পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এত অস্থিরতা কেন ?

87

আমার মনে হয় অসৎকর্মের প্রতিযোগিতা চলছে বাংলাদেশে। কে কার চেয়ে অধিক অসৎ কর্ম করতে পারে তারই যেন লাগামহীন প্রতিযোগিতা চলছে। সাম্প্রতিক সময়ের দুই ছাত্রলীগ নেতার অসৎ কর্ম এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাদের দল থেকে বহিস্কার, ক্যাসিনো কেন্দ্রিক জুয়ার আসরের অসৎ কর্মকান্ডের মাধ্যমে পিলে চমকানো খবর বের হয়ে আসছে। যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে টাকা বানানোর খেলা। খাদ্যে ভেজাল, জীবন রক্ষাকারী ওষুধে ভেজাল, চিকিৎসায় ভেজাল, চিকিৎসকে ভেজাল, অন্যের অর্থসম্পদ লুণ্ঠন, ব্যাংক লুট, শিক্ষায় ভেজাল, গুম, খুন, হত্যা, ছাত্র রাজনীতির নামে সর্বত্র অরাজকতা- সব কিছু মিলে এক ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে দেশে। জাতির মেরুদন্ড যে শিক্ষা সেই শিক্ষা ধ্বংসের প্রতিযোগিতা এবং শিক্ষার মান বিনষ্টের কর্মকান্ড, লুটপাট, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনায় অস্থির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পাবলিক ভার্সিটির ১৭ ভিসির অনিয়ম তদন্তে ইউজিসি (নয়াদিগন্ত ২০/৯/১৯)।
ইউজিসির তদন্ত কমিটির সুপারিশে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক খোন্দকার নাসিরুদ্দিনের পদত্যাগ, সব মিলিয়ে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নেই শান্তির সুবাতাস। শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেহাল দশার কারণে নানাজন নানাভাবে সমালোচনা করছেন। খোদ শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সম্প্রতি এক সভায় বলেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাড়ায় যারা তাদের শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে বাধ্য করেন তারা অপরাধ করছেন। কোচিং না করলে ওই শিক্ষকরা নাকি শিক্ষার্থীদের ফেল করিয়ে দেন।
বিশ্ববিদ্যালয় যেকোনো দেশের জন্য সম্মানজনক ও গৌরবজনক নাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই পড়ার সুযোগ পান না। অত্যন্ত মেধাবী যারা তারাই কঠোর প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে স্থান লাভ করেন। সুতরাং এসব মেধাবী শিক্ষার্থীকে যারা পড়ান তারাও যে দেশের সর্বোচ্চ মেধার অধিকারীই হবেন সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ জাতির গৌরব এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক এবং ভিসিদের নিয়ে নানা কথা উঠছে সর্বত্র এর প্রধান কারণ অনেকে বলেন রাজনীতি। জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে শিক্ষকদের জড়িয়ে পড়ার কারণেই এরূপ কথা উঠছে এবং সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। রাজনীতির কারণে মেধাহীনরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, গবেষণা ও পড়ানোর পরিবর্তে শিক্ষকদের একটা অংশ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন। অভিযোগে বলা হচ্ছে, শিক্ষকরা রাজনীতি করেন ভিসি, প্রো-ভিসি, ডিন, সিনেটের সদস্য হওয়ার জন্য। ইউজিসি, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান চেয়ারটি পাওয়ার আকাক্সক্ষায় রাজনীতি করেন। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে বলেছেন, শিক্ষকদের মধ্যে দায়িত্ববোধ কমে গেছে। তারা তাদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে যতটা সজাগ কর্তব্য সম্পর্কে ততটা সচেতন নন।
গবেষণাকর্ম তো ছেড়েই দিয়েছেন। কেউ কেউ রীতিমত ক্লাসও নেন না। পান্ডিত্যে যারা প্রখর নন তারাই শিক্ষক সমিতিতে ভিড় জমান এবং কর্মকর্তা সেজে নিজের উন্নতির ব্যবস্থা করেন এবং দলাদলিটা জিইয়ে রাখেন। (সংবাদে- এ প্রকাশিত প্রবন্ধের অংশ, ০৭/০৩/১৯৮৮) যদিও এটি সবার জন্য প্রযোজ্য বলে আমরা মনে করতে চাইনা। শিক্ষকদের রাজনীতি বিষয়ক এ ধরনের অভিযোগ ছাড়া দুর্নীতি সম্পর্কে তৎকালে কোন অভিযোগ শোনা যেতন না; কিন্তু বর্তমানে দুর্নীতির খবর হরহামেশা আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের প্রস্তাবিত খরচের তালিকা দেখে অনুমান করা যায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দুর্নীতি কতটা বিস্তার লাভ করেছে। প্রস্তাবে একটি বালিশের মূল্য নাকি ধরা হয়েছে ২৭,৭২০ টাকা, আর এই বালিশের কভারের মূল্য ধরা হয়েছে ২৮,০০০ টাকা। ডিসপোজেবল সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৮০,০০০ টাকা। (সূত্র নয়াদিগন্ত ২ অক্টোবর ২০১৯)। এ সব লুটপাটের কথা জানার কারণেই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা চলতি বাজেটে ১৭৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। দুর্নীতিবাজ উইপোকারা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে অর্থ লুটে নিচ্ছে। দেশের উন্নয়নের জন্য জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের প্রতিটি পয়সার যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য আমাদের ওই সব উইপোকাকে আটক করতে হবে (৩/১০/১৯, নয়াদিগন্ত)। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগের সংবর্ধনা সভায় বলেছেন, দুর্নীতি না হলে দেশের চেহারাই পাল্টে যেত (সূত্র : নয়াদিগন্ত)
