পলিথিন-প্লাস্টিক বর্জ্যই ‘বিষফোঁড়া’

194

ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, ‘প্রকৃতিকে অনুসরণ ব্যতিরেকে তাকে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়’। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জলাবদ্ধতা থেকে নগরীকে বাঁচাতে হলে প্রকৃতিকে অনুসরণ করতে হবে। প্রকৃতির শত্রু খ্যাত প্লাস্টিক ব্যবহার ও পাহাড় কাটা বন্ধ না করলে প্রকল্পের পর প্রকল্প আসবে, তবে স্থায়ী সমাধান হবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাড়ে ৫ হাজার কোটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দেড় হাজার কোটি টাকা মিলিয়ে মোট ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এই বিশাল অংকের টাকা বিফলে যাবে।
নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব হয়েছে বাজার। এখন বাজারে কেনাকাটা করতে গেলেই পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতিকর নিষিদ্ধ পলিথিনে ভরে পণ্য দিচ্ছেন বিক্রেতারা। পলিথিন সহজলভ্য হওয়ায় বিক্রেতারাও বাজারে যান খালি হাতে, পলিথিনে ভরে পণ্য নিয়ে ফিরেন ঘরে। আর এসব পলিথিন গৃহস্থালী বর্জ্যরে সাথে ফেলা হয় নালা-খালে। বৃষ্টি হলে নালা-খাল থেকে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত করে পলিথিন বর্জ্য।
সংশ্লিষ্টরা এক হিসেবে জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৬০ লাখ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ১০ লাখ মানুষ ভাসমান। বাকি ৫০ লাখ মানুষের পরিবার হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ। প্রতিটি পরিবার যদি সপ্তাহে নূন্যতম ৩০০ গ্রাম প্লাস্টিক ব্যবহার করে। তাহলে বছরে একটি পরিবার ১৫ দশমিক ৬ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করে। আবার এসব মানুষের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মাত্র ৪০ শতাংশ বাদে বাকিগুলো যত্রতত্র ফেলা হয়। গৃহস্থলে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ছাড়া শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্যও রয়েছে। ঘুরেফিরে এসব বর্জ্য নদী-নালাতেই পতিত হয় বলে জানান পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) সূত্র জানিয়েছে, গত অর্থবছরে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগ ৮ লাখ ২০ হাজার ৭৮৫ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে। তার মধ্যে ১৫ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্য। তার মানে বছরে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার ১১৮ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে চসিক। এর চেয়ে বেশি পরিমাণ প্লাস্টিক প্রতিবছর নদী-নালায় জমে।
নগরীতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সংগ্রহ করতে পারে চসিক। ফলে প্রতিবছরে প্রায় ২ লাখ টনের মত প্লাস্টিক খাল-নালা-নদীতে পতিত হয়। ভয়াবহ এ তথ্যের সত্যতা মিলে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নকারী ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তানভীর মাজহারের কথায়। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। প্রকল্পের অধীনে নালা-খাল পরিষ্কার করে পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। এখানে যেসব ময়লা অপসারণ করা হচ্ছে। তার মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ সরাসরি প্লাস্টিক বর্জ্য। বাকিগুলো প্লাস্টিকের সাথে আটকে থাকা বর্জ্য। তিনিও মনে করেন, প্লাস্টিক বর্জ্য যতদিন নদী-নালায় আসবে, ততদিন প্রকল্পের সুফল পাওয়া সম্ভব না।
প্রকল্পটির পরিচালক কর্নেল শাহ আলী পূর্বদেশকে বলেন, খাল-নালার মূল বর্জ্য হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য। যেগুলো মানুষ সরাসরি খাল-নালায় ফেলছে, আবার বিভিন্নভাবে নদীতে গড়িয়ে আসছে। এই জায়গায় মানুষের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এ রকম যারা সরাসরি ময়লা ফেলে তাদের নিয়ে আমরা ‘স্টাডি’ করছি। তারা কেন ময়লা ফেলে? তাদের বেশিরভাগের অভিযোগ, সিটি কর্পোরেশন ময়লা সংগ্রহ করেনা বা আশপাশে কোনো ডাস্টবিন নেই। সবমিলিয়ে মানুষ কেন এমন হচ্ছে? তার পেছরে কি কি কারণ, তা বের করার চেষ্টা করছি।
সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী পূর্বদেশকে বলেন, সিটি কর্পোরেশন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে, তার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ প্লাস্টিক বর্জ্য নদী-নালায় মিশে যায়। ফলে প্লাস্টিকের সাথে মাটি আটকে গিয়ে নদী-নালা ভরাট হচ্ছে এবং নদীর পানি চরমমাত্রায় দূষণ হচ্ছে। সেটা আবার ছড়িয়ে যাচ্ছে সাগরেও।
প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা ও দূষণ বন্ধ না করে জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো মেগা প্রকল্প কাজে আসবে না। জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দুইটি সংস্থা প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। খাল-নালা পরিষ্কার করা হচ্ছে। তবে যে কারণে খাল-নালা ভরাট হয়, তা নিয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। ফলে একদিকে পরিষ্কার হবে, আর অন্যদিকে প্লাস্টিক-পলিথিনে ভরাট হবে। এভাবে চলতে থাকলে প্রকল্প আসবে আর টাকার অপচয় হবে। এছাড়া আর কিছু হবে ন।
জলাবদ্ধতার নিরসনে কীভাবে প্রকল্পগুলো সফল করা যায়- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি শহর। সড়কের অদূরেই পাহাড়ের সারি। তবে এই পাহাড়গুলোকে নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে। ভূমিদস্যুরা প্রতদিন কোনো না কোনো পাহাড় কাটছে। আর বৃষ্টির সাথে পাহাড়ি মাটিগুলো নালায় এসে পড়ছে। এছাড়া পাহাড়ি মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি। তাই এসব মাটি সহজেই খাল-নালা ভরাট করতে পারে। পাহাড় কাটা বন্ধ না করলে এসব নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। আরেকটি কারণ হল অতিমাত্রায় প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার। দৈনন্দিন জীবনে এমন কোন পর্যায়ে নেই যেখানে প্লাস্টিক ব্যবহার হয় না। সামান্য জুস খাওয়া থেকে শুরু করে রান্না ঘরের সবকটি আইটেমে পলিথিন ব্যবহার হয়। যে পরিমান প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে, তার মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ডাস্টবিনে ফেলা হয়। বাকিগুলো বিভিন্ন নদী-নালায় পতিত হয়। এসব বøক তৈরি করে জলাবদ্ধতা তৈরি করে, আবার দীর্ঘদিনের জন্য নদীর পানি দূষণ করে। যার কারণে নদীতে মাছ বাঁচতে পারছে না। এই দুটি পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ বন্ধ না করা গেলে কোন প্রকল্পই কাজে আসবে না। এছাড়া নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এজন্যও অনেকাংশে দায়ী প্লাস্টিক দূষণ।
তিনি বলেন, কর্ণফুলী খালে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হচ্ছে। কিন্তু নদীর তলানির চারমিটার ভিতরে পর্যন্ত প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভাগাড়। ফলে শক্তিশালী ড্রেজার মেশিনও সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। কেননা এইসব মেশিন দিয়ে মাটি তোলা হয়। কিন্তু প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে ড্রেজারে মেশিন ঠিকভাবে চালানো যাচ্ছে না। তাহলে আমাদের বাঁচা-মরার অবলম্বন কর্ণফুলীকে কোথায় নিয়ে গেছি? এখনও যদি আমরা আমাদের করণীয় সম্পর্কে অবগত না হই, তাহলে তো ধ্বংস ছাড়া কোন পরিণতি নেই। এক সময় বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হবে হাজার বছরের এই চট্টগ্রাম।
এই সমস্যা থেকে উত্তোরণের উপায় কী? এ নিয়ে এই পরিবেশ বিজ্ঞানী বলেন, পৃথিবীর সবদেশে পলিথিন-প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। তবে ব্যবহারের পর সেটা যে জায়গায় যাওয়া উচিত, সেখানে যাচ্ছে। নদী বা নালায় যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে আমাদের দেশে কেন যাচ্ছে? তার অন্যতম কারণ হচ্ছে মানুষের অসচেতনতা। শুধু অসচেতনতা বললে হবে না, বলতে হবে ইচ্ছাকৃত অসচেতনত। কারণ সবাই জানে প্লাস্টিক ব্যবহারের কারণে পরিবেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু তারপরও তারা সচেতন হচ্ছে না, তাই দরকার আইনের কঠোর প্রয়োগ। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে ‘অজুহাত’ দেওয়া ছেড়ে দিয়ে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। যেটা শুরু করবে, তা যেন শেষ হয়।
তিনি আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ নিজেদের চেষ্টায় প্লাস্টিককে গলিয়ে জ্বালানি ও গ্যাস উৎপাদন করছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তা নিয়ে কোন উদ্যোগ নেই। ফলে ব্যবহৃত প্লাস্টিকগুলো কোনভাবে ধ্বংস হচ্ছে না। এক পর্যায়ে তা নদীতেই পড়ছে।