পরিযায়ী পাখির আনাগোনা বাড়ছে

92

পাখিদের একটি বিশাল অংশ জিনগতভাবে পরিযায়ী। এটা তাদের রক্তের সাথে মিশে আছে। সাধারণত শীতের শুরুতে পাখিরা উষ্ণতার খোঁজে পাড়ি জমায় ভিন দেশে। কখনো কখনো হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয়। তারা এমন দেশ বা স্থান বেছে নেয়, যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য এবং প্রজননের সুযোগ থাকে। শীতকালে দেশে পরিযায়ী পাখি আসার খবর কম বেশি সবাই জানেন। পাখির পরিযায়ী স্বভাব, চালচলন, গতিপথ নিয়ে বিজ্ঞানি ও বিশেষজ্ঞদের ভাবনার অন্ত নেই। বাংলাদেশেও অনেকেই পরিযায়ী পাখি নিয়ে ভাবছেন। সাম্প্রতিক এক শুমারিতে দেখা যায় যে, খাবার ও নিরাপদ আবাসস্থল পেলে শীতকাল শেষে আরও দু’এক মাস পাখি থেকে যায় নতুন স্থানে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক তথ্য থেকে তা জানা যায়। বাংলাদেশে রাািশয়ার বাইবেরিয়া শুধু নয়, এ বছর পরিযায়ী পাখি এসেছে তাজিকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, চীন ও হিমালয়ের আশপাশ থেকে। সিলেটের হাওর এলাকায় গত এপ্রিল মাসে (২০১৯) সীমিত সংখ্যক পরিযায়ী পাখি অবস্থান করার কথা জানা যায়।
বাংলাদেশ জলচর পাখি শুমারি ২০১৯ এর তথ্য থেকে জানা যায়, এ বছর সবচেয়ে বেশি পরিযায়ী পাখি দেখা যায় সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে। গত জানুয়ারি থেকে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত সেখানে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩০টি পাখির দেখা মেলে। যা গত বছরের তুলনায় ৮০ হাজার বেশি। আমি সুনামগঞ্জ জেলার ধরমপাশা ও তাহিরপুর উপজেলায় ছোট বড় ১২০টি বিল আছে। সেখানে ৪৬টি গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্র্গকিলোমিটার। তার মধ্যে ২ হাজার ৮০২ হেক্টর জলাভূমি। আমি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ও ঐ সকল এলাকায় পরিযায়ী পাখি দেখেছি।
টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা বড়ালেও দেশের অন্য এলাকায় সেভাবে এবার পাখি দেখা যায় নি। শ্রীমঙ্গলের বাইক্কার বিল এবং মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার আওতাধীন হাকালুকি হাওরে পাখির সংখ্যা কমেছে। তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, শীতের সময় চট্টগ্রাম শহরের জামালখান এলাকায় প্রতি বছর কিছু পাখি দেখা যায়। যেমন খঞ্জনা, রকথ্রামসহ কিছু পাখি। তবে সোনাদিয়াদ্বীপসহ উপকূলীয় এলাকায় এবার গতবারের চেয়ে বেশি পাখি দেখা গেছে। বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাব ও আই সি ইউ এনের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত সমীক্ষায় এ তথ্য ওঠে এসেছে। যার ৯০ শতাংশই গেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিযায়ী পাখির বিচরণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান বাংলাদেশে টাঙ্গুয়ার হাওর। এবার দেশে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় হাওর ও জলাভূমিতে পানি কম ছিল। ফলে জলজ উদ্ভিদ, পোকাসহ নানা প্রাণী ও কীটপতঙ্গ পানিতে ভেসে ছিল। এ সকল খাবারের লোভে শীত চলে যাওয়ার পরও পরিযায়ী পাখিরা সেখানে ছিল।
একটি দেশে যে পরিমাণ বনভূমি ও জলাশয় থাকার কথা, বাংলাদেশে কাক্সিক্ষত পরিমাণ নেই। ফলে দেশে জীববৈচিত্র্যের সমাবেশ দিন দিন কমে আসছে। দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ জুড়ে বন ভূমি থাকা বাঞ্ছনীয়। সে ক্ষেত্রে দেশে ১০ থেকে ১২ শতাংশ বনভূমি আছে। অন্যদিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে হাজার হাজার হেক্টর বনভূমি কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। শুধু বনভূমি নয়, তারা পাহাড় নদী নালা সকল অনুসঙ্গের উপর হাত বসিয়েছে। ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পরিবেশ প্রকৃতির জন্য হুমুকি হয়ে দেখা দিচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। এ সমস্যা সহজে সমাধান হওয়ার আশা কম। কারণ বৈশ্বিক কারণে চীন, ভারত, জাপান, মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক কোন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ রে বানচাল করে দিচ্ছে। আবার নষ্টের গুরু আমেরিকার কংগ্রেসে রাখাইন অঞ্চলকে বাংলাদেশের অংশ হিসাবে দেখার পক্ষপাতি। বলা যায়, রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে এতদঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে যাওয়া বা এ এলাকায় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে বৃহৎশক্তিগুলো। ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে।
যে কথা বলতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশে কাম্যস্তরের বনভূমি তো নাই; ঠিক একইভাবে দেশের জলাশয়গুলো আস্তে আস্তে জবরদখলের আওতায় চলে যাচ্ছে। এক সময় দেশে প্রচুর পরিমাণে জলাশয় থাকার কারণে এখানের প্রকৃতিতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। যার ভিত্তিতে মানুষের খাদ্যভাসে মাছ প্রধান খাদ্যের অংশে পরিণত হয়। বাঙালির পরিচয় হয় বিশ্বসভায় ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। এখানকার খাল বিল নদী ও হাওর বাওরে শত শত প্রজাতির মাছ দেখা যেত। মাছ রান্না, শুটকি তৈরি করার পর কোন কোন সময় মাটিতে পুঁতে ফেলারও ইতিহাস ছিল। এখন আর সেই মৎস্য সম্পদ নেই। হারিয়ে গেছে, বাহারি মাছেল নানা প্রজাতি। খালবিল, জলাশয় বরাট হয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে বাড়ি-ঘর, শিল্পকারখানা। চাষের জমি ও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অথচ দেশে জনসংখ্যা দ্রæত হারে বেড়ে যাচ্ছে। তবে আশার কথা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জলাশয়গুলো রক্ষার জন্য বিশেষ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী। দেশের জলাশয়গুলো জবর দখলের পেছনে যারা সুশীলব তারা কোন না কোন রাজনৈতিক পরিচয় বহাল তবিয়তে টিকে আছে। জলাশয়গুলো জবর দখল হওয়ার ফলে শহর নগর নয় গ্রামগুলোতে আজ দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। বর্ষায় বা অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে জলে ডুবে গিয়ে মানুষ সীমাহীনভাবে কষ্টে পতিত হয়। জলজট বা জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য প্রণীত হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট। কিন্তু সফলতা কই? যে লাউ সে কদু। প্রধানমন্ত্রীকে আগে রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিতি স্বার্থান্বেষীদের দমন করতে হবে। না হলে সকল উন্নয়ন ভাবনা, পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে।
জল ও জলাশয় নিয়ে বক্ষমান ও নিবন্ধ নয়। তবুও দেশের আগত পরিযায়ী পাখির স্বার্থে বলতে হলো। এবার টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়াও উপকূলীয় এলাকায় পরিযায়ী পাখির আগমন বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর দেশে প্রায় এক লাখ বেশি পরিযায়ী পাখি এসেছে। তার ৯০ শতাংশ এসে টাঙ্গুয়ার হাওরে।
আই সি ইউ সি এনের বন্য পাখি পর্যবেক্ষণ প্রকল্পের মুখ্য গবেষক এবিএম সারোয়ার আলমের তথ্য অনুযায়ী পরিযায়ী পাখি বিচরণের জন্য দেশের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত এলাকা টাঙ্গুয়ার হাওর। বাংলাদেশের জলচর পাখি শুমারি হচ্ছে ২০০০ সাল থেকে। সেই সময়ের সাথে তুলনা করলে দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। াকরণ হিসাবে তাঁরা বলছেন, পাীখর বিচরণ এলাাকয় মানুষের বসতি ও তৎপরতা বেড়ে যাওয়া এবং নানা ধরনের দূষণের কারণে পাখির সংখ্যা কমে আসছে। গবেষকদের হিসাবে ২০০০ সালে শুমারির সময় পাখি ছিল ৫ লাখের বেশি। ২০১৯ এর শুমারিতে দেশের সকল জলাশয় ও হাওর (মোট পাঁচ এলাকায়) পাখি দেখা গেছে মাত্র প্রায় ২ লাখ ৪৭ হাজার। গত বছর দেখা গিয়েছিল মাত্র এক লাখ ৪৭ হাজার। সে তুলনায় চলতি বছর পরিযায়ী পাখির সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ১ লাখ।
বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের কর্মকর্তাদের তথ্যানুযায়ী হাওর ও বনভূমির খীট পতঙ্গ খেয়ে উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সহয়তা করে পরিযায়ী পাখি। আবার একই সঙ্গে পরিায়ী পাখির বর্জ্য মাছের খাবার এবং জলজ উদ্ভিদের সার। তারা বলেন, পরিযায়ী পাখির সংখ্যা বাড়া মানে এতদঞ্চলের হাওর ও জলাশয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ এখনো ভালো আছে।
পাখি শুমারির মূল গণনার কাজটি শুরু হয় জানুয়াাির ফেব্রæয়ারিতে। এরপরও পাখির অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে আই ইউ সি এন ও বার্ডক্লাভ। এই কাজটি এখনো চলমান। বিশেষ ধরনের ক্যামেরা দিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি, হাওর, বাইক্কার বিল, উপকূলীয় এলাকা এবং কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে পাখি শুমারি হয়।
২০১৯ সালের শুমারিতে বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখিরা কোন অঞ্চল থেকে আসে।, সে সম্পর্কে চমৎপ্রদ ও নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। তাজিকিস্তান, মঙ্গোলিয়া ও চীন থেকে পাখি বাংলাদেশে আসার ত্যথ এবারই প্রথম পাওয়া গেল। গবেষকরা এতদিন মনে করতেন বাংলাদেশে পরিযায়ী পাীখ ডিসেম্বরে আসে এবং ফেব্রæয়ারির শেষে ফিরে যায়। কিন্তু এবারের জরিপে দেখা গেল দেশের কোন কোন জলাশয়য় আরও দুই-এক মাস পাখিরা অবস্থান করছে। এটা আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য সুখবর।। দেশের প্রকৃতি অনুকূল থাকা মানে সে দেশের বসতি ও মানুষের জন্য সুখবর।
বার্ডক্লাবের সদস্যগণ গত জানুয়ারিতে ৪২টি পাখির শরীরে জিপিএস ট্যাগ (এক ধরনের ক্ষুদ্রযন্ত্র, যা দিয়ে ভৌগলিক অবস্থান নির্ণয় করা যায়) স্থাপন করেন। জিপিএস ট্যাগের মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে পাখির অবস্থান কোথায় তা বের করা সম্ভভ হয়। এরি মধ্যে আটট পাখি ভারতে রবিহার ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শিকারিদের হাতে মারা পড়েছে। আবার ভারতে একটি জিএিস ট্যাগযুক্ত পাখিকে ‘গোয়েন্দা পাখি’ মনে করে আটক করে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী বা সংস্থা পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রাণী বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থার হস্তক্ষেপে পাখিটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে ভারতের প্রাণী বিজ্ঞান সমিতির তত্ত¡াবধানে পাখিটি আছে। প্রভাবে জিপিএস ট্যাগ যুক্ত পাখি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার নজরে থাকে।
গবেষকরা জানান, গত ২৩ ফেব্রæয়ারি মাসে বাইক্কার বিলে একটি পাখির শরীরে জিপিএস ট্যাগ পরানো হয়। পাখিটি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের একটি হ্রদে অবস্থান করছিল। এবার সবচেয়ে বেশি জিপিএস ট্যাগ পড়ানো হয় গিরিয়া হাঁসকে। একটি গিরিয়া হাঁস গত ২ মে ভারতের বিহারে শিকারীর গুলিতে মারা পড়ে।
সরকারের বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক, জাহিদুল করিম মনে করেন যে, এবার পরিযায়ী পাখি ভেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসাবে বিবেচনা করেন। তাঁরা সিলেট অঞ্চলের হাওরগুলোকে পাখির অভয়াশ্রম এলাকা হিসাবে ঘোষণা করতে তারা সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান। পাখি সুরক্ষায় প্লাস্টিক দূষণ বড় হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। এটা শুধু পাখি ক্ষেত্রে নয়Ñবিভিন্ন জীব জন্তু ও মাছের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দেশে পাখি আগমনের সংবাদ যেমন ইতিবাচক তেমনি পাখি সুরক্ষায় ও আমাদের ভূমিকা পালন করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়, মাছসহ বিভিন্ন প্রাণী প্লাস্টিক দ‚ষণের কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করছে। বিশ্বের প্রাণিজগতকে সুরক্ষায় মানব জাতিকে ভূমিকা নিতে হবে। অন্যথায় মানবজাতি বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)