দুর্নীতি যে হচ্ছে এবং কী পরিমান ভয়াবহভাবে সর্বস্তরে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করেছে তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে বুঝতে পারা যায়। প্রকৃত অর্থে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে এই দুর্নীতি। প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশের নেতাসহ একেবারে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে দুর্নীতি। বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, কিছু নেতা শেয়ারবাজার ও ব্যাংক কেলেংকারীর সাথে জড়িত। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমাদের শুনতে হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অরাজকতার আখড়ায় পরিণত করার কথা। শোনা যায় সাবেক ছাত্রনেতাদের সম্পদের ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবিশ্বাস ঘটনার কথা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘গুটি কয়েকের কারণে আওয়ামী লীগের অর্জন ম্লান হতে পারে না। (সূত্র : নয়াদিগন্ত ৯/১০/১৯)।
ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যারা ভাবেন, যারা গবেষণা করেন, যারা দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্ররাজনীতির গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা এবং মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও জানেন যে যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত, যারা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থেকে অন্যায় অপকর্মের মাধ্যমে রাতারাতি অগাধ সম্পদের অধিকারী হতে চান তাদের সংখ্যা মন্ত্রী উল্লিখিত গুটি কয়েকই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হলগুলোতে হাতে গোনা কয়েকজন নেতাই থাকেন। এসব নেতাই হলের সব অরাজনৈতিক শিক্ষার্থীদের কন্ট্রোল করেন। নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিছিল মিটিংয়ে নিয়ে যান দল ভারীর জন্য। হলে থাকার প্রয়োজনেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সভা সমিতি ও মিছিলে যোগদান করেন। যখন অন্য দল ক্ষমতায় বসে তখন আবার এসব সাধারণ শিক্ষার্থীই নতুন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের দখলে চলে যান। এ ভাবেই চলে ছাত্র রাজনীতি। এ ভাবেই ব্যবহৃত হন অরাজনৈতিক সাধারণ শিক্ষার্থীরা। প্রকৃত অর্থে তারা সরল সোজা পড়ুয়া শিক্ষার্থী। এরা কখনো অন্যায় করেন না। প্রায়ই নেতাদের দ্বারা অন্যায় কাজে ব্যবহৃত হন। রাষ্ট্রের প্রায় সব ক্ষেত্রেই একই অবস্থা। এরূপ অন্যায়কারী (অবিশ্বাসী) আর অন্যায় কাজে ব্যবহৃতদের বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছেÑ কেউ তার বিশ্বাস স্থাপনের পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং সত্য প্রত্যাখ্যানের জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখিলে তার ওপর আপতিত হবে আল্লাহর ক্রোধ এবং তার জন্য আছে মহাশাস্তি ; তবে তার জন্য নয় যাকে সত্য প্রত্যাখ্যানে বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত বিশ্বাসে অবিচলিত (সূরা নাহল। আয়াত ১০৬)। সূরা নাহলে আরও একটি আয়াত (৯৭) আছে, যেখানে বলা হয়েছেÑ ‘বিশ্বাসী হইয়া পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম করিবে তাহাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করিব এবং তাহাদিগকে তাহাদিগের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করিব।’
পবিত্র কুরআনের আয়াতে স্পষ্ট যে, যারা বিশ্বাসী অর্থাৎ আল্লাহকে এবং পরকালে বিশ্বাস করেন তারা সৎকর্ম করেন। এটাই বিশ্বাসীদের ধর্ম। ঘুরিয়ে বললে বোঝায় যারা সৎকর্ম করেন না বরং অসৎ কর্ম করে তারা অবিশ্বাসী। এই বক্তব্যের আলোকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিবেচনা করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মুসলিম নামধারী হলেও যারা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, গুম, মিথ্যা মামলা, জমি দখল, খাদ্যে ভেজাল, ভেজাল ওষুধ ও মদ, জুয়াসহ নানা অসৎ কর্মে জড়িত তাদের বিশ্বাস নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ তাদের কর্ম সৎ নয়। সৎকর্ম নয়, ক্যাসিনো অর্থাৎ জুয়ার কারবার ও জুয়ার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন। অসৎ কর্মের মাধ্যমে যে অগাধ সম্পদের মালিক হওয়া যায় তা অবাক বিস্ময়ে দেশের মানুষ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। অনেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উপার্জন করেছেনÑ অবৈধ পথে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শাস্তি ও কারাগার বরাদ্দ হয়েছে তাদের জন্য। এটাই অবিশ্বাসী ও অসৎ কর্মে যুক্ত মানুষদের শেষ পরিণতি। যার কথা আল্লাহ ঘোষণা করেছেন সূরা না হলে- বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং সৎকর্ম-অসৎ কর্মের ফল যে মানুষ ইহকাল এবং পরকালে ভোগ করবে সে কথা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ ভাবেই বলেছেন-
কিন্তু আমরা বুঝি না, বুঝতে চাই না, বুঝলেও মানি না। মানতে চাই না। এটাই মানব সম্প্রদায়ের অন্ধকার দিক। এসব বিষয় নিয়ে বুঝার ও অনুসন্ধান প্রয়োজন সর্বাগ্রে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট