক, সেই সময় এভাবে পরপর তিন বছর এ্্ই বই মেলায় গিয়েছি। মেলায় বিভিন্ন লেখকের বই পড়া, মঞ্চে স্বরচিত কবি’র কবিতা আবৃত্তি বা বড় বড় লেখকের বক্তব্য শোনা ইত্যাদির কথা আজ মনে পড়ছে। তখন ভাবতাম চট্টগ্রামে যদি এই রকম একটা মেলা হত, ঢাকার মত চট্টগ্রামেও কিছু প্রকাশনী সৃষ্টি হত। সেই ১৯৯৭ সালের ঢাকার অমর একুশে বই মেলার ভাবনা, আজ চট্টগ্রামের বই মেলায় এসে অন্তত অনেকাংশ পূর্ণ হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
যাঁরা বই পড়েন, কিংবা যাঁরা বই পড়েননা, তাঁদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলি। আমাদের জানার পরিধি অসীম। প্রত্যেক দিন, প্রতিটি মুহুর্তে জ্ঞানের ক্ষেত্র প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের জানার আগ্রহ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সেই আগ্রহ ও কৌতুহল জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে পারে এক মাত্র বই। কর্মক্ষেত্রের অবসরে, ঘরে বা বাড়িতে, দুর ভ্রমণে গাড়িতে, কিংবা ঘুমানোর পূর্বে বই পড়ার আনন্দটা আলাদা। এই অনুভূতি বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে অনুভব করা যাবে, লেখার মাধ্যমে অন্যকে বোঝানো যাবে না। তাই আজকের এই দিনে আমার প্রত্যাশা থাকবে বই হোক সকলের জন্যে সকল সময়ের নিত্য সঙ্গী।
এই বইকে নিত্য সঙ্গী করার নিমিত্তে, আজকের এই দিনে সবার কাছে আমার একটা আবেদন থাকবে; আপনি বই কিনুন বা না কিনুন, অন্ততপক্ষে একবার বইমেলায় ঘুরে আসুন। আর মেলায় ঘুরতে এসে, বই পড়ুন বা না পড়ুন, অন্ততপক্ষে একটা বই কিনুন। সৈয়দ মুজতবা আলী বই কেনা প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরীর একটি কথা উল্লেখ করেছিলেন; ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়না। আইনের মৃত্যু হয়, বইয়ের মৃত্যু হয়না।’
এইতো গেল উনাদের কথা। আজকের এই দিনে আমার কথা হচ্ছে, মানব জাতিতে ধর্ম দল শ্রেণি মত বর্ণ নানান বিভক্তি ছাড়াও পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকারের মানুষ আছে। আবার এই সকল মানুষের মধ্যে অর্ধেক হচ্ছে পুরুষ। আমি মনেকরি সত্যিকার পুরুষের জীবনে ‘ব+উ’ অপেক্ষা ‘ব+ই’ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
একই সাথে বলতে চাই, যে পুরুষ জীবনে ‘ব+উ’ এর চেয়ে ‘ব+ই’ গুরুত্ব দিয়েছে, সেই প্রকৃত মানুষরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিষয়টি আমার গভীর পর্যবেক্ষণের ফলে বহিঃপ্রকাশিত ফল, এখানে অতি উৎসাহিত হয়ে কেউ রোমাঞ্চিত হবার কিছু নেই।