পারিবারিক সহিংসতা সমাজ ব্যবস্থার জন্য হুমকি

49

মু. সায়েম আহমদ

পরিবার হচ্ছে সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠান বা আয়না। যা আমাদের প্রকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত। আমরা এখান থেকেই জীবনের সকল কিছু শিখতে পারি। সমাজে চলতে ফিরতে সকল কিছু প্রাথমিকভাবে পরিবার থেকে শিখি। পরিবারের সব সদস্যের অধিকার সমান। চাই সে ছোট হোক কিংবা বড়। সবার মর্যাদা যথাযোগ্য। পরিবারের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থার উন্নত সাধিত হয়। কারণ, পরিবার ছাড়া সমাজব্যবস্থা অর্থহীন। অ্যারিস্টোটলের মতে, যে সমাজে বাস করে না, সে হয়তো পশু নয়তো দেবতা। এই পরিবার যেমন সুখের, তেমনি দুঃখেরও। কারণ, এই পরিবারকে ঘিরে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনা ঘটে থাকে। যা পারিবারিক সহিংসতা নামে পরিচিত আমাদের মাঝে। সহিংসতা অর্থ হিংসাযুক্ত আচরণ বা অমানবিক আচরণ। হিংসার বশবর্তী হয়ে একে অপরের প্রতি যে আচরণ করে তাই সহিংসতা হিসেবে পরিচিত। পরিবারের এক সদস্য কর্তৃক অপর সদস্য সহিংসতা আচরণ বা অমানবিক আচরণের শিকার হন। বিশেষ করে, করোনাকালে আমাদের দেশে পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মধ্যে অধিকাংশ সহিংসতার শিকার নারী ও শিশু। বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ এর তথ্য মতে,আমাদের দেশে পারিবারিক সহিংসতা বেশি দেখা যায়। আর সেটা করোনাকালে বেশি উপলব্ধি করা যায়। এই পারিবারিক সহিংসতা ৬৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে নারী। দেশের ২৭ টি জেলায় ২০২০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৪২৪৯ জন নারী এবং ৪৫৬ জন শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এরপর আর কোন সমীক্ষা হয়নি এখন পর্যন্ত। শিশুদের মধ্যে শতকরা ৯২ ভাগ তাদের বাবা-মা ও আত্মীয়দের দ্বারা নির্যাতিত। শিশুরা ছোট বলে কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে না। তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অমানবিক আচরণ করে থাকে। আর নারীরা বেশিরভাগই স্বামীর হাতে নির্যাতিত। তাদের কোথাও যাওয়ার ঠাঁই নেই বলে যেতে পারে না। সব কিছু নিশ্চুপভাবে সহ্য করে থাকে। বাংলাদেশে করোনাকালে নারী নির্যাতনের বেশকিছু মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের চোখে পড়ে। যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতিকালে অনেক নারীকে ধর্ষণ করা হয়। ফেনীতে ফেসবুক লাইভে এসে গৃহবধূকে তার স্বামী নির্মমভাবে হত্যা করে। এমন অসংখ্য নির্মম ঘটনা ঘটেছে আমাদের দেশে। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ সালে হচ্ছে নারী ও শিশুকে রক্ষাই মূল আইন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই আইনটি আমাদের দেশে রয়েছে ঠিক কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বাংলাদেশে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার অন্যতম মূল কারণ, পুলিশ ও আদালতের নিকট অভিযোগ না করা। এক জরিপে দেখা যায়, ৮০ % নারী কোনো না কোনো কারণে সহিংসতা শিকার। এদের মধ্যে ৭২% সহিংসতার বিষয়টি প্রকাশ করে না। করোনাকালে আমাদের দেশে অধিকাংশ পুরুষ চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। ফলে তারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত এবং আর্থিকভাবে অসচ্ছল হয়ে পড়েছে। মেজাজ থাকে সবসময় খিটখিটে। আর এসব কিছুর কারণে পরিবারের সদস্যদের উপর অমানবিক আচরণ করে থাকেন অনেক পুরুষ। আর সেটা শিশুদের তুলনায় নারীদের উপর বেশি দেখা যায়। আর এছাড়াও পারিবারিক সহিংসতার কারণ হচ্ছে, বিদ্যাহীন, সুশিক্ষার অভাব, দারিদ্রতা, লোভ-লালসা, মাদকাসক্তি, দায়িত্বহীনতার অভাব, সামাজিক ন্যায়বিচার অভাব, রাষ্ট্রীয় আইনের দুর্বলতা ও প্রয়োগের অপপ্রয়োগ, নৈতিকতার অভাব, পরকীয়া নামক ঘৃণিত কাজ ও হীন-মানসিকতা প্রভৃতি। পরিশেষে বলতে চাই, এরূপ ঘৃণিত কাজটির প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার দ্রæততার সঙ্গে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা। পারিবারিক সহিংসতার সাথে জড়িত থাকা ব্যক্তিকে দেশের আইনের আওতায় এনে যথাযোগ্য শাস্তি প্রয়োগ করা। তাহলে পরবর্তীতে এরকম ঘৃণিত কাজটি করার কেউ সাহস পাবে না। দেশের বিদ্যমান হেল্পলাইনগুলোর নাম্বার জনগণের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া এবং হেল্পলাইন নাম্বারগুলো আরো বেশি সক্রিয় করে তোলা। যাতে করে সবাই খুব সহজে সহযোগিতার সুযোগ লাভ করে। অনলাইনে আইনি পরামর্শ সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা। সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুর আশ্রয় প্রদানের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা। হীন-মানসিকতা পরিবর্তন করে, উদার মানসিকতার অধিকারী হওয়া। পরিবারের সকল সদস্যের সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করা এবং তাদের প্রতি দায়িত্ববান হওয়া। সমাজের প্রত্যেককে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। তাহলেই সম্ভব এমন ঘৃণিত কাজটি রুখে দেওয়া। কেননা, পারিবারিক সহিংসতা সমাজব্যবস্থার জন্য হুমকি।

লেখক: শিক্ষার্থী
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা