পাহাড়খেকোদের থাবা শহর-গ্রাম সবখানেই

98

ভৌগলিকগত ভাবেই পাহাড়-পর্বতে ঘেরা চট্টগ্রাম। পাহাড়, সাগর ও নদীর মিশ্রণে এখানকার সৌন্দর্য্য আরও প্রস্ফুটিত হয়েছে। চট্টগ্রামের শহর-গ্রামের এ সৌন্দর্য্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়। আকাশ ছোঁয়া পাহাড়গুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। বসতি গড়ে উঠছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে। অতিবর্ষণে মৃত্যুর মিছিলও পাহাড় সুরক্ষায় উপলক্ষ হতে পারেনি। বাকি সময়ে নীরব থাকলেও বর্ষা মৌসুম আসলেই প্রশাসনের তোড়জোড় শুরু হয়। পাহাড়ধস, পাহাড় কাটা কিংবা দখলরোধে প্রশাসনের সব প্রস্তুতি যেন নগর ঘিরেই। গ্রামের পাহাড় সুরক্ষায় মাতামাতি যেমন নেই তেমনি নেই কোন পরিসংখ্যান।
সূত্র জানায়, নতুন করে চট্টগ্রাম শহরের ১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধ বসতির তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। এসব পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস করছেন ৮৩৫টি পরিবার। যারমধ্যে ৫৩১টি পরিবার ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ে এবং ৩০৪টি পরিবার সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের মালিকানাধীন পাহাড়ে বসবাস করছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর আঞ্চলিক পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন পূর্বদেশকে বলেন, ‘পাহাড় কাটা এখন সর্বগ্রাসী। পরিবেশ অধিদপ্তর একা তা রোধ করতে পারছে না। ইতোমধ্যে অনেককে জরিমানা করেছি। পাহাড় কাটার সাথে অনেক উঁচু পর্যায়ের প্রভাবশালী লোক জড়িত থাকায় ব্যবস্থা নিতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়। নগরের পাশাপাশি আমরা খবর পেলেই উপজেলাগুলোতেও পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. দেলোয়ার হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, শহর-গ্রামে যেখানেই হোক পাহাড় দখল ও কর্তনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া আছে। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাগুলোতে প্রত্যেক উপজেলা থেকে প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সেখানেও বেশকিছু কার্যকর নির্দেশনা দেয়া হয়।
পাহাড় দখল, মালিক চুপ : ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন। রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, গণপূর্ত বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন, বন বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাহাড়গুলোই অবৈধভাবে দখলে নিয়ে বসতি স্থাপন করা হয়েছে। চোখের সামনেই নিজেদের পাহাড়গুলো দখল হলেও নিশ্চুপ মালিকপক্ষ সংস্থাগুলো।
১৮তম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদে উচ্ছেদের নিমিত্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তি বরাবরে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। নিজেদের পাহাড় দখলমুক্ত করা সকল সংস্থা ও বিভাগের দায়িত্ব। এ বিষয়ে সম্মিলিতভাবে সকলকে একযোগে কাজ করার জন্য তিনি অনুরোধ জানান।’
অবৈধ বসবাসকারী বেড়েছে : সর্বশেষ পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় নগরীর অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৬৮৪টি পরিবার থাকার কথা জানানো হয়। গত মার্চ মাসে এ সংখ্যা হালনাগাদে নগরীর ছয়জন সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নির্দেশনা দেয়া হয়। তাঁদের প্রেরিত তথ্য অনুযায়ী অত্যাধিক ঝুঁকিতে থাকা ১৭টি পাহাড়ে অবৈধ বসতির সংখ্যা বেড়েছে ১৫১টি। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোর মধ্যে একে খান এন্ড কোম্পানির পাহাড়ে ২৬টি, হারুন খান সাহেবের (বায়তুন আমান সোসাইটি) পাহাড়ে ৩৩টি, কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনী পাহাড়ে ২৮টি, লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ২২টি, আকবর শাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮টি, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশন পাহাড়ে ১০টি, পূর্ব ফিরোজশাহ ১নং ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮টি, পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩টি, মধুশাহ পাহাড়ে ৩৪টি, ফয়েজলেক আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ৯টি, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩৪টি, মতিঝর্ণা ও বাটালীহিল সংলগ্ন পাহাড়ে ১৬২টি, লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ১১টি, এমআর সিদ্দিকীর পাহাড়ে আটটি, মিয়ার পাহাড়ে ৩২টি, অক্সিজেনের রৌফাবাদে ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে ১১টি ও আমিন কলোনি সংলগ্ন টাংকির পাহাড়ে ১৬টি পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে।
পাহাড় কাটা থেমে নেই : নগরীর ফয়েসলেক, জালালাবাদ, পাহাড়তলী ও খুলশী এলাকায় পাহাড় কাটা হয় বেশি। উন্নয়ন কর্মকান্ড কিংবা পাকা দালান নির্মাণে সেখানকার প্রভাবশালীরা নিয়মিত পাহাড় কাটছে। বিভিন্ন সময় পরিবেশ অধিদপ্তর এসব এলাকায় অভিযান চালিয়ে মোটা অংকের জরিমানা আদায় করে শান্ত হলেও পাহাড় কাটা অব্যাহত রাখেন প্রভাবশালীরা। পাহাড় কেটে সেখানে বসতি স্থাপন করে নিম্ন শ্রেণির মানুষদের ভাড়া দেয়া হয়। শহর নিয়ে ব্যাপক মাতামাতি হলেও নীরবেই পাহাড় ধ্বংস হচ্ছে গ্রামে। ১৫টি উপজেলাতেই পাহাড়খেকোদের ভয়াল থাবা পড়েছে। শহরের কাছের সীতাকুন্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুরে নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করা হয়েছে। বাঁশখালীর বৈলছড়ি ইউনিয়নের পূর্ব চেচুরিয়া ও সাধনপুর ইউনিয়নের করালঘোনার পাহাড়ে প্রতিনিয়ত কোদালের কোপ পড়ছে। একই উপজেলার প্রধান সড়কের পূর্বপাশের পাহাড়গুলো দখলে নিয়ে বসতি স্থাপন করা হয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রভাবশালীরা পাহাড় দখলে লিপ্ত আছে। উন্নয়ন কর্মকান্ডেও কয়েকটি পাহাড় ধ্বংস হয়েছে।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা আজ : পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৯তম সভা অনুষ্ঠিত হবে আজ। সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে বেলা ১২টায় এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় ঝুঁকিপূর্ণস্থানে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ, বসবাসকারীদের সাময়িকভাবে পুনর্বাসন, পাহাড়ে বসবাসকারীদের অবৈধ বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ, পাহাড়ধসের বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতনতা সৃষ্টির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ সভায় আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।