পরীক্ষায় পাশে নির্ধারিত নম্বরের প্রেক্ষাপট ও কিছু কথা

117

পরীক্ষা মানে হচ্ছে, শিক্ষার বিষয়বস্তু বা শিখন ফল শিক্ষার্থী কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে, তা পরিমাপের এক প্রকার স্কেল বিশেষ। এই স্কেলে একটি নিদের্শক আছে, যা অতিক্রম করতে পারলে শিক্ষার্থী পাশ বা কৃতকার্য হিসাবে বিবেচিত হয়। আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় প্রতিক্ষেত্রে এই নিদের্শক স্কোর হচ্ছে ৩৩% নম্বর। অর্থাৎ কোন ছাত্রী বা ছাত্রী কোন বিষয়ে পূর্ণমান ১০০ নম্বরের পরীক্ষায়, ৩৩ নম্বর পেয়ে থাকলে, সে ছাত্র বা ছাত্রী ঐ বিষয়ে পাশ বা কৃতকার্য হয়েছে বলে বিবেচিত হয়। যদিও বর্তমান সময়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নৈর্ব্যক্তিক পাশ মার্ক এবং পেশাগত শিক্ষা বিষয়ক পরীক্ষায় পাশ মার্কের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। তবে সামগ্রিক ভাবে বলা যেতে পারে, বর্তমান সময়ে প্রায় মোট শিক্ষার্থীর ৯৫ থেকে ৯৭ শতাংশের বিভিন্ন বিষয়ে পাশ মার্ক ৩৩%। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এটা শতকরা ৩৩ নম্বর? এখানে ৩০ বা ৩৫ হতে পারতো! কিন্তু কেন তা নয়? এর উত্তরের জন্যে আজ থেকে ১৬০ বছরেরও বেশী সময় আগের দিনে ফিরে যেতে হবে।
সালটি ছিল ১৮৫৮ খ্রীস্টাব্দ। ঐ বছর ভারতীয় উপমহাদেশে (ভারতবর্ষে) ১ম বারের মত ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা চালু হতে যাচ্ছিল। কিন্ত এই পরীক্ষায় পাশ নম্বর কত হবে তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ দ্বিধাদ্ব›েদ্ব বিভক্ত হয়ে পড়ে। এতে বিভিন্ন বিজ্ঞ অভীজ্ঞ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, তাদের বিভিন্ন মত প্রকাশ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্যে ব্রিটিশ সরকারাধীন কনসাল্টেশনের অভিমুখে চিঠি লেখা হয়।
তখন বৃটেনের সকল ছাত্রছাত্রীর জন্যে প্রতি ১০০ নম্বর পরীক্ষায় পাশ নম্বর ছিল ৬৫। সেই সময় ইংরেজ সমাজে বা ব্রিটিশদের কাছে একটি প্রচলিত ধারণা ছিল। আর তা হচ্ছে, জ্ঞান বিদ্যা বুদ্ধি ও দক্ষতায় উপমহাদেশের মানুষ ইংরেজদের তুলনায় অর্ধেক। এই ধারণার ধারাবাহিকতায়, উপমহাদেশীয় শিক্ষার্থীর জন্যে পাশ নম্বর ৬৫ এর অর্ধেক হিসাবে ৩২.৫ নির্ধারণ করা হয়। যা সেই ১৮৫৮ সাল থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত এই ৪ বছর পাশ নম্বর ৩২.৫ হিসাবে চলে আসে।
পরবর্তীতে ১৮৬২ সাল থেকে সেটি গণনার সুবিধার্থে .৫ নম্বর বাড়িয়ে ৩৩ নম্বরে উন্নীত করা হয়। সেই সময় থেকে নূন্যতম পাশ নম্বরের মানদন্ড বিবেচিত হয়ে আসছে ৩৩। এরপর যখন ৫০ নম্বরের পূর্ণমান পরীক্ষা শুরু হয়, তখন ৩৩ নম্বরের অর্ধেক এর জন্যে, একই ভাবে ১৬.৫ জটিলতা এড়াতে ১৭ নির্ধারণ করা হয়। মূলকথা হচ্ছে, আজ থেকে ১৬০ বছর আগের সময়ে সৃষ্টি হওয়া, নির্ধারিত এই পাশ নম্বর শতকরা ৩৩ এখনো চলে আসছে।
পরীক্ষায় পাশ মার্কের কথা যখন বলেছি, পরীক্ষা সম্পর্কে অন্য একটি কথা না বললে নয়। পরীক্ষা কখন কিভাবে কোথায় সৃষ্টি হয়েছে এই বিষয়ে সঠিক কোন ধারণা বা ইতিহাস থাকার কথা নয়। কারণ পরীক্ষার শুরু সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে। মানুষের ভাষা বিকাশের পূর্বে একজন পরিচিত ব্যক্তি অন্য একজন অপরিচিত ব্যক্তি সম্পর্কে জানার জন্যে, বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা অবলম্বন করত।
খ্রীষ্টপূর্বে হাজার হাজার বছর আগেও প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় কাহিনীতে, পরীক্ষার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া আনুষ্ঠানিক ভাবে ২২০ সালে প্রাচীন চীনের হান রাজত্বের সময়ে স¤্রাট উ অব হান, চাকুরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলনের ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে হেনরি মিশেল নাকি পরীক্ষা জনক, যা আমার কাছে বিস্ময়কর, হাস্যকর ও অবিশ্বাস্য বিষয় মনে হয়। কারণ কেন যে, ১৯১৩ সালে জন্মগ্রহন করা তথাকথিত (!) এই ভদ্রলোককে পরীক্ষার জনক হিসাবে বিশ্বের স্বীকৃতি এল, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। এই রকম অনেক তথ্য বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে এলোমেলো প্রকাশিত বা প্রচারিত হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় এই জাতীয় মনগড়া তথ্যের কারণে পরবর্তী প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এমন কি জানার বিভিন্ন মাধ্যম বা উৎসে তথ্যগত ভুলের কারণে, একদিন ভুল তথ্য সঠিক হিসাবে সাধারণ মানুষ গ্রহন করে নিবে। যেমন- আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস ৫ অক্টোবর, যা বহু বছর পূর্ব থেকে আমার জানা। নিজেও ৫ অক্টোরব বিশ্ব শিক্ষক দিবসকে বেছে নিয়ে, চাকুরীতে যোগদান করে শিক্ষকতা পেশায় এসেছি; একই সাথে পত্রিকায়ও এই বিষয়ে অনেকবার লিখেছি। কিন্তু ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায়, এমন কি গুগলেও দেখা যাচ্ছে ৫ সেপ্টেম্বর তারিখ আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস। শুধু তাই নয়, এই দিন বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ছবি ফেসবুক বা টুইটারে পোস্ট করা হচ্ছে, একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করে যাচ্ছে। অথচ আমার জানা মতে ৫ সেপ্টেম্বর হচ্ছে ভারতের জাতীয় শিক্ষক দিবস।