পাহাড়ে মথুরা পানির হাহাকার

71

শহর ও নগরে সুপেয় পানির যোগানদাতা ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশন। তারপরও নগরেরর বস্তিবাসীসহ অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত পানি সরবরাহ থেকে বঞ্চিত। আবার যারা সরবরাহ পান, তাদের নানান অভিযোগ। পানিতে ময়লা, দূষণ ও লৌহোর উপস্থিতি। কিছুদিন আগে ঢাকা ওয়াসার পানির রঙ ছিল কোথাও কোথাও শরবতের ন্যায়। সামাজিক মাধ্যমে এবং সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এ তথ্য নিয়ে সোচ্চার ছিল। গল বছর চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় ওয়াসার পানিতে মারাত্মক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই হাসপাতলে ভর্তি হওয়ার সংবাদ জানা যায়। এ বছরের জুলাইয়ের শেষ প্রান্তে হালিশহর এলাকায় পানিতে কলেরা জীবানুর কথাও জানা যায় (সূত্র আজাদী ২৯ জুলাই ২০১৯)।
বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে পানি পায় ৯৮ শতাংশ জনগণ। এর মাঝে নিরাপদ পানি পান মোট ৫৬ শতাংশ। যা যথাক্রমে গ্রামের ৬১ শতাংশ, নগরবাসী মাত্র ৪৫ শতাংশ আর দরিদ্র শ্রেণি পায় মাত্র৩৬ শতাংশ। অথচ নিরাপদ পানি সরবরাহে সরকারের বরাদ্দ শহরে/নগরে ৮০ শতাংশ এবং গ্রামে মাত্র ২০ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সূত্র মতে, ঢাকায় দৈনিক মাথাপিছু পানি পায় মাত্র ২০ লিটার। ঢাকায় দুইটি সিটি কর্পোরেশন প্রায় ৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পানি সরবরাহ করে। তাদের যৌথ উৎপাদন প্রায় ২৫ কোটি লিটার। এই হিসাব থেকে বলা যায়, দেশের রাজধানী ঢাকায় পানির কষ্ট সারা বছর। দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের অবস্থা সহজে অনুমেয়। দেশের অভ্যন্তরে এবং পাহাড়ি এলাকায় পানির যে কাহাত তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সুপেয় পানি তথা মধুরা পানি প্রাপ্তি সত্যিকার অর্থে কঠিন হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমি সৌদি আরব গিয়েছিলাম। সেখানে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার (বাংলাদেশি) জানাল, এক লিটার অকটেন এক সৌদি রিয়াল। আর ১ লিটার মিনারেল পানি এক সৌদি রিয়াল। নদী বিধোত বাংলাদেশে ১৬/১৭ কোটি জেলা গত বন্যার পানিতে ডুবে যায়। অথচ পান করার মথুরা পানি নেই। বোতলজাত পানিকে সুপেয় পানি বলা যাবে না। কারণ যে দেশে দুধে ভেজাল হচ্ছে সে দেশে পানিতে হবে না একথা হলপ করে বলা যাবে না।
পাহাড়িদের পানির হাহাকার লিখতে গিয়ে আসে দেশের পানির অবস্থা জানলাম। যে দেশে পানির এতো উৎস, সে দেশে আজ সুপেয় পানির আকাল। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, পাহাড়ি এলাকায় গভীর নলকূপ ও চাপকলের একটা খতিয়ান দেয়া যাক। রাঙামাটি জেলায় ১৮৯৭টি, খাগড়াছড়ি জেলায় ৯৬৮৩টি এবং বান্দরবানে ৭১০৮টি। তবে পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর যারা ঝিরি-ঝরনা, খাল-নদীর উপর নির্ভরশীল, তাদের একটি পরিসংখ্যান আপনাদের জ্ঞাতার্থে দেয়া যাক। তিনি জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি অধিবাসীরা যথাক্রমে ৬০% শতাংশ, ৪৭% শতাংশ এবং ৪৪% শতাংশ। প্রাকৃতিক উৎসের উপর নির্ভরশীল (সূত্র প্রথম আলো ১১ মে ২০১৯)। নারীরা মাথায় করে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি সংগ্রহের ছবি ছাপা হয়ে থাকে। দেখতে খুবই মনোহর হলে এই পানি সংগ্রহ তাদের জন্য অতিকষ্টের। এখানে উল্লেখযোঘ্য যে তিন পার্বত্য জেলায় বসতি বাড়ার সাথে সাথে পরিবেশের যেমন ক্ষতি বেড়েছে। তেমনি পানি সংগ্রহের কষ্ট ও অতিমাত্রায় বেড়েছে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় তা আরও বেশি কষ্টকর।
