পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠনের উদ্যোগ

31

নির্বাচন ছাড়াই আবারও পার্বত্য তিনটি জেলা পরিষদ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। আইনে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই দলীয় লোক দিয়ে পরিষদ তিনটি পুনর্গঠন করে আসছে ক্ষমতাসীনরা। এরই মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছে নতুন সরকার। একই ধারাবাহিকতায় সরকার এবারও পরিষদ তিনটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে প্রবর্তনের পর গত ত্রিশ বছর ধরে কোনা নির্বাচন নেই এ পরিষদ তিনটিতে। ফলে পরিষদ তিনটি পরিণত হয়েছে সরকারদলীয় প্রতিষ্ঠানে। প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত না হওয়ায় জনমনে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও হতাশা। আইনে সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে তালিকাভুক্ত ভোটারদের দিয়ে প্রত্যক্ষ ভোটে এ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন হওয়ার কথা। অথচ সরকারদলীয় লোক মনোনয়ন দিয়ে পুনর্গঠন হয়ে আসছে এ তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর দেশের মোট ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলা পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে গত ত্রিশ বছরে নির্বাচন দেয়া হয়নি।
সূত্র জানায়, পৃথক আইনে প্রবর্তিত তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রথম ও শেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন। পরবর্তীতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার- যদিও আইনে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানে স্থানীয় জনগণের তীব্র দাবি উপেক্ষা করে সরকার পরিষদ তিনটি পরিচালনা করে আসছে নিজেদের লোক মনোনয়ন দিয়ে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির শর্তে প্রবর্তিত বিশেষায়িত এ তিনটি পরিষদের আইনে বলা আছে, পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে প্রণীত পৃথক ভোটার তালিকায় রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন ১ জন চেয়ারম্যান এবং ৩৩ জন সদস্য। পরিষদ আইনে বলা আছে, প্রত্যেক পরিষদে সংশ্লিষ্ট জেলার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে উপজাতিদের মধ্য হতে ১ জন চেয়ারম্যান ও ২০ জন সদস্য, অ-উপজাতি ১০ জন এবং সংরক্ষিত তিনটি মহিলা আসনে ২ জন উপজাতি ও ১ জন অ-উপজাতি সদস্য নির্বাচিত হবেন। প্রতিটি নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। কিন্তু গত ৩০ বছর ধরে নির্বাচন না হওয়ায় পরিষদ তিনটিতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারেনি।
এদিকে ১৯৯৬ সালের ৫ আগস্ট নির্বাচিত তিনটি পরিষদ ভেঙে দিয়ে প্রত্যেক পরিষদে ১ জন চেয়ারম্যান ও ৪ জন সদস্য মনোনয়ন দিয়ে তিনটিতে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। পাশাপাশি ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির শর্তে ১৯৯৮ সালে আইন সংশোধন করে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ থেকে ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ নামে সংশোধিত হয়। এরপরও আজ পর্যন্ত নির্বাচন দেয়নি সরকার। বরাবরই একই ধারাবাহিকতায় নিজস্ব লোক দিয়ে পরিষদ তিনটি পরিচালনা করে আসছে গত সরকারগুলো। এর আগে সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটিতে ১ জন চেয়ারম্যানসহ সদস্য সংখ্যা ৫ থেকে ১৫-তে উন্নীত করে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করে গত সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন না হওয়ায় জনপ্রতিনিধিত্বশীল হয়েও দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এ তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। এতে দলীয় লোকজন লাভবান হলেও বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ জনগণ। তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে জোরালো দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ স্থানীয় জনগণ। অপরদিকে সরকারের পক্ষে পরিষদ তিনটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলা হলেও এর বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেই।
সূত্রে জানা যায়, আইন অনুযায়ী এ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ জন্য নির্বাচনী এলাকা ও সীমা পুন:নির্ধারণের কথাও উল্লেখ ছিল। এসব বিষয়ে ২০১৬ সালের ১৪ জুন বৈঠক হয়েছিল পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে। বৈঠকে পার্বত্য তিনটি জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন বিধিমালা প্রণয়নের বিষয়ে আলোচনা হয়। বিধিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব ইসিকে (নির্বাচন কমিশন) দেয়ার প্রস্তাবও ওঠে।
তবে ইসি সূত্রে বলা হয়, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন তিনটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের যে একবার নির্বাচন হয়েছিল তা অনেকটা ছিল মনোনয়নের মতো। ওটাকে প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত গণভোট বলা যায় না। প্রত্যেক পার্বত্য জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে কেবল উপজাতীয় এবং সদস্য পদে উপজাতীয় অ-উপজাতীয় কোটাভিত্তিক সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রার্থীকে নির্বাচনে যোগ্য বলে ভাবা হবে। তবে তার আগে আইন অনুযায়ী প্রণীত পৃথক তিনটি ভোটার তালিকায় নির্বাচন ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকতার বিষয়টি সুরাহা করে নিতে হবে।
স্থানীয় বিশিষ্টজনদের মন্তব্য, সরকার নির্বাচন ছাড়া দলীয় লোক মনোনয়ন দিয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদ তিনটি পরিচালনা করায় একদিকে যেমন এসব জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, তেমনি পরিষদ তিনটি হারাতে বসেছে জনগণের আস্থা। বর্তমানে পরিষদ তিনটি পরিণত হয়েছে দলীয় প্রতিষ্ঠান ও অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায়। এতে জড়িত সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। ফলে জনমনে বাড়ছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
১৯৮৯ সালের ২৫ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের (বর্তমান জেলা পরিষদ) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন গৌতম দেওয়ান। সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করাসহ পার্বত্য চুক্তির শর্ত পালনে তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদে নির্বাচন জরুরি। বর্তমানে মনোনীত পরিষদের আকার ও সংখ্যা বাড়ানো হলেও এখানে যোগ্যতার মাপকাঠি দলীয় পরিচয়। নির্বাচিত পরিষদ না হওয়াতে জনপ্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে জবাবদিহিতা থাকার কথা তা নেই।
রাঙামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অরুণ কান্তি চাকমা বলেন, আইনে বলা আছে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা না করে যে দল ক্ষমতায় যায়, সেই দল নিজেদের লোক দিয়ে তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পরিচালনা করছে। ১৪-১৫ সদস্য দিয়ে মনগড়া শাসন-শোষণ চলছে পরিষদ তিনটিতে। এতে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছেন।