পুণ্যানুভ‚তি জাগৃতির মাসব্যাপী রোজার উৎসব শুরু

43

স্বাগত মাহে রমজানুল মোবারক। বছরের এই একটি রোজার মাস ভিন্ন আমেজ ও ভিন্ন আবেদনে আমাদের মাঝে ফিরে আসে। রহমত, মাগফিরাত নাজাতের মাসটি এলো ফিরে আমাদের পুণ্যস্নাত করার আবাহনে। মহান স্রষ্টা আল্লাহ পাকের করুণা, ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতির সওগাত ও শুভবার্তা নিয়ে মাহে রমজান আজ হাজির। বছরের আর এগারোটি মাসের চেয়ে ব্যতিক্রমী ও ভিন্ন অনুভব আমেজ নিয়ে আসে মাহে রমজান। বাংলাদেশসহ পুরো দুনিয়া আজ রোজার উৎসবে শামিল। দেশে দেশে কোটি কোটি মুসলিম জনতা আজ মেতেছে রোজার উৎসবে। পাপ-পংকিলতা, গøানি, নৈরাশ্য ও অস্থিতিশীলতার ভেতর দিয়ে চলা আমাদের সামগ্রিক জীবনে একটু শান্তির পরশ বইয়ে দিতে ফিরে ফিরে আসে মাহে রমজান। আত্মশুদ্ধি, আত্মিক জাগরণ ও পুণ্যানুভ‚তি জাগৃতির রোজার মাসটি আসার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আমাদের কলুষময় জীবনধারা। রোজাদার মুসলমানরা রোজার পুণ্যস্পর্শে অবগাহন করে নিজেদের ¯িœগ্ধ ও সিক্ত করে। রোজার মাসটিতে কঠিন সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদাররা আত্মিক উৎকর্ষতা অর্জন করে এবং নৈতিকভাবে উজ্জীবিত উদ্দীপ্ত হয়। রোজার মাধ্যমে বোধে, চিন্তায় ও কর্মে আসে অনুক‚ল পরিবর্তন।
দিনভর কঠিন উপবাসব্রত পালন, কামাচার ও পাপাচার থেকে বিরত থাকাই হলো রোজা। রোজাকে বলা হয় সিয়াম সাধনা। আরবি ‘সওম’ শব্দটি থেকেই ‘সিয়াম’। রোজা যেহেতু ২৯ বা ৩০দিন ধরে পালন করা হয় তাই বহুবচনে ‘সিয়াম’ শব্দটি প্রয়োগ হয়ে থাকে। সিয়াম সাধনার দ্বারা আত্মসংযম, বাকসংযম, ভোগ সংযমের মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাকের নৈকট্য অর্জন করেন রোজাদার মুমিন মুসলমানরা। কুপ্রবৃত্তি দমন, ষড়রিপুর তাড়না উপেক্ষা করে চলা এবং সুকুমারবৃত্তি চর্চা ইত্যাদি মানবিক গুণ সিয়াম সাধনার দ্বারা অর্জিত হয়। হাদিস শরিফে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আস সওমু জুন্নাতুন’ অর্থাৎ রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। ঢাল দ্বারা কোনো ব্যক্তির দৈহিক সুরক্ষা হয়, অন্যের আক্রমণ ও অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকা যায়, তেমনি রোজা বা সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদাররা যাবতীয় অনিষ্টতা ও অশুভ হাতছানি থেকে নিজেদের রক্ষা করে।
মাহে রমজানে রোজা রাখা ফরজ। রোজার বিধান বর্ণনা করে কুরআন মজিদে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেজগারি (আল্লাহভীরুতা) অর্জন করতে পারো; গণনার কয়েকটি দিনের জন্য। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তারপক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশির সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি রোজা রাখো, তবে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পারো।’’ (সূরা আলবাকারা: ১৮৩-১৮৪)।
কুরআন মজিদের উক্ত নির্দেশনা থেকে বোঝা যায়, রোজা শুধু উম্মতে মুহাম্মদি তথা আখেরি নবীর উম্মতদের ওপর ফরজ করা হয়নি, পূর্ববর্তী উম্মতগণের ওপরও রোজা ফরজ করা হয়েছিল। এর দ্বারা একদিকে রোজার বিশেষ গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। তেমনি মুসলমানদের এই মর্মে সান্ত¡না দেওয়া হয়েছে যে, রোজা একটা কষ্টকর ইবাদত বটে, তবে তা শুধুমাত্র তোমাদের ওপরই ফরজ করা হয়নি, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের ওপরও রোজা ফরজ করা হয়েছিল। কেননা সাধারণত দেখা যায়, কোনো একটি কষ্টকর কাজ অনেকে মিলে করলে তা অনেকটা স্বাভাবিক ও সহজ মনে হয়। (রুহুল মাআনি)। হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আ) পর্যন্ত সকল উম্মতের ওপর রোজার বিধান প্রযোজ্য ছিল। তবে রোজার সংখ্যা, ধরন ও পদ্ধতিতে তারতম্য ছিল। নামাজের ইবাদত থেকে যেমন কোনো শরিয়ত ও উম্মত বাদ ছিল না, তেমনি রোজাও সবার জন্যই ফরজ ছিল।