পাহাড়ি এলাকায় অনেক ঝরনা শুকিয়ে যায় গ্রীস্মকালে। বর্ষার সময় কিছু পানি পাওয়া গেলেও শুষ্ক মওসুমে ছড়া, ঝিরির পানি শুকিয়ে যায়। তখন আদিবাসীরা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া পানির জন্য গর্ত করে। পরে বাটি বা পাত্র কাটিয়ে তুলে একটু একটু করে কলসি ভরে। বলা যায় শুষ্ক মওসুমে দুর্গম এলাকার সকলেই বিশেষ করে নারীরা এভাবে পানি সঙগ্রহ করে থাকেন। এ পানিই তাদের কাছে সুপেয় বা মথুরা পানি হিসাবে পরিচিত। কিন্তু এক কলসি পানি সংগ্রহ যেভাবে বলেছি, তত সহজ নয়। বরঞ্চ অতি শ্রমসাধ্যও কষ্টের।
আগেই বলেছি, শীতের শুরু থেকে পাহাড়ি জনগণের শুরু হয় পানির কষ্ট। পানীয় জল, ধোয়ামোছাসহ নিত্য কাজের জন্য পানির আকাল অব্যাহত থাকে বর্ষার আগ পর্যন্ত। এ সময় স্নান ও পয়ঃনিষ্কাশন কাজে সবচেয়ে বেশি কষ্টের। বলা যায়, ডিসেম্বর থেকে মে মাস এই ছয় মাস তাদের বিড়ম্বনার সীমা থাকে না। অনেক দুর-দুরান্তর থেকে তাদের পানি সংগ্রহ করতে হয়। গত দুই দশক থেকে পাহাড়ে জনবসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানির সংকট বাড়ছে। বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় যেখানে পাহাড়ি মানুষেরা বেশি থাকেন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কিছু চাপকল সরবরাহ করা হলেও তা যথেষ্ট নয়।
দেশে পানি সরবরাহের বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্ব জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের। অধিদপ্তরের আওতায় রাঙ্গামাটি জেলায় ৪০ শতাংশ, বান্দরবান জেলায় ৫৩ শতাংশ এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ৫৬ শতাংশ জনগোষ্ঠিকে পানি সরবরাহ করে থাক। বাকী অধিবাসীরা প্রাকৃতিক উৎসবের উপর নির্ভর করে থাকেন। পাহাড়ি এলাকায় পানি সংগ্রহের কঠিন দায়িত্বটি পালন করে থাকেন নারীরা। শুকনো মৌসুমে এই নারীদের পানি সংগ্রহের সংগ্রামটি কঠিনতর হয়ে এঠ।
তিন পার্বত্য জেলার রাঙ্গামাটিতেই প্রাকৃতিক উৎসের উপর নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে কাপ্তাই, বাঘাইছড়ি, রাজস্থলী, কাউখালীতে সংকট সবচেয়ে বেশি। এ সকল এলাকার মানুষেরা পানির জন্য কিলোমিটার চড়াই উৎতাই পার করতে হয়।
দুর্গম এলাকার নারীরা প্রতিদিন সকালে গড়ে ২/৩ ঘণ্টা পানি সংগ্রহের পেছনে ব্যয় করে থাকেন। বাড়ির কলসি, ড্রাম ও অন্যান্য পাত্রে পানি ভরতে হয়। এই পানি সংগ্রহ করতে মেয়েদের এক থেকে চার কিলোমিটার পথ হেঁটে ছড়া, ঝিরি, ঝরনা এবং কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। রাজস্থলী উপজেলার গ্যাইন্দা ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামে কোন চাপকল বা পাতকুয়া নেই। ছড়া ও ঝিরিগুলো শুকনো থাকে শুষ্ক মওসুমে। ফলে ছোট খাটো পাথুরে কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করতে মেয়েদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। পাহাড়ি এলাকার মানুষেরা সাধারণত ফুটিয়ে পানি পান করে না। ফলে শুকনো মওসুমে এতদঞ্চলে ডায়রিয়াসহ নানান পেটের পীড়া দেখা দেয়। তবে জেলার একটি বড় অংশ কাপ্তাই হৃদের নীচে। কাপ্তাই, নানিয়ারচর, বিলাইছড়ি, বরকল, রাঙামাটি সদর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি উপজেলার মানুষের কাপ্তাই হৃদের পানি পার করে। তবে জনবসতি ও কলকারখানা সৃষ্টির ফলে কাপ্তাই হৃদের দুষণ ক্রমেই বাড়ছে। এ ছাড়াও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বিভিন্ন ইউনিয়নে গভীর নলকূপের মাধ্যমে সীমিত পরিমাণ পানি সরবরাহ করে থকে। তবে তা নিয়ে পাহাড়ি সমাজে আছে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। আবার সদর উপজেলায় হৃদের পানি শোধন করে হাজার পাঁচেক পরিবারে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। যা নিতান্ত অপ্রতুল।