পলাশ দেবের তৃতীয় উপন্যাস উজান স্রোতের ভেলা

61

কবি গল্পকার ও ঔপন্যাসিক পলাশ দেব। গল্প কবিতা লিখলেও পলাশ দেবকে আমরা ঔপন্যাসিক হিসেবে জানি। কেননা, আমরা তার পর পর তিনটা স্বার্থক উপন্যাস পেয়েছি। প্রথম উপন্যাস “পোড়া চাঁদ”(২০১৮ মুক্তচিন্তা), দ্বিতীয় উপন্যাস “টেমস হতে টাইবারের পথে”(২০১৯-মুক্তচিন্তা) এবং এবার ২০২০ বইমেলা তৃতীয় উপন্যাস নিয়ে এসেছেন “ উজান স্রোতের ভেলা”।
“উজান স্রোতের ভেলা’’ একটি সমাজিক উপন্যাস। জেলে পল্লীর জীবনকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের পটভূমি। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া তাদের পেশা। তাছাড়াও কেউ কেউ মাছের আড়তের ব্যবসা করে। অনেকে মনে করে মদ্য পানে সঞ্জীবনী শক্তি। উজানডাঙা ও হিজলতলা গ্রামের মানুষগুলো নিয়ে এই উপন্যাস।
উপন্যাসের প্রধান পুরুষ চরিত্রে মদন ও অজিত। আর নারী চরিত্রে সুখী, গোলাপী ও সোহাগি। এই পাঁচ জন চরিত্র ছাড়াও রামজীবন, মাধব, রাধুর বাপ, হারাধন, গনেশ, হারুর, ধনা, কলিমুদ্দি, রহিমুদ্দি, কাশেম জোয়ারদার, ফজল আলি, ফটিক চাঁদ, লাকী, সুমনের মা, মিঠু ও মিনু। এদেরও রয়েছে ছোট বড় অনেক সংলাপ।
মদনের বউয়ের নাম সুখী। সুখীকে প্রথম পুকুরে স্নান করতে দেখে। দেখার সাথে সাথে সুখীর রূপে মুগ্ধ হয়ে যায়। মদনের মনের ভাষাটা লেখক বর্ণনা করেছেন এভাবে- “ষোলো সতেরো বছরের মেয়ে পুকুর ঘাটে এসে স্নান করে। মেয়েটির রূপ দেখে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো মদন। পুরোপুরি বে-ভোলা সে! মেয়েটি পুকুরের আকন্ঠ জলে নেমে গেলো। আর সরোবরে সদ্য ফোঁটা পদ্ম ফুলের মতোই অপূর্ব কইন্যা তার রূপের রোশনাই ছড়াতে লাগলো। মদনের পা দুটো আর চলচে না! তার মন চলেছে নির্বিকল্প সমাধিতে! এক অদম্য ইচ্ছের কাছে আত্মসমর্পণ করলো সে। নিজেকে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে লাগলো মেয়েটির অপূর্ব জল-কেলি! কী আশ্চর্য মেয়েটির সৌন্দর্য! ওর মনে হচ্ছে কোন ডানাকাটা পরি দুনিয়াতে নেমে এসেছে! অপূর্ব সাদা ফর্সা পিঠের উপর এলিয়ে পড়া চুল। মুখের গড়নটাও অদ্ভুত সুন্দর। আঁট সাঁট শরীরের গাঁথুনী! নবীন সৌষ্ঠবে পরিপূর্ণ স্তন দুটো দুনিয়ার সমস্ত সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ কৃঙ্গের মতো লোভাতুর করে দিচ্ছে মনকে! (পৃষ্টা : ১২-১৩)
হিজলতলার আট ক্লাস পড়া সুখী মদনের বউ হিসেবে এসে সুখের চেয়ে হাজারগুণ পায় দুঃখ। মদনের জন্য সুখীর সংসারে অভাব ও অন্ধকারে কাটে। মদন হচ্ছে অলস ও মদখোর। মদনের বাবা রামজীবনের মৃত্যুর পর মাছ ধরার নৌকা বিক্রি করে দেয়। দিনের বেলায় ঘুরে, সন্ধ্যা হলে মদের দোকান আর রাত হলে মদের নেশায় মাতাল হয়ে সুখীকে পিঠায়। পিঠানোর মূল কারণ হলো সুখীকে ভুল বুঝে সন্দেহ করা। তবুও তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সংসার করে সুখী। মাধব কাকা মদনকে বুঝানোর পর বুঝতে পারে নিজের ভুল। এর পর আবার সুন্দর ভাবে শুরু করে সংসার।
অজিত হচ্ছে বাবা মরা একজন ফকিরনী মায়ের ছেলে। অজিতের মা ভিক্ষা করে। পাঁচ বছর বয়সে অজিতের মা মারা যায়। সমাজে লাথি গুতা খেয়ে অজিত বড় হয়। অজিত প্রচÐ শক্তি সঞ্চয় করে বাহু আর বুকে। যখন তাঁর বয়স পনের ষোল হয় তখন থেকে ধীরে ধীরে প্রতিবাদ করতে শেখে। একটু এদিক ওদিক হলেই অজিত হাঙ্গামা লাগিয়ে দেয়। তখন থেকে সমাজে অজিতকে ভয় পায়। যোগ দেয় জলদস্যুদের দলে। রাতারাতি তৈরী করে টাকার পাহাড়। অবৈধ টাকায় মাছের আড়তের ব্যবসা এবং মাছের মোকাম তৈরি করে। আবার পুরানো পেশাটাও চালিয়ে যায় কেউ না জানে মতো। অজিত মদ ও মেয়ের প্রতি ডুবে যায়। প্রতিরাতে নতুন নতুন মেয়ে আর মদ না পেলে অজিতের ঘুম হয় না।
অজিতের বউ হচ্ছে গোলাপি। তাকে জোর করে বিয়ে করেছে। অজিত যাত্রীবাহী ইস্টিমার লুট করতে গিয়ে, সোহাগিকে তুলে এনে উপপত্নি হিসেবে রেখেছে। লেখক গোলাপি ও সোহাগির রূপের বয়ান দিয়েছেন এভাবে-“গোলাপির জলজ্যন্ত টকটকে লাল লোহার মতো শরীর! কমলার কোয়ার মতো টসটসে ঠোঁট, তুলতুলে স্পঞ্জের মতো নরম উদ্ধত স্তন। খাপখোলা তরোয়াল সোহাগিকে দেখে আঠারো বছরের মর্দ্দ হতে আশি বছরের বুড়োর চোখও যেন কালবৈশাখী ঘুর্ণির মতো হুমরি খেয়ে পড়তে চায়! (পৃষ্টা- ৩৫)
অজিত জীবনে অনেক পাপ কাজ করেছে। নিজের বউকে পর্যন্ত অন্যের কাছে তুলে দিয়েছে ব্যবসাকে শক্ত ও বৃদ্ধি করার জন্য। সেই পাপের ফল ভোগ করতে হলো অজিতকে। অতিরিক্ত মদের নেশায়।
অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেঁচকি তুলেই চলছে। ডানহাতটা বুকের কাছে ধরে আছে। হেঁচকির সাথে গলগলিয়ে বমি করে দিলো অজিত। দুপায়ের মাঝখানে লুঙ্গির উপর দিয়ে মেঝেতে অনেকটা ছড়িয়ে পড়লো। বমির সাথে সাথে বিশ্রী ঝাঁঝালো গন্ধে গোলাপির পেটের নাড়িভুঁড়ি সমেত বেড়িয়ে আসতে চাইছে। সহসা শাড়ির আঁচলা দিয়ে নাক ঢেকে অজিতের পেছনে সরে এলো। এবার পেছন থেকে ওকে শক্ত করে ধরে রইলো গোলাপি। বমির পর বমি করেই চলেছে সে। ঘরদোর সব ডুবিয়ে দিচ্ছে বমিতে। অনেকক্ষণ পর বুকে ডান হাত চেপে ধরে ধরফর করতে লাগলো অজিত।
ডাক্তার এসে অজিতকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়। পরের দিন ঘুম ভাঙে। একটু ভালো হয়। তবে অজিত আগের অজিত নেই। কারণ মৃত্যুযন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পেরেছে। গোলাপি সুমনের মাকে দিয়ে সুখী ও মদনকে আসার জন্য বলে অজিতের বাড়িতে।
মদন ও সুখী আসার পর গোলাপি বলে অজিত অনেক দিন ধরে অসুস্থ। অনেক খারাপ কাজ তো করেছে জীবনে, এবার কিছু ভালো কাজ করতে চায়। এই উজানডাঙা গ্রামে একটা ইস্কুল আর একটা হাসপাতাল করতে চায়। আমাদের ইস্কুলে সব শিশুরা লেখাপড়া করবে। আলোকিত মানুষ হয়ে উঠবে। কথাগুলো শুনার পর সুখী গোলাপিকে জড়িয়ে ধরল।
গোলাপি, সুখী আর সোহাগির চোখের উপর স্কুলের ছবির মতো ভাসছে। অনেকগুলো শিশুর সরব পদচারণায় মুখর হয়ে উঠলো তাদের চোখের সামনেটা। লেখাপড়া শিখে উজানডাঙার অন্ধকার একদিন ওরাই তাড়াবে। (পৃষ্টা-৯৬)
পরিশেষে আমরা বলতে পারি, পলাশ দেব খুব পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছেন উপন্যাসটি। বাস্তবতা ও কল্পনার মেলবন্ধন দিয়েছেন খুব সুচারুভাবে। ছোট ছোট বাক্যে ‘উজান স্রোতের ভেলা’ অসাধারণ এক উপন্যাস। পাঠক প্রিয়তা পাবে বলে আমার বিশ্বাস। আগামীতে আরো ভালো গ্রন্থ নিয়ে হাজির হবেন আশা রাখি। বইটি উৎসর্গ করেছেন – অভ্র ও পৃথাকে।