পুকুর নাকি সাগর চুরি বুঝে শুনেই ঠিক করি

136

পুকুর চুরি যার অর্থ বড় রকমের চুরি, কিন্তু এখন চুরির ব্যাপকতা এত বৃদ্ধি পেয়েছে পুকুর চুরি বললে মনের ভাব যেন সঠিকভাবে প্রকাশ হতে চায় না। তাই এখন আমরা সাগর চুরি বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি কারণ বর্তমানের চুরিগুলি আর পুকুরের মধ্যে নাই সব সাগর হয়ে গেছে। আচ্ছা সাগর থাকতে পুকুর চুরি কেন বড় চুরি হল? বাংলা সাহিত্যের উৎস চর্যাপদ, এসেছে আর্যাবর্ত হতে আর আর্যাবর্ত বলতে উত্তর ভারতকে বুঝায়। এখন উত্তর ভারতে সাগর কোত্থেকে আসবে ? সেখানে সব কুয়া, তাই মনে হয় পুকুর চুরিকে বড় চুরি ধরা হয়েছে, কারণ তারা তো সাগর দেখেইনি। তবে পুকুর চুরির অন্য একটি মোজেজা রয়েছে কোন এক জায়গায় পানির বড় অভাব তাই পুকুর দরকার বলে সরকারের কাছ হতে টাকা চাওয়া হয়েছে। সরকার বিষয়টির জনগুরুত্ব উপলব্ধি করে পুকুর খুঁড়ার জন্য টাকা বরাদ্দ দিল, সে টাকা কর্তা ব্যক্তিরা ভাগবাটোয়ারা করে খেয়ে ফেলল। পুকুর খুঁড়ল না, এখন যদি সরকার হতে তদন্তে আসে কি দেখাবে সে ভাবনায় সবাই অস্থির। তখন সকলে শলাপরামর্শ করে সরকারকে আরেকটি চিঠি দিল: পুকুর যেটি খনন করা হয়েছে তার পানি যারা পান করেছে তারাই মৃত্যুবরণ করেছে ফলে এলাকায় ভীতির সঞ্চার হয়েছে। কারণ পুকুরের পানি বিষাক্ত তাই মানুষ সে পানি ব্যবহার বন্ধ রেখেছে, কিন্তু সে পানি পান করে প্রতিদিন এলাকায় অসংখ্য গরু-ছাগল, শিয়াল-কুকুর মারা যাচ্ছে। আরো বড় কোন বিপদের আশঙ্কায় অতি শীঘ্রই পুকুরটি ভরাট করে ফেলার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তাই দ্রæত টাকা বরাদ্দ দেয়া হোক। অতএব ততোধিক দ্রæত টাকা এল এবং কর্তাদের পেটে গেল, হাহাহাহা একেই বলে পুকুর চুরি।
সে পর্যন্ত ঠিক আছে, কারণ একটা পুকুর করতে আর ক’টাকা লাগে, ২০/২৫ জন মানুষ ১৫ দিন কাজ করে একটি পুকুর করে ফেলতে পারে।
অতএব ৫০০ টাকা একজনের বেতন হলে ২ লক্ষ টাকায় একটি পুকুর হয়ে যায়, আর ভরাতে লাগবে আরো ২ লক্ষ চার লক্ষ টাকায় কাম শেষ। মানলাম, ধরাছোঁয়ার বালাই নাই খুঁড়েছে আর ভরেছে টাকা হজম করেছে ঝামেলা ছাড়া। কিন্তু যত ঝামেলা সব পুনঃখননে, আর তা যে এত কঠিন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) পুকুর পুনঃখনন প্রকল্প না দেখলে কখনো বুঝতে পারতাম না। বলে না বুনন থেকে তুন্নন দড়, ঠিক তেমন খননের চাইতে পুনঃখনন দড়। তাইত এত বিশাল বিশাল পুকুর খুঁড়ে যে রেখেছে তার খবর নাই কিন্তু যত খবর পুনঃখননে। অস্ট্রেলিয়া, ন্যাদারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড যেতে হবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে, ভেবে দেখুন পুনঃখনন কত কঠিন। খবরে দেখলাম ১৬ জন কর্তাকে আমাদের বিএমডিএ ইউরোপ অথবা অস্ট্রেলিয়া পাঠাবে পুকুর পুনঃখননের জ্ঞান আহরণের জন্য, মাশাল্লাহ্। চিন্তা করুন কি কঠিন এক কাজে বিএমডিএ হাত দিতে যাচ্ছে? আবার সেখানে বাদ সাধছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য ভূতত্ত¡ ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান। তিনি আবার দেশের ভূগর্ভস্থ জলাধার ব্যবস্থাপনা জাতীয় কৌশল নির্ধারণী কমিটির সদস্য, তাঁর মতে