পশ্চিমী ঝঞ্ঝায় এগিয়ে আসছে বড় মেঘমালা

43

মধ্য-মাঘে দেশের অধিকাংশ এলাকার ওপর দিয়ে ছড়ি ঘোরাতে থাকা মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহে বাগড়া দিতে ভূমধ্যসাগরে উৎপত্তি হয়েছে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। ওই ঝঞ্ঝার প্রভাবে দেশের দিকে এগিয়ে আসছে বড় মেঘমালা। আজ মঙ্গলবার ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ধীরে ধীরে দেশের আকাশের দখল নিতে পারে বৃষ্টিবাহী এই মেঘমালা। তার জেরে আগামীকাল বুধবার থেকে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নামতে পারে হালকা বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। কোথাওবা বৃষ্টির ধরন হতে পারে মাঝারি। জানুয়ারির শেষদিন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকতে পারে।
চলতি শীত মৌসুমের তৃতীয় দফার এই বৃষ্টিপাতকে সামনে রেখে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর ও আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে একটি বিশেষ কৃষি আবহাওয়া সতর্কবার্তা প্রচার করা হয়েছে। তাতে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, সেচ, সার ও বালাইনাশক ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে। পরিপক্ক সবজি ও ফল সংগ্রহ করে ফেলতে হবে। বৃষ্টির সময় জমিতে যাতে পানি জমতে না পারে, সেজন্য পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দিতে হবে। জমির আইল উঁচু করে দিতে হবে। দÐায়মান ফসলের জন্য বিশেষ খুঁটির ব্যবস্থা করতে হবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, এবারের শীত মৌসুমে চলমান শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা ও বিস্তৃতি অন্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি। খুব সম্ভবত এটাই চলতি শীত মৌসুমের শেষ শৈত্যপ্রবাহ। ইতোমধ্যে পাকিস্তান ও ভারত হয়ে একটি বড় মেঘমালা বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। এর প্রভাবে আগামীকাল বুধবার থেকে দু-তিন দিন বিচ্ছিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হতে পারে। দেশের অন্তত ৩২ জেলা কমবেশি শীতকালীন এই বৃষ্টিপাতের আওতায় থাকতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে শীত বিদায় নিতে পারে। এসময়ের মধ্যে দেশে তাপমাত্রা কিছুটা বাড়বে। মূলতঃ ফেব্রæয়ারি থেকে দেশে সামগ্রিকভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। বিচ্ছিন্নভাবে দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা অনেক কমে যেতে পারে। তবে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শীতের তীব্রতা কমে আসতে পারে।
প্রসঙ্গত, পশ্চিমী ঝঞ্ঝা হল বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ বা লঘুচাপের মত শীতকালে ভূমধ্যসাগরে উৎপত্তি হওয়া এক ধরনের প্রাকৃতিক গোলযোগ। যা ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রবাহ পথ অতিক্রম করার সময় এটি কাস্পিয়ান সাগর ও দক্ষিণ পার্শিয়ান উপসাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প শোষণ করে। পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাবে এ অঞ্চলে হালকা থেকে মাঝারি কিংবা কোথাও ভারী বৃষ্টিপাত হয়। একইসাথে উত্তর-পশ্চিম হিমাল?য়ের পার্বত্য এলাকায় তুষারপাত হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে শুরু করে। মাঝখানে আকাশে মেঘের ঘনঘটা আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির প্রভাবে তাপমাত্রার পারদ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় সপ্তাহখানেকের জন্য বিরতি নিতে বাধ্য হয়েছিল। বাকি সময়জুড়ে দেশের কোথাও না কোথাও শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। গত ২৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া চলতি শৈত্যপ্রবাহটি প্রথমে দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় ছিল। সর্বশেষ গত ২৬ জানুয়ারি তা দেশের ৮০ ভাগ এলাকাজুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে। অবশ্য এবারের শৈত্যপ্রবাহের দাপট সবচেয়ে বেশি ছিল উত্তরাঞ্চলে। আর সবচেয়ে কম ছিল চট্টগ্রাম বিভাগে। গতকাল সোমবার থেকে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পারদ ফের চড়তে শুরু করেছে। আগের দিনের তুলনায় দেড় ডিগ্রি বেড়ে গতকাল সোমবার সর্বউত্তরের জনপদ তেঁতুলিয়া ও যশোরে যৌথভাবে দেশের সর্বনিম্ন সাত দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আর সর্বোচ্চ ২৮ দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল যথারীতি মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফ উপজেলায়। চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে সীতাকুন্ড আর কুমিল্লা বাদে বাকি সব এলাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ডাবল ডিজিট বা দুই অংকে অবস্থান করছে। সোমবার সীতাকুন্ডে সর্বনিম্ন নয় দশমিক পাঁচ এবং কুমিল্লায় নয় দশমিক নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েওেছ। আর চট্টগ্রাম বিভাগজুড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৩ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই উঠানামা করেছে।
অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার দৃশ্যপটে বলা হয়েছে, উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ এবং তৎসংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। আর পূর্বাভাসে বলা হয়, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। শেষরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, সীতাকুন্ড, কুমিল্লা, শ্রীমঙ্গল, রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুমারখালী অঞ্চলসহ রংপুর বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা কিছু কিছু জায়গায় প্রশমিত হতে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা এক থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা বা দুদিনের আবহাওয়ার অবস্থায় হালকা বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাতের আলামত রয়েছে বলে পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উত্তুরে হাওয়ায় ডিসেম্বরের শুরু থেকেই তাপমাত্রার পারদের পতন শুরু হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত সাত ডিসেম্বর চলতি মৌসুমে প্রথমবারের মত সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পারদ এক অঙ্কের ঘরে নেমে আসে। ওইদিন দেশের সর্বউত্তরের জনপদ তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পরদিন আরও এক ডিগ্রি কমে তা আটের ঘরে নামে। কিন্তু এরপর থেকেই পারদের উর্ধ্বমুখী পথচলা শুরু হয়। টানা চারদিনে তিন ডিগ্রিরও বেশি চড়ার পর ফের পতন ঘটে পারদের। পারদের এই পতনমুখী প্রবণতার মধ্যেই আবহাওয়াবিদরা সারাদেশে শীত জেঁকে বসার আলামত দেখতে পান। এর জেরে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বইতে শুরু করে মৌসুমের প্রথম মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। সর্বনি¤œ তাপমাত্রা নেমে আসে চুয়াডাঙ্গায় সাত দশমিক নয় ডিগ্রিতে। সর্বশেষ গত ২৯ ডিসেম্বর তেঁতুলিয়ায় চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন চার দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এরপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নেমে চড়তে থাকে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।
প্রসঙ্গত, বিগত ২০১৮ সালের আট জানুয়ারি পূর্ববর্তী ৫০ বছরের ইতিহাসের পাতা পাল্টে দিয়ে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিম্ন দুই দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর আগে সিলেট বিভাগের শ্রীমঙ্গলে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম দুই দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৬৮ সালের চার ফেব্রূয়ারি। চলতি বছরের জানুয়ারিতেও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমেছিল। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে মাঝারি এবং আট ডিগ্রির চেয়ে বেশি থেকে ১০ ডিগ্রির মধ্যে হলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে থাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।