রোজা রাখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কুরআন মজিদের নির্দেশনা ‘লাআল্লাকুম তাত্তাকুন’ অর্থাৎ ‘যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো’- তা খুবই গুরুত্ব¡বহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। ‘তাকওয়া’ শব্দটি ‘ইত্তেকা’ থেকে গৃহীত হয়েছে। ইত্তেকা শব্দের অভিধানিক অর্থ বেঁচে থাকা। ইসলামী পবিভাষায় এর অর্থ অতি ব্যাপক। তাই ‘তাকওয়া’ শুধু গুনাহ বা পাপাচার থেকে বেঁচে থাকার নাম নয় বরং গুনাহের যাবতীয় কাজ বর্জন করে নেক আমলসমূহ কার্যকর করাই হলো বাস্তবে তাকওয়া। পরহেজগারি তথা আল্লাহভীরুতার শক্তি ও গুণ অর্জনে রোজার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। রোজার মাধ্যমে প্রবৃত্তির তাড়না নিয়ন্ত্রণে বিশেষ শক্তি অর্জিত হয়।
রোজার মাসটি বিশেষ সম্মানিত ও মর্যাদামন্ডিত হওয়ার পেছনে তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। একটি হচ্ছে সিয়াম, দ্বিতীয়ট্ িমহাগ্রন্থ কুরআন মজিদ অবতীর্ণ হওয়া এবং তৃতীয়ত লাইলাতুল কদর। এ তিনটি বৈশিষ্ট্য শুধু এ মাসের সাথেই সম্পৃক্ত। তাই রোজার মাসটি অত্যন্ত বরকতময় ও সৌভাগ্যের সওগাত নিয়ে আসে। বিশ্ব মুসলিম এ মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি, সংযম অবলম্বন, তাকওয়া অর্জন এবং অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের কঠোর অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করেন। ফলে রোজার মাসে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে পুণ্যের আবহ বিরাজ করে। এ মাসে নামাজে তারাবি, সাহরি, ইফতার, কুরআন মজিদ তেলাওয়াত, নফল নামাজ, দান-সদকাহ ইত্যাদি ইবাদতে শামিল থাকেন রোজাদার মুসলমানরা। নানামুখী পুণ্যময় ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে তারা আল্লাহর নৈকট্যধন্য হওয়ার সতত প্রয়াস চালায় এ রোজার মাসে।
মাহে রমজানে আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমের কথা বেশি বেশি বলা হলেও এমাসেই খুব বেশি চলে অসংযম ও ভোগাচার। এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর কাছে রোজার মাস মানেই চুটিয়ে টাকা কামানোর মৌসুম। রোজার মাস আসার আগেই ভোগ্যপণ্যের বাজার হয়ে উঠেছে লাগামছাড়া। সরকারি হাঁকডাক ও নজরদারি সত্তে¡ও অনেক ব্যবসায়ী এখনো বেপরোয়া। তাই অসাধু ব্যবসায়ীদের ব্যবসার নামে দস্যুবৃত্তি থামাতে সরকারকে নিতে হবে আরো কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ। তবে শুধু আইন করে হুকুম জারি করে কাউকে অপরাধবৃত্তি থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। এজন্য চাই সবার মাঝে নৈতিক চেতনার উন্মেষ, বিবেকবোধের জাগৃতি ও শুভবুদ্ধির বিকাশ। যা রোজার শিক্ষাও বটে। সিয়াম সাধনার শুরুর এই দিনে সবার সুস্থতা ও শান্তিময় জীবনের জন্য আল্লাহপাকের দরবারে বিশেষ ফরিয়াদ জানাচ্ছি এবং কামনা করছি স্বদেশবাসীর কল্যাণ ও বিশ্বের নিপীড়িত মানবতার পরিত্রাণ ও মুক্তি।

লেখক : সাংবাদিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