আগে দেশীয় জ্ঞান কাজে লাগান হোক। ভাল কাজে বাধা আসেই, বিএমডিএ- বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, একমুখী না বহুমুখী- তারা কি ঐ একমুখী সারোয়ার জাহানের চাইতে কম বুচ্ছে? ১৬ জন কর্মকর্তা বিদেশ যাবেন মাত্র ১ কোটি ২৮ লক্ষটাকা খরচ হবে তার জন্য কত মায়াকান্না। আরে ভাই ৪ হাজার কোটি টাকা যেখানে কোন টাকাই না ১ কোটি ২৮ লাখ কি এমন একটি টাকা হল? তাছাড়া ভাল কাজেই ব্যয় হচ্ছে, পুকুর পুনঃখনন, পুরাতন পুকুর যার আরেক নাম মজা পুকুর। মজা মানে কি কোন সোজা কথা, কত বড় যে একটি বোঝা এই মজাকে সোজা করা, তা বুঝবে কে? মজাকে সোজা করতে লাগবে একজন পাকা ওঝা তাই তো উনারা বিদেশ যেতে চাইছেন সোজা।
ভাল কাজে বাধা আসবেই তাতে দমে গেলে চলবে না। তাইতো কবি আমাদের জন্য লিখে গেছেন; কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে? আবার লিখেছেন; মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারে ফিরে আসে। অতএব চিন্তার কোন কারণ নাই, পাছে লোকে অনেক কথাই বলবে কান দিয়ে লাভ নাই, দিলে ভাল কাজ থেমে যাবে। সুতরাং সাধু সাবধান যেমন চলছেন তেমন চলুন, কাক কাকা করবেই লক্ষ্যে অটুট থাকুন কাকা থেমে যাবে। বিএমডিএ-কে বলছি দেখবেন বাড়ি ভাড়া না করে চলে আসবেন না আবার। কারণ কেউ কেউ তা নিয়ে বলা শুরু করেছেন, ১৯’র জুলাই থেকে ২৩’র ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ, থাকবেন ১০ কর্মকর্তা, ৮ কর্মচারী। ১৮ জন মাত্র মানুষ, সাড়ে চার বছরে ১ কোটি ৬২ লাখ ২০ হাজার টাকা বাড়ীভাড়া কেন লাগবে? ৫০ হাজার টাকা মাসে ভাড়া ধরলেও সাড়ে চার বছরে লাগে ২৭ লাখ টাকা, অথচ ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করলেই নাকি সেখানে জায়গা কিনে বাড়ি বেঁধে ফেলা যাবে। আসলে নিন্দুকে অনেক কথা বলবে সেদিকে কান দিয়ে লাভ নাই। লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে সিদ্ধান্তে অটল থাকতেই হবে, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড শুধু নয় প্রয়োজনে কানাডা, ব্রাজিল যেতে হবে সেখানে ডুবা-হাওর, জলাভূমি আরো অধিক আছে। একেবারে প্র্যাক্টিকেল নলেজ গেদার করা যাবে সেখানে গেলে। আমরা শুনেছি মজা পুকুরে জিন-পরী, ভুত-পেত্নী অনেক কিছু থাকে ফলে সেসব পুনঃখনন করতে গেলে মানুষের কল্লা চায় তারা।
অতএব ব্রাজিল, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা থেকে ঘুরে এলে জিন-ভুত কল্লা ছাড়া অন্য কি পেলে খুশী হয় তা জানা যাবে। টাকা গেলে যাক কিন্তু মানুষের কল্লা তো যেতে পারেনা। তাই কোন সমস্যা নাই বরেন্দ্র বহুমুখী প্রকল্পের সাথে আমরা বহু মুখ অবশ্যই আছি। গুটি কতেক নিন্দুকের পেঁচামুখের নিন্দার কারণে এমন মহতী একটি উদ্যোগকে তো আর ভেস্তে যেতে দিতে পারি না। সমস্যা কি এক টাকার জিনিষ দশ টাকা দেখান এখন প্রথা, ফলে বিএমডিএ করলে দোষ কিসের? রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বালিশের দাম দেখানো হল ৬ হাজার টাকা প্রতিটি, সেই বালিশ আবার দু-তিন তলা ভবনে তুলতে লেগেছে ৭৬০ টাকা প্রতিটি! ২০১৭ সালে মনে হয় বিশ্বব্যাংক একটি হিসাব দেখিয়েছিল ভারতে ১ কিমি রাস্তা নির্মাণে ১০ কোটি টাকা খরচ হয় বাংলাদেশে হয় ৫৮ কোটি। গোপালগঞ্জ কৃষিপ্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দুটি কম্পিউটারের মেরামত আর কালি কেনার জন্যেই নাকি বছরে খরচ হয় ৩৬ লক্ষ টাকা। ১৯৯৬ সালে শুনেছিলাম পদ্মাসেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ৬ হাজার কোটি টাকা এখন শুনছি ৪০ হাজার কোটির বেশি খরচ হবে। এখানে আমার একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। ১৯৯৩ সালে আমি একটি ঘর নির্মাণ করেছিলাম আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে। ২০১৬ সালে সে একই রকম আরেকটি ঘর নির্মাণ করলাম পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে- অর্থাৎ ২৩ বছরে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম আমাদের নির্বাচন কমিশন বিগত সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে বক্তৃতা দিয়ে মাশাল্লাহ্ ১২৩ কোটি টাকা বক্তৃতা ভাতা কামিয়ে নিয়েছে।
অবশ্য টপিকটির উপর কিছুদিন পূর্বে ‘কথারও দাম হয় অতি কয় যদি মহামতি’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলাম। তাতে আমি নির্বাচন কমিশনের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলাম, কথা বেচে খাওয়ার নিয়ম শিখিয়ে দেওয়ার জন্য। দৈনিক পূর্বদেশ আবার অধিক সুপ্রসন্ন হয়ে তাদের ২৪/৮/২০১৯ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে প্রবন্ধটি প্রকাশ করেছে, ধন্যবাদ পূর্বদেশ। তবে সব সংবাদকে ছাপিয়ে যেটি আমার মধ্যে উত্তেজনা এনে দিয়েছে তা হল ফরিদপুর মেডিকেলের পর্দার দাম। এক রোগী থেকে অন্য রোগীকে আড়াল করার একটি পর্দার দাম সাড়ে ৩৭ লক্ষ টাকা! আরো আছে, তথায় ১১ কোটি ৫৩ লাখ টাকায় কেনা যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের বিল দেখানো হয়েছে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। তাহলে বিএমডিএ’র অন্যায়টা কোথায়? বলেছিলাম উত্তর ভারতের মানুষরা প্রাচীনকালে সাগর দেখেনি, আমরা তো দেখছি তাই বর্তমান বাংলাদেশের কাÐ গুলোকে আর পুকুর চুরির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে মানায় না। এত বিশাল সাগর থাকতে পুকুরকে লাইম লাইটে আনা খাটে না। সাগর উত্তর ভারতের মানুষরা শুধু নয় স্বয়ং স¤্রাট জাহাঙ্গীর দেখেন নি! স¤্রাট বাংলাদেশে এসে নাকি সুন্দরবন দেখতে গেলেন, দেখতে যাওয়া আর কি- অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা আরকি। স¤্রাট যখন সেখানে পৌঁছেন চারদিক ছিল শুষ্ক ফকফকা, হঠাৎ কিছুক্ষণের মধ্যে জোয়ার এসে গোটা এলাকা ডুবে গেল।
চতুর্দিক জল থৈথৈ করছে আর জলের উপর ঢেউ খেলা করছে দেখে মনে হয় স¤্রাটের নুহ (আঃ)’র প্লাবনের কথা মনে পড়ে গিয়েছে। আর দেরী করেননি স¤্রাট দৌড়ে পালালেন সেখান থেকে। এখন আমাদের বরেন্দ্র বিশেষজ্ঞগণ যে অভিজ্ঞতার জন্য অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড যাবেন, শুনেছি সেখানকার জলাশয়ে কি সব বিশাল বিশাল জলদানব বাস করে। ভাবছি সে সব দেখে কোন তাঁরাও স¤্রাটের মত দৌড়ে পালান কিনা!* অস্ট্রেলিয়ায় দুই মাদক চোরাকারবারি এক জলদানবের ভয়ে পুলিশের হাতে ধরা দিয়েছে- ‘প্রথম আলো‘ শেষ পৃ: ১৪ সেপ। * পর্যন্ত ৬ সেপ লিখেছি।
লেখক : কলামিস্ট