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের যেখানে পানির সংকট আছে, সেখানে রাঙামাটি জেলা পরিষদের মাধ্যমে চাপকল বা গভীর নলকূপ সরবরাহ করা হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের মতে, গরমের দিনে গভীর নলকূপ থেকে ঠিকমতো পানি পাওয়া যায় না। আবার অনেক দুর্ঘম এলাকয় ৩০০ ফুটের নিচে পাথর থাকে, নলকূপ বসানোই যায় না। এক সূত্র জানা যায়, বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৩২টি। অথচ চাপকল আছে মাত্র চরটি বিদ্যালয়ে। পুরো জেলায় ৪৩২ বিদ্যালয়ে চাপকল বা গভীর নলকূপ আছে। সব নলকূপ আবার সচল নয়। শুকনো মওসুমে তার অর্ধেক এর বেশি কলে পানি পাওয়া যায় না। শিক্ষা কর্মকর্তার হিসাব অনুযায়ী জেলায় মোট স্কুলের সংখ্যা ৭৯০টি। এ হিসাবে জেলায় অর্ধেক বিদ্যালয়ে পানির সংস্থান নেই। খাগড়াছড়ি জেলায় মোট বিদ্যালয় আছে ৬৩৭টি তার মধ্যে ২৩৪টিতে নলকূল বসানো আছে। পুরো জেলায় ১০ হাজারের কিছু কম নলকূপ বসানো আছে। এই জেলার জনসংখ্যা ছয় লাখের বেশি। এখানে ভূমির নিচে পাথুরে হওয়ায় অনেক স্থানে নলকূপ বসানো সম্ভব নয়। ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী খাগড়াছড়ি জেলার অর্ধেকের বেশি মানুষ প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। শুকনো মওসুমে এ জেলায় পানি সংকট তীব্রতর হয়। অনেক সশয় ২০০/৩০০ ফুট নিচের গর্ত থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।
মিয়ানমার সীমান্ত লাগোয়া জেলা বান্দরবান। এই উপজেলার সাত উপজেলার মধ্যে রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদম সবচেয়ে দুর্গতম এলাকায়। এ জেলার চার লাখ মানুষের অর্ধেক সরকারি ও বেসরকারি পানি সরবরাহের আওতার বাইরে। তবে উপরে বর্ণিত চারটির ৮০ শতাংশ মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ। ঝিরি, খাল, নদীর পানিই এদের একমাত্র ভরসা। উঁচু পাহাড়ের ভূগর্ভে পানির স্তর পাওয়া যায় না। এখানে অকেন জায়গায় চাপকল, পাকতুয়া এবং গভীর নলকূপও নেই। গ্রীষ্মে সাঙ্গু নদীর পানি শুকিয়ে যায়।
পানি নিয়ে বেশি দুর্ভোগ বম ও খুমিদের। এদের বসবাস সাধারণত পাহাড়ের চূড়ায়। কোন কোন পাহাড়ে উঠতে একঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। প্রায় এক হাজার ফুট পাহাড়ের খাদে নেমে পানি সংগ্রহ করতে তাদের অনেক সময় লেগে যায়। ফলে অন্য কাজ করার শক্তি আর থাকে না। পাহাড়িদের ধারণা, পানির উৎস থেকে পাথর আহরণ ও আশেপাশের বন উজার হওয়ায় সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। যার ফলে কুয়া ঝিরির পানি শুকিয়ে যায়। তাদের ক্ষেত্রে দূর্ষিত হয়ে পড়ে স্বল্প পানি ধারণের কারণে। চিম্বুক পাহাড়ের আশেপাশে যারা বাস করে তাদের অবস্থাও তথৈবচ। ঝর্ণায় পানি কম থাকার কারণে নল দিয়ে পানি টেনে নেয়া যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বৃষ্টি কম হওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, পাথর উত্তোলন এবং গাছপালা কর্তনের ফলে পানির উৎস দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি জনপথে বাস করা মানুষের জন্য মথুরা পানির সরবরাহের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, কাপ্তাই হৃদের পানি নল দিয়ে সরবরাহের আওতায় বাড়নো, ঝিরি, কুয়াগুলি সংরক্ষণের কোন বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট সকলপক্ষকে পাহাড়ি মানুষের সুপেয় পানি সরবরাহে আন্তরিক হতে হবে।

লেখক: কবি নিসর্গী, ব্যাংক নির্বাহী (অব.)