পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া

135

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আদুরে ডাকনাম ছিল ‘সুধা মিয়া’। ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রæয়ারি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন ‘সুধা মিয়া’। বাবা আব্দুল কাদের মিয়া এবং মাতা ময়েজুন্নেসার সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান এম এ ওয়াজেদ। ছোট বেলা থেকেই অত্যান্ত মেধাবী সুধা মিয়া রংপুর জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে ডিসটিনকশনসহ প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ার সময় সংশ্লিষ্ট হন ছাত্র রাজনীতির সাথে। তিনি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৬১-৬২ শিক্ষা বছরের জন্য হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে কারাবরণ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষা বছরে তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ‘ডিপে�ামা অব ইম্পেরিয়াল কলেজ কোর্স’ কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের ‘ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে তাকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকার আণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে পদস্থ করা হয়।
১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৯ সালে ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্তি¡ক পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তাকে এসোসিয়েটশিপ প্রদান করে। এই সুবাদে তিনি ১৯৬৯-৭৩ ও ১৯৮৩ সালে ওই গবেষণা কেন্দ্রে প্রতিবার ৬ মাস ধরে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং এর আগে ও পরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে তিনি পরপর দুবার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কার্লসরুয়ে শহরের ‘আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে’ আণবিক রিঅ্যাক্টর বিজ্ঞানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত তিনি ভারতের আণবিক শক্তি কমিশনের দিল্লির ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি অনেক জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান বিষয়ক সম্মেলনে যোগদান করেন। তার অনেক গবেষণামূলক ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় এবং সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাÐের পর দীর্ঘ সাত বছর নির্বাসিত জীবন কাটান বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া। বাংলাদেশ আনবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রকে গড়ে তুলেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের পদার্থবিজ্ঞান, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিভাগের ছাত্রদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলাদেশের আনবিক শক্তি বিজ্ঞান গবেষণায় তাঁকে একজন পথিকৃৎ বলা যায়। তার অনেক গবেষণামূলক ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত চারটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ঋঁহফধসবহঃধষং ড়ভ ঞযবৎসড়ফুহধসরপং, ঋঁহফধসবহঃধষং ড়ভ ঊষবপঃৎড়সধমহধঃরপং. উল্লেখ্য তাঁর ঋঁহফধসবহঃধষং ড়ভ ঊষবপঃৎড়সধমহধঃরপং গ্রন্থটি ভারতে পাঠ্য বই হিসাবে ছিল এবং ইংল্যান্ডেও বহুল পঠিত একটি বই। তার লেখা ৪৬৪ পৃষ্ঠার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এবং ৩২০ পৃষ্ঠার ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৫ সালের ফেব্রæয়ারিতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত হয়। তাঁর এসব গ্রন্থ নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল।
স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি কিছুদিন কারাবরণ করেন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর দুটি দুবছরের মেয়াদকালের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি পরপর দুটি দুবছর মেয়াদকালের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ঢাকার রংপুর জেলা সমিতির ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দুবছর মেয়াদকালের জন্য এই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।
পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এর জনক ড. ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯৯ সালে অবসর নেন। ২০০৯ সালের ৯ই মে দীর্ঘদিন কিডনির সমস্যাসহ হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টে ভুগে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন এই পরমানু বিজ্ঞানী। ক্ষমতার খুব কাছে থেকেও কিভাবে তাঁর তুচ্ছজ্ঞান করতে হয় এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ড. ওয়াজেদ মিয়া। কখনও ক্ষমতার অপব্যবহারের সামান্যতম সুযোগ নেননি তিনি। তাঁর নিকট এইসব ছিল খুবই তুচ্ছ বিষয়। নিরবে নিভৃতে তিনি দেশের বিজ্ঞান প্রসারে কাজ করে গেছেন। তার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের রূপপুরে একটি পরমাণু বিদুৎ কেন্দ্র চালু করা, দেশের বিজ্ঞানীদের পেশাগত কাজের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি বিজ্ঞান ভবন নির্মাণ করা। দেশের বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রসারে তাঁর অবদান অবিস্মরনীয়।