পলাশীর ট্রাজেডী আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়

117

এম. এ. মাসুদ

আজ থেকে ২৪৩ বছর পূর্বে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন আমরা আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা হারিয়ে ইংরেজদের অত্যাচার-নিপীড়নের মধ্যে নিজ দেশে পরবাসীর জীবনযাপন করেছি। এই সময় আমাদের ছিল না বাক স্বাধীনতা, ছিল না অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ছিল না মান সম্ভ্রম নিয়ে বাঁচার অধিকার। কিন্তু পদে পদে ছিল মান-মর্যাদা হারানোর ক্লেশ। ছিল দুঃখ-যাতনা, অভাব-অনটন আর ইংরেজ তস্করদের পশুসুলভ নির্মম আচরণের বেদনা। আমাদেরই দেশে আমরা ছিলাম তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের মতই। দুইশ’ বছর ধরে অত্যন্ত চড়া মূল্যে ১৭৫৭সালের ২৩ জুন তারিখে পলাশীতে হারানো স্বাধীনতার খেসারত আমাদেরকে দিতে হয়েছে। ইংরেজদের কুশাসন, নির্যাতন, শোষণ আর লুণ্ঠন এদেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবন ধ্বংস করে দিয়েছিল। ওয়ারেন হেস্টিংস আর কর্ণওয়ালিশের প্রবর্তিত ‘এক সালা, পাঁচ সালা আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ ফলে এদেশের মানুষ নিজ মালিকানাধীন ভূমির উপর অধিকার হারিয়ে ছিল। সৃস্টি হয়েছিল উৎপাদনের সাথে সম্পর্ক বিহীন জমিদার নামক অলস, অথর্ব, অত্যাচারী এক নূতন শ্রেণীর। বিলাস-ব্যসনে মত্ত থাকা আর ইংরেজদের দালালী-মোসাহেবী করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। এদেশের সাথে বাণিজ্য করার ছদ্মাবরণে এখানে ইংরেজদের আগমন ঘটে। দিল্লীর মোগল দরবার থেকে এদেশে বাণিজ্য করার অনুমতি নিয়ে ইষ্ট ইÐিয়া কোম্পানী বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের নামে সামরিক উদ্দেশ্য সাধনের কাজ শুরু করে। তারা চট্টগ্রাম, ঢাকা, হুগলী, চন্দননগর, কাশিম বাজার, কলকাতা, কটক, পাটনা প্রভৃতি স্থানে কুঠি নির্মাণ করে। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার তখন স্বাধীন শাসক ছিলেন নবাব সিরাজদৌলা। নবাব তাঁর স্বল্পকালীন (১৫ই এপ্রিল ১৭৫৬Ñ২৩শে জুন ১৭৫৭) শাসন কালের পুরো সময়টি ইংরেজ ও মারাঠা বর্গীদের দমন, এদেশীয় স্থানীয় শাসকদের বিদ্রোহ এবং নিজ প্রশাসনের আমলাদের ক্ষমতা দখলের লাগাতার ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত ও অস্থির ছিলেন। ঘরে বাইরে সর্বত্র শত্রæদের মোকাবেলায় তাঁকে এতই ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়েছে যে, এক দিনের জন্যও তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেননি এবং তাঁর পুরো শাসনকালের কখনোই শান্তিতে-স্বস্তিতে সিংহাসনে দু’দÐ বসতে পারেননি। তাঁর মাতাসহ নবাব আলীবর্দী খানের মত তাঁকেও পুরো শাসনকাল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার পথে প্রান্তরে ছুটে বেড়াতে হয়েছে ইংরেজ আর মারাঠা দস্যুদের দমনে এবং অভ্যন্তরীণ শত্রæদের মোকাবেলায়। নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের সাথে ছিল তাঁর প্রশাসনের ও পরিবারের কতিপয় সদস্যের সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা। নবাবকে উৎখাতের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতৃত্ব দেয় ইস্ট ইÐিয়া কোম্পানীর ইংরেজরা। গৃহ শত্রæদের সক্রিয় সহযোগিতা আর মীর জাফর-জগতশেট গংদের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজদৌলার পরাজয় এবং তাঁর জীবন দানের মধ্য দিয়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্বের শেষ প্রদীপ-শিখাটি নিভে যায়। সেই সাথে এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সহ সকল কর্তৃত্ব ইংরেজদের কব্জায় চলে যায়। সর্ব কালে, সর্ব যুগে, সব দেশে কিছু বেঈমান, দালাল ও বিশ্বাসঘাতকের জন্ম হয়। ১৯৭১ সালের আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালেও আমরা দেখেছি একালের মীরজাফর-জগতশেট গংদের। দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী বিশ^াসঘাতকদের চক্রান্তে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর ভাগিরথী নদীর গর্ভে আমাদের স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত এই বাংলায় লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে সেই স্বাধীনতার সূর্য আবার উদিত হয়েছে। এদেশের বাণিজ্য করার বাহানায় ইংরেজরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নামে এদেশে সুঁচ হয়ে ঢুকে গোটা দেশটাকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করেছিল। ২০০ বছর ধরে এদেশ থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ স্বদেশে পাচার করে শেষে ফাল হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রেডক্লিফ দেশটাকে তিন টুকরো করে দিয়ে যান এবং এদেশের এই ভূমি বিভক্তির কাজে তিনি এমন কিছু অশান্তির বীজ বপন করে গিয়েছেন, এই উপমহাদেশের মানুষ এখনও তার ফল ভোগ করে চলেছে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন হল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতার জন্য নবাব সিরাজদ্দৌলার আত্মত্যাগ এবং ইংরেজ কর্তৃক আমাদের স্বাধীনতা হরণের দিন। পলাশীর যুদ্ধে জীবন বিসর্জনকারীরা আমাদেরই পূর্বসূরি। তাঁদের শরীরের শোণিত ধারা আমাদের শিরায় শিরায় বহমান। অথচ ইতিহাসের এই মর্মন্তুদ ঘটনা বহুল দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের বিষয়ে আমরা ভীষন উদাসীন। ২৩ জুন কখন এল, কখন বিদায় নিল তার খবরও আমরা রাখিনা। এই দিনের তাৎপর্য এবং এই দিনের গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা নির্বিকার। পলাশীর ট্রাজেডী আমাদের ইতিহাসেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দিনটি সম্পর্কে আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী সকল প্রজন্মের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। আমরা অতি নগন্য বিষয় নিয়ে কত দিবসই তো পালন করি। কিন্তু ২৩ জুনের মত ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন বেদনা-বিধূর দিনটি পালনে আমাদের ব্যর্থতা অত্যন্ত দুঃখজনক। পলাশী বিপর্যয়ের এই দিনটি আজ আমাদের বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে গেছে। এই দিনটি সম্পর্কে আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নীরবতা অত্যন্ত বিস্ময়কর। ২৩ জুনের মত ঐতিহাসিক গুরুত্ববাহী এমন একটি দিন সম্পর্কে আমাদের প্রিন্ট মিডিয়ায় একটি লাইনও লেখা না হওয়া বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একটি শব্দও উচ্চারিত না হওয়া অবিশ্বাস্য। আমাদের সুশীল সমাজ, তরুণ প্রজন্ম এবং আমাদের মধ্যে যারা ইতিহাস চর্চা করেন তাঁদের সমীপে প্রশ্ন ঃ জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় পলাশীর যুদ্ধে যারা নিজেদের জীবন দিয়েছেন তাঁদের কথা বিস্মৃতির আবরণে ঢেকে দিয়ে তাঁদের আত্মত্যাগের মহিমাকে আমরা কি অবমাননা করছি না? প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ২৩ জুন ‘পলাশী দিবস’ পালনের মাধ্যমে দেশের সব বয়সের নাগরিক ইতিহাসের এই অধ্যায়টির চর্চার মাধ্যমে তাঁদের শিকড়ের সন্ধান করুক- আমাদের দেশের কর্ণধারদের নিকট এই আবেদন রইল।
লেখক : সমাজকর্মী