পাপের ভরা পূর্ণ হলেই শুরু হয় প্রকৃতির নির্মম প্রতিদান

362

কল্যাণ করতে হবে সবাইরই জন্য। নিজের কল্যাণ ও অন্যের কল্যাণ। প্রশ্ন করা যায়, অন্যের কল্যাণ কামনা করে আমার লাভ কী ? লাভ আছে, বিশ্বখ্যাত এ মাসটির নিউরোসায়েন্টিস্ট প্রফেসর ফ্রান্সিস স্মিথের ভাষায়, ‘মানুষ যদি আবিষ্কার করতে পারে কেন সে সৃষ্টির সেরা এবং সে অনন্য, তাহলে হয়তো সে নিজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে না; বরং এখনকার চেয়ে নিজকে বেশি শ্রদ্ধা করবে। পৃথিবীকে স্বর্গের অংশ হিসেবে। অনিষ্ট করার পরিবর্তে অন্যের কল্যাণ চাইতে শুরু করবে। কারণ অন্যের কল্যাণ চাইলে আপনার কল্যাণ হবে। অন্যের অকল্যাণ চাইলে আপনার নিজেরই অকল্যাণ হবে। এটাই হচ্ছে Law of natural gift ‘প্রকৃতির প্রতিদান’।
প্রতিটি কাজেই রয়েছে ‘প্রকৃতির প্রতিদান’ ভাল করলে ভাল পাবেন, মন্দ করলে মন্দ পাবেন। কাউকে খুন (হত্যা) করবেন তো নিজে খুন হবেন। গুম করলে নিজে একদিন গুম হবেন। আপনি বলতে পারেন, সাক্ষী রাখবো না। সাক্ষী ছাড়া বিচার করবে কে ? এক সময়ের দায়রা জজ নরেন্দ্র কুমার দাস কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘প্রকৃতি নির্জীব’ চলৎ শক্তিহীন ও সর্বংসহা মনে হলেও আসলে তা নয়, বরং প্রকৃতি নির্মম প্রতিশোধ গ্রহণকারী ‘প্রকৃতি কারো অনু পরিমাণ অপরাধও সহ্য করে না। বরং সময়ের প্রয়োজনে ঠিকই বিক্ষুব্ধ ও সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অপরাধ ও অপরাধীর প্রতিবিধান হয় প্রকৃতির আদালতে। তবে অন্তর্দৃষ্টি সমুন্নরাই শুধু তা উপলব্ধি করতে পারেন। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষীর অভাবে আদালতও অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারে না অনেক সময়। কিন্তু ওরা কখনো প্রকৃতির রূঢ়তা ও নির্মম প্রতিশোধ থেকে বাঁচতে পারে না। কোনো না কোনোভাবে প্রকৃতিগতভাবেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়ে যায়। অপঘাত, অপমৃত্যু, দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক ও দুরারোগ্য রোগ ভোগ। দুর্ঘটনা, পারিবারিক ও সামাজিক কলহ-বিবাদ, গণমানুষের রুদ্ররোষ, রাষ্ট্রাচারের বিচ্যুতি, প্রাকৃতিক দুযোর্গ, মহামারিসহ নানাবিধ প্রতিকূলতার মাধ্যমে শাস্তি পায় আর এই প্রাপ্য শাস্তি হয়ে থাকে মানুষের কল্পনারও অতীত। রয়েছে স্মরণীয় ঘটনা। ৮০ বছর আগের কথা। তখন নোয়াখালী, ঢাকা, কুমিল্লা প্রভৃতি এলাকার লোক রেংগুন বা বর্তমান মিয়ানমারের কাজ করতে যেতেন। বিক্রমপুর এলাকার দুই বাল্যবন্ধু ব্যবসা করতে গেলেন মিয়ানমারে অর্থাৎ বার্মায়। ব্যবসা করতে করতে অনেক টাকা-পয়সা হাতে আসে। ভাবলেন, যে টাকা পয়সা হয়েছে তাতেই চলে যাবে বাকি জীবন। দেশে আসতে মনস্থির করলেন। এর মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপান রেঙ্গুন আক্রমণ করলে বহু মানুষ হতাহত হয়। তখন দুই বন্ধু বাড়ির পথে। হঠাৎ বৃষ্টি এ কারণে দুই বন্ধু এক গাছতলায় আশ্রয় নিলেন বৃষ্টি কমছে না, ক্রমেই বাড়ছে। দুই বন্ধুর মধ্যে একজন হৃষ্টপুষ্ট, অপরজন শুকনা। কথায় বলে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা, বৃষ্টির কারণে অপেক্ষা করতে করতে পরামর্শ দিলো, শুকনা বন্ধুকে মেরে তার টাকা পয়সা তুই নিয়ে নে। দ্বিগুণ ধনসম্পদের মালিক হয়ে যাবো। তখন কেবল সুখ আর সুখ। এখানে মারলে কোনো প্রমাণ থাকবে না। শয়তানের প্ররোচণায় হৃষ্টপুষ্ট বন্ধু শুকনো বন্ধুর গলা চেপে ধরে। শুকনো বন্ধু ভাবল, হৃষ্টপুষ্ট বন্ধু মজা করছে, তাই গলার চেপে ধরা হাত আলগা করার চেষ্টা করতে করতে বলেন, ‘ছাড়, ছাড় দম বন্ধ হয়ে আসছে’।
দম বন্ধ হওয়ার জন্যই তো ধরেছি, তোকে মেরে তোর সব টাকাকড়ি আমি নিয়ে যাবো। আমায় মেরো না, আমার সব টাকা আমি তোমাকে দিব, তা হয় না। বাড়িতে গিয়েই সালিশ ডেকে আমাকে অপমান করা সহ তোমার টাকা আদায় করে নেবে।
এখানে সেরে গেলে কোনো প্রমান থাকবে না। জাপানি সৈনিকের গোলাগুলিতে কতলোক মারা গেছে। বলব, তুইও মারা গেছিস জাপান সৈনিকের গুলিতে। তোকে মেরে তোর টাকা-পয়সা সব কিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এ খুনের কোনো সাক্ষিই থাকবে না। এ ভাবে বন্ধুকে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে সব টাকা কড়ি নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। বানানো গল্প বললেন, জাপানিরা রেংগুন দখল করে হাজার হাজার লোক মেরে ফেলেছে। মেরে ফেলেছে বন্ধুকেও। নিজে কোনো রকমে জান নিয়ে পালিয়ে এসছি। শুকনো বন্ধুর বাবা-মা ক’দিন কান্নাকাটি করলেন, তারপর সব শেষ। হৃষ্টপুষ্ট বন্ধু পাশের গায়ে বিয়ে করলেন। বাড়িঘরের কাজ ধরেন, নতুন ঘরের দরজায় বসা অবস্থায় এমনই বর্ষার দিন ছিল। সেদিনের মতই মতোই মুষলধারে বৃষ্টি এর পানি ঘরের চাল বেয়ে গড়িয়ে ফোটা ফোটা নিচে পড়ছে। নিচে জমে থাকা পানির ওপর বৃষ্টির ফোটা পড়ে সেদিনের মতো বুধবুধ বা ফোটকার জন্ম হচ্ছিল। তা দেখে হৃষ্টপুষ্ট বন্ধু হাসতে হাসতে বললেন, ‘হায় বোকা বন্ধু, ফোটকা আবার সাক্ষ্য দেয় কী করে। কাছেই ছিল নতুন বউ, সাক্ষী যখন ফোটকার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তখন স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন স্ত্রী। এই মুসলধারার বৃষ্টির মাঝে স্বামীর হাসার কারণ কী? কামরুপকামাক্ষ্যার দেশ মিয়ানমার। বহু দিন ছিলেন মিয়ানমারে নিশ্চয়ই কোনো বান্ধবী রেখে এসেছেন। তা গোপন করে আবার বিয়ে করেছেন। বান্ধবীর কথা মনে পড়তেই এই হাসি। রহস্য জানতেই হবে। বউ স্বামীর কাছে হাসির রহস্য জানতে চান, স্বামী বুঝতে পারেন, হাসির কারণ হিসেবে একটা কিছু বলতেই হবে। কী বলবেন। বানানো কথা বিশ্বাস করাতে না পারলে সমস্যা বাড়বে। এদিকে-ওদিক বলতে গেলে জটিলতা বাড়বে। স্ত্রী তো নিজের মানুষই। স্বামীর ক্ষতি হলে তারও ক্ষতি। এক সময় সব ঘটনা বলে ফেলেন স্ত্রীর কাছে। আর যাবেন কোথায়। স্বামী একজন খুনি। স্বার্থের জন্য যে নিজের বাল্যবন্ধুকে খুন করতে পারে। সে নিজের স্ত্রীকেও খুন করতে পারবে ভাবতে গিয়েই বউ ভয়ে শিওরে ওঠেন। ক’দিন পরই চলে যান বাপের বাড়ি। বাপের পা জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন, ‘বাবা’ তুমি আমাকে মেরে কেটে টুকরো করে ফেল। কিন্তু ওই খুনির কাছে আর দিওনা। তোমাদের জামাই একজন খুনি। যে বন্ধুকে খুন করতে পারে সে আমাকেও খুন করতে পারে।
এক কান, দুই কান-শুরু হয় কানাকানি। জানতে পারে শুকনো বন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে তার বাবা, মা ও আত্মীয়স্বজনরাও। শুরু হয় থানা-পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেফতার, রিমান্ড, স্বীকারোক্তি, সাক্ষী, জেরা ইত্যাদি। শেষ পরিনাম হৃষ্টপুষ্ট বন্ধুর পরিনাম ফাঁসির দন্ডাদেশ। অর্থাৎ পাপের ভরা পূর্ণ হলেই শুরু হয় প্রকৃতির নির্মম প্রতিদান। কয়েক বছর আগে নারায়নগঞ্জের সাত খুন। লাশের পেট ফেড়ে ইট বেধে তিল নদীর মোহনায় লাশ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। পেটফোটা ইটবাধা লাশ ভেসে ওটার কথা বিজ্ঞানও স্বীকার করেনা। লাশ তিন নদীর মোহনা থেকে, বেধে রাখা ভারী ইটসহ একে একে ভেসে উঠতে শুরু করে। যে লাশ ভাটির টানে দক্ষিণে ভেসে যাওয়ার কথা, সে লাশ উজান ঠেলে চলে আসে উত্তরে-সর্বোপরি যে এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়েছিল ঠিক সে এলাকায়।
এ মামলার অন্যতম আসামী সাবেক র‌্যাব অধিনায়ক তারেক সাঈদ, তার সাথে ঘটনাক্রমে একই হাজতে রাজনীতিক ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন ছিলেন। একজন খুনের দায়ে। আরেকজন রাজনৈতিক কারণে, নামাজ আদায় করতেন একই মসজিদে একদিন কথা প্রসঙ্গে তারেক সাঈদ বলেছেন, এখন নিয়মিত নামাজ আদায় করি। আল্লাহ আছেন সর্বান্ত করণে বিশ্বাসও করি। পেট কেটে ইট বেধে লাশ ডুবালে ভেসে ওঠার কোন নজির নেই। সাতটি লাশ যখন একে একে ভেসে উঠতে শুরু করে তখনই টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে স্বীকার করছি। একজন নিশ্চয়ই আছেন। পাপের ভরা পূর্ণ হলেই তার বিচার শুরু হয়। (তারেক সাঈদ সম্পর্কিত বক্তব্যটি ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন জেল থেকে বের হওয়ার পর প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন) পাপের ভরা যখন পূর্ণ হয় তখনই শুরু হয়ে যায় প্রকৃতির নির্মম প্রতিদান। ধর্ম ও ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখা ও বুঝা যায়। ফেরাউন, নসরুদ থেকে শুরু করে হিটলার পর্যন্ত কেউ রেহাই পায়নি- হয় দুরারোগ্য রোগ যন্ত্রনায়, হয় আত্মহত্যায় বা মৃত্যুদÐ কোনো না কোনভাবে প্রকৃতির নির্মমতার শিকার হয়েছে।
কথায় বলে, পরের জন্য খাদ করলে সে খাদে নিজেই পড়তে হয়। এ কথার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলে, অন্যকে খাদে ফেরার জন্য খোদাইকৃত খাদ লতা পাতা-ডালপালা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। যে খাদ বানালে তার মাথায় সর্বদা খাদের দিকেই নিয়ে যাবে তাকে। একটু অসতর্ক হলেই যার খাদে সেই পড়ে।
অন্যের মঙ্গল কামনা করলে নিজের মঙ্গল হবে। অন্যের অমঙ্গল কামনা করলে নিজেরই অমঙ্গল হবে। যার মঙ্গল কামনা করবেন, তার কাছ থেকে কোনো প্রতিদান চাইবেন না। প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়া অন্যের মঙ্গল করলে দেখবেন। প্রকৃতির প্রতিদান হিসেবে এমন একজনের সাহাজ্য লাভ করবেন, যা আপনি কল্পনাও করতে পারেননি। যে অন্যের ক্ষতি করে সে কখনো ভাল থাকেনা। থাকতে পারে না। ক্ষতির পরিমান যত বড় প্রকৃতির প্রতিদানের পরিমাণও তত ভয়াবহ।
(এই লেখাটি কোয়ান্টাম মেথড কোর্স থেকে বোখারী মহাজকের বক্তব্যের আলোকে)
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট