পারিবারিক সহিংসতা আইনের আশ্রয় গ্রহণ ও প্রয়োগ প্রসঙ্গে

46

জুবায়ের আহমেদ

জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ, ১৯৭৯ ও শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ এ স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ ২০১০ সালে নারী ও শিশুর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা এবং পারিবারিক সহিংসতা হইতে নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ পাশ করে। উক্ত আইনের লঙ্ঘন কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও পারিবারিক সহিংসতা থেকে নারী ও শিশুরা এখনো নিরাপদ নয়। বিশেষ করে স্বামীর গৃহে স্ত্রীকে অধিকার বঞ্চিত করে রাখা, পিতার গৃহে কন্যা সন্তানকে অধিকার বঞ্চিত করে রাখা, তাহার অধিকার প্রয়োগে বাধা দান, শিশু সন্তানকে শারীরিক মানসিক নির্যাতন নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মধ্যে নারীকে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইনেও বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা বর্জনের আহŸান জানানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো স্ত্রীরা স্বামীর গৃহে নিরাপদ নয়। স্বামী-শ্বশুর, দেবর-ননদ দ্বারা নির্যাতনের শিকার হতে হয়, অবহেলার শিকার হতে হয়। শিশু সন্তানকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য কিংবা শাসনের নামে নির্যাতন করা হয়। গৃহবধূ একাধিক কন্যা সন্তানের জন্ম দিলে কিংবা পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে না পারলে এটি স্ত্রীর দোষ হিসেবে গন্য করে শারীরিক মানসিক নির্যাতন করা হয়, তার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করে রাখা হয়। কন্যা শিশুকে অনাদর অবহেলায় ফেলে রাখা হয়। পারিবারিক সহিংসতা এমনই ভয়ানক কর্মকাÐ যে, এসব অপরাধকে পারিবারিক বিষয় হিসেবে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। যার ফলে নারী ও শিশু নিরব অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায় ২০১৭ সালে বিশ্বে মোট ৮৭ হাজার নারীকে হত্যা করা হয়েছে। তার মধ্যে ৫৮ শতাংশ খুন হয়েছে একান্ত সঙ্গী অথবা পরিবারের সদস্যদের হাতে। অ্যাকশানএইড বাংলাদেশের এক গবেষণার তথ্য মতে বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার দুই-তৃতীয়াংশই হয় পারিবারিক পরিমÐলে। আর সহিংসতার প্রায় ৯৭ শতাংশ ভুক্তভোগীর অভিযোগ আদালতে শুনানীর পর্যায়ে যায় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিবাহিত নারীর ৮০ শতাংশই নির্যাতনের শিকার হয় স্বামী দ্বারা। এছাড়ও শ্বশুর-শাশুড়ী-দেবর-ননদদের দ্বারাও নির্যাতন ও হত্যার শিকার হন নারীরা।
বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা তাদের পূর্ণ অধিকার কখনো পায়নি, এখনো পাচ্ছে না। নারী শিক্ষার হার বাড়লেও তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান জানানো, সম্পদের অংশ প্রদান এবং পরিবারে তাদের পূর্ণ অধিকার বাস্তবায়নে স্বয়ং বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবারের সদস্যরাই। এর জন্য সমাজও কম দায়ী নয়। পারিবারিক সহিংসতা আইনের বিষয়টি শুধু পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ বিষয়ে হলেও এর সাথে জড়িত আছে সমাজের ভুল প্রচলিত নিয়ম কানুনও। নারী মানেই ভোগের বস্তু ও ঘরে থাকার মানুষ মনে করে সমাজে নারীদের নিয়ে যে ভুল রীতিনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তা থেকে বের হওয়াও জরুরি। এর জন্য সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে পরিবারের সদস্যদেরকেই। নারীর প্রতি সকল প্রকার পারিবারিক সহিংসতা পরিহারকে নারীকে তার স্বাধীন মতামত গ্রহণের সুযোগ এবং পরিবারের উপর তার সকল অধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই। পাশাপাশি কন্যা সন্তান অভিশাপ নয়, সম্পদ এবং নারী-পুরুষের মধ্যে ধর্মীয়ভাবেও কোন বৈষম্য নেই এই সত্যটি হৃদয়ে ধারণ করতে হবে।
পরিসংখ্যানে জানা যায় পারিবারিক সহিংসতার ঘটনাগুলোতে নারীরা আইনের আশ্রয় গ্রহণ করেন খুব কম। গ্রহণ করলেও তা নিস্পত্তি হয়ে যায় অপরাধ প্রমাণের পূর্বেই। এটি নারীর উদারতার অংশ হলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না বরং বাড়ছেই দিন দিন। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এ নারী ও শিশুর সকল অধিকার সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং উক্ত আইনের লঙ্ঘনের শাস্তি বিধান রাখা হয়েছে। নারী ও শিশুর অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা ও কার্যক্রম গ্রহণের পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। এই অবস্থায় পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া ব্যক্তিরা উক্ত আইনের আশ্রয় নিতে পারে এবং একই সাথে আদালতসহ সকল দায়িত্ববান ব্যক্তিগণ কর্তৃক পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া সকলের সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে উক্ত আইনের বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যরোধ করার বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম), কাটাবন, ঢাকা