পাল্টাপাল্টিতে উত্তপ্ত চকরিয়ার রাজনীতি

54

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের প্রধান দুই প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের নির্বাচনী সহিংসতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে চকরিয়া। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জাফর আলমের নির্বাচনী অফিসে আগুন, প্রচার গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপি বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট হাসিনা আহমেদের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর, নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা, নেতা-কর্মীদের উপর হামলা ও মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রশাসন-আওয়ামী লীগ হয়রানি করছে বলে অভিযোগ বিএনপির। দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে চকরিয়ার নির্বাচনী মাঠ এখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে এলাকার সাধারণ ভোটারদের মাঝেও ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
জানা গেছে, গত বুধবার রাত সাড়ে সাতটার দিকে চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নের পঁহরচান্দা কুতুব বাজার এলাকায় মহাজোট মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জাফর আলমের নির্বাচনী প্রচার গাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় তারা বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন ইজিবাইকের চালক। এ ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রতিপক্ষ বিএনপিকে দায়ী করেছে। গত ১২ ডিসেম্বর দিবাগত রাত দেড়টার দিকে লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। অগ্নিকান্ডে কার্যালয়ের ভেতর কয়েকটি দলীয় ব্যানার পুড়ে গেলেও তেমন কোনো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। দলীয় কার্যালয়ে আগুন দেয়ার ঘটনাটি পরিকল্পিত বলে দাবি করে এ ঘটনায়ও বিএনপিকে দায়ী করেছে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ। ঘটনার পরদিন সন্ধ্যায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল করিম সেলিম বাদী হয়ে দলীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে বিএনপি ও অংগ সংগঠনের ৪৩ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে চকরিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়া গত ১৬ ডিসেম্বর সকালে ইলিশিয়া বাজারে বিএনপি নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর, গুলি বর্ষণ ও ৫ নেতা-কর্মীকে আহত করে বলে অভিযোগ করে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় ঢেমুশিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জালাল উদ্দিন বাদী হয়ে বিএনপি ও অংগ সংগঠনের ৫৮ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে আরও একটি মামলা দায়ের করেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজবাউল হক অভিযোগ করেন, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয়ের আশংকায় দলীয় নেতা-কর্মীরা নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে নেমেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর নির্বাচনী অফিসে হামলা, দলীয় কার্যালয় ও প্রচার গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে চকরিয়া পেকুয়ায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশকে অশান্ত করে তুলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন কোনোদিনই চকরিয়া-পেকুয়ার সাধারণ মানুষ পূরণ হতে দেবেনা বলেও জানান তিনি।
অপরদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ইউনিয়ের শান্তির বাজার এলাকায় বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী অ্যাডভোকেট হাসিনা আহমদের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করে একদল দূর্বৃত্ত। এসময় তারা নির্বাচনী অফিসের চেয়ার, টেবিলসহ সব ধরনের আসবাবপত্র ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় বিএনপি তার নির্বাচনী প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছে। এছাড়া একইদিন বিকালে চিরিঙ্গা ইউনিয়নের পালাকাটা স্কুলের সামনে ও বুড়িপুকু রাস্তার মাথা এলাকায় বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী অ্যাভোকেটহাসিনা আহমদের নেতা-কর্মীদের উপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে বিএনপি ও অংগ সংগঠনের ১০ জন নেতা-কর্মী আহত হয়। এ সময় পুলিশ চিরিঙ্গা ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য আবদুল হাফেজ এবং ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আবছারকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ হামলার ঘটনার জন্য বিএনপি পুলিশ, বিজিবি ও আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীদের দায়ী করেছে।
বিএনপির দাবী, এদিন বিকালে ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে প্রচারণার জন্য বিএনপি নেতা-কর্মীরা পালাকাটা স্কুলের সামনে ও বুড়িপুকু রাস্তার মাথা এলাকায় জড়ো হলে বিনা উস্কানীতে পুলিশ, বিজিবি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাদের উপর হামলা চালিয়ে বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে।
এছাড়া গত ১৩ ডিসেম্বর বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের একক প্রার্থী অ্যাডভোকেট হাছিনা আহমদের সমর্থনে বিএনপি নেতা-কর্মীরা পৌর সদরে মিছিল বের করলে বাইতুশ শরফ রোড এলাকায় সশস্র হামলার শিকার হয়। এ হামলার ঘটনায় চকরিয়া পৌর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র নুরুল ইসলাম হায়দারসহ ৫ নেতা-কর্মী আহত হয়। এদিন সন্ধ্যায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন আহত বিএনপি নেতা ও সাবেক পৌর মেয়র নুরুল ইসলাম হায়দারসহ অন্যান্যদের দেখে অ্যাডভোকেট হাসিনা আহমেদ অভিযোগ দেয়ার জন্য চকরিয়া থানায় গেলে থানা কম্পাউন্ডের বাইরে সন্ত্রাসীরা বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। তখন থানা ও আশপাশ এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় থানার ভেতরেই আটকা পড়েন তিনি। পরে থানা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ বের হয়ে থানার বাইরে ও আশপাশ এলাকার পরিস্থিতি শান্ত হলে রাত ৮ টার দিকে অ্যাডভোকেট হাসিনা আহমেদকে পুলিশ পাহারায় বাড়ি পৌঁছে দেয়া হয়। গত ১৫ ডিসেম্বর ডুলাহাজারা ইউনিয়নে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী অ্যাডভোকেট হাসিনা আহমদের নির্বাচনী গণসংযোগকালে ইউনিয়নের কাটাখালী ও সাফারি পার্কের গেইটের সামনে দফায় দফায় সশস্র হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। হামলায় বিএনপির অন্তত ৩০ নেতা-কর্মী আহত হন বলে জানায় বিএনপি। ভাঙচুরের কবল থেকে রক্ষা পায়নি ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হাসিনা আহমেদ এর গাড়িসহ সাংবাদিকদের গাড়িও। হামলার পর সন্ত্রাসীরা বিএনপি কর্মীদের ২টি মোটর সাইকেলও ছিনিয়ে নিয়ে যায় বলে বিএনপি দাবি করে।
চকরিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী খোকন মিয়া অভিযোগ করেন, ধানের শীষ প্রতীকের একক প্রার্থী অ্যাড. হাসিনা আহমেদের নির্বাচনী প্রচারণায় একের পর এক হামলা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগের সশস্র সন্ত্রাসীরা। চকরিয়ার কোথাও অ্যাড. হাসিনা আহমেদকে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দিচ্চেনা তার নির্বাচনী প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সশস্র ক্যাডাররা। গত ১৫ ডিসেম্বর সকালে পেকুয়াস্থ নিজ বাস ভবন থেকে চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজার ইউনিয়নে আসেন বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একক প্রার্থী অ্যাডভোকেট হাসিনা আহমেদ। সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে তিনি বিএনপি নেতা-কর্মীদের নিয়ে ইউনিয়নের কাটাখালী এলাকায় ধানের শীষ প্রতীকের নির্বাচনী প্রচারণা চালান। এ সময় আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগের একদল স্বশস্ত্র ক্যাডার তাদের গাড়ি বহরে হামলা চালায়। পরে ওই এলাকা থেকে বের হয়ে আসার পথে দুপুর ১২ টার দিকে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের গেইটের সামনে আবারও আ’লীগের ক্যাডারদের সশস্র হামলার শিকার হন অ্যাভোকেটহাসিনা আহমেদসহ বিএনপি নেতা-কর্মীরা। হামলায় নির্বাচনী প্রচারণা বহরে থাকা বিএনপির অন্তত ৩০ জন নেতা-কর্মী আহত হয়। তবে বেঁচে যান ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী অ্যাডভোকেট হাসিনা আহমেদ। হামলাকারিরা ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী অ্যাভোকেটহাসিনা আহমদের গাড়ি ও সাংবাদিকদের গাড়িসহ অন্তত ৭ টি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং ২ টি মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নিয়ে যায় বলেও জানান তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের সহধর্মীনি ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী অ্যাডভোকেট হাসিনা আহমেদ বলেন, আমি ও আমার কর্মী সমর্থকরা কোনো এলাকায় নির্বাচনী গণসংযোগ, পথসভা কিংবা অন্য কোনো নির্বাচনী কর্মসূচি ঘোষণা করলেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন আমরা যাওয়ার আগেই সেখানে গোলাগুলি, নেতা-কর্মীদের মারধর ও ভয়ভীতি দেখিয়ে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করছে। এ কারনে তিনদিন পর্যন্ত আমি আমার নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ রাখতে বাধ্য হই। তিনি আরও বলেন, তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন নিজেরাই গোলাগুলি, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে উল্টো আমাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ঘরছাড়া করে দিচ্ছে। যাতে তারা আমার নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে না পারে।
প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষ পাতিত্বের অভিযোগ অভিযোগ এনে হাসিনা আহমেদ বলেন, চকরিয়া পৌর সদরে বিএনপির নির্বাচনী প্রচার মিছিলে আ’লীগের সশস্র ক্যাডাররা হামলা চালিয়ে পৌর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র নুরুল ইসলাম হায়দারসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীদের আহত করলেও এ ঘটনায় পুলিশ আমাদের মামলা না নিয়ে থানা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। হাসিনা আহমেদ আরও বলেন, আমরা চকরিয়া-পেকুয়ার নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছি। নেতা-কর্মী ও সমর্থকরাও ধৈর্য্যধারণ করছেন