পণ্যের মান রক্ষায় ‘ব্যর্থ’ বিএসটিআই

50

ধানের মধ্যে যেমন সামান্য চিটা ঢুকে পড়ে, তেমনি আসল পণ্যের ভিড়ে কখনো মানহীন পণ্যও ঢুকে পড়তে পারে। কোনোভাবেই যেনো মানহীন পণ্য বাজারে আসতে না পারে সে নিশ্চয়তার জন্য জন্ম বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্ট্রিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই)। দেশীয় বাজারে পণ্যের মানের নিশ্চয়তা দেয়ার কথা বিএসটিআইয়ের। কিন্তু বরাবরই পণ্যের মান রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে করে মানসম্পন্ন পণ্যের চেয়ে মানহীন পণ্যে বাজার সয়লাব। ভেজাল আর মানহীন পণ্য কিনে ঠকছেন ক্রেতারা। বাজারে হাজারো মানহীন পণ্যের যখন প্রতিযোগিতা তখন আজ ঘটা করে পালন করা হচ্ছে বিশ্ব মান দিবস।
ভাগ্যপণ্য থেকে শুরু করে শিল্পপণ্যে পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে ভেজাল। এসব ভেজাল রোধে নেই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। নামমাত্র কিছু অভিযান পরিচালনা করা হলেও এসব যেন লোক দেখানো। সরকার মান ধরে দেওয়া পণ্যের উৎপাদন বা বাজারজাত করার ক্ষেত্রে মান সংস্থা বিএসটিআই থেকে অনুমতির প্রয়োজন আছে।অথচ বিএসটিআইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোনোধরনের অনুমতি না নিয়েই অনেক অবৈধ প্রতিষ্ঠান পণ্য বাজারজাত করছে। আবার বিএসটিআই থেকে অনুমতি নেওয়ার পরও মান বজায় রাখছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। এতে করে বাজারে আসল পণ্যের চেয়ে ভেজাল ও নকল পণ্যের পরিমাণ বেড়েছে। বিএসটিআইয়ের এসব বিষয় নিয়মিত দেখভাল করার কথা থাকলেও বাস্তবে তেমন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই তাদের। অবশ্য বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে মাসোহারা বা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ আছে। মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে উধ্বর্তন কর্মকর্তারা পর্যন্ত নিয়মিত মাসোহারার ভাগ পান। যার কারণে সবাই বাজার তদারকিতে থাকেন নিরব দর্শক হয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএসটিআইয়ের কিছু অভিযানের চাঁদাবাজির বিষয়টি আরো সামনে আসে। পাশাপাশি বৈধ ও অবৈধ প্রতিষ্ঠান থাকলেও বিএসটিআই বৈধ প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে। অবৈধ প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ না করলেও বৈধ প্রতিষ্ঠানের কিছু মালামালও নষ্ট করে। অবৈধ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নেয়াতে বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তাদের মাসোহারার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। তবে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিএসটিআই এরমধ্যে বৈধ ও অবৈধ প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে ভোক্তা পর্যায়ে মানের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, বাজারে নি¤œমানের ও ক্ষতিকর উপকরণে তৈরি পণ্যের সরবরাহ আছে। আসল পণ্যের মোড়কে হুবহু তৈরি নকল পণ্যও আছে। এসব পণ্যে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছে, শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভেজাল রোধে বিএসটিআইয়ের কার্যক্রমের চেয়ে সকল ক্ষেত্রে হয়রানি ও আর্থিক সুবিধার অভিযোগ বেশি আছে।
তিনি বলেন, পণ্যের মানের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া উচিত নয়। বিএসটিআই বৈধ ও অবৈধ প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করছে, এটার জন্য সাধুবাদ জানাই। বিএসটিআই তদারকি কার্যক্রম আরো জোরদার করবে এবং নিজেদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে এটা আমি প্রত্যাশা করি।
পণ্য উৎপাদন করলেও বিএসটিআইয়ের অনুমোদন না নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা প্রতিষ্ঠানের মাসোহারা আদায়। ফিল্ড অফিসারের মাধ্যমে নির্ধারিত মাসোহারা দেয়ার দিয়ে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের পণ্য বাজারে প্রবেশের সুযোগ পায়। অন্যদিকে নির্ধারিত নিয়মে পণ্যের লাইসেন্স নিতে গেলে পদে পদে পড়তে হয় হয়রানিতে। তাছাড়া টাকা না দিলে পণ্যের মান কখনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় না। টাকা দিলে পণ্য যেমনই হোক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্তাধিকারী বলেন, বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নিতে গেলে নানা ধরনের হয়রানিতে পড়তে হয়। পণ্য যতই ভালো হোক টাকা ছাড়া সেটা পরীক্ষায় কখনো উত্তীর্ণ হবে না। আবার টাকা দিয়ে লাইসেন্স নিলে সেটাও নিয়মিত নবায়ন করতে হয়। কিছুদিন পর পর সার্ভিলেন্স টিম এসে অযথা হয়রানি করে। মাসিক হারে এখন কিছু টাকা দিই। এতে কোনো ঝামেলা নেই। এলাকায় মোবাইল কোর্ট হলে সেটাও আগে আমাদের জানিয়ে দেয়া হয়। মাসোহারা না দিলে একটা না একটা সমস্যা বের করবেই।
এদিকে বাজারে মানহীন পণ্যের ছড়াছড়ির মধ্যে আজ পালন করা হচ্ছে বিশ্ব মান দিবস। বিশ্বের ৩টি প্রধান আন্তর্জাতিক মান সংস্থার যৌথ উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর এ দিবসটি পালিত হয়। বাংলাদেশের জাতীয় মান সংস্থার পক্ষ থেকে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
‘ভিডিও মান বৈশ্বিক সম্প্রীতির বন্ধন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে। দিবসটি পালনে বিএসটিআই চট্টগ্রামের উদ্যোগে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবছর দিবসটি ঘটা করে উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। যদিও মান সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই দিবসটি উদযাপন করা হয়। দিবসের পর পরই ভুলে যায় দিবসের প্রতিপাদ্যও। আলোচনা সভার শেষে যেনো মান শব্দটাই উধাও হয়ে যায়।
বিএসটিআই চট্টগ্রামের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. সেলিম রেজা বলেন, আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট, সার্ভিলেন্স টিম ও বাজার মনিটরিং করে থাকি। পণ্যের মান রক্ষার চেষ্টায় আমাদের কোনো ত্রæটি থাকে না। তবে আমাদের পুরো থানা এলাকায় একজন মাত্র ফিল্ড অফিসার কাজ করে। সীমিত লোকবল নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। অনেক সময় আমাদের অগোচরে মানহীন পণ্য বাজারে চলে আসে।
তিনি বলেন, আমাদের আইনের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। শুধু জরিমানা না করে জেলেও দেওয়া উচিত। তাছাড়া ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে। আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছি, বৈধ ও অবৈধ প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করছি। ভোক্তারা সচেতন হলে মানহীন পণ্য নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। আইনের প্রয়োগ আর ভোক্তা সচেতনতায় পণ্যের মান নিশ্চিত করা সহজ হবে।
বিএসটিআই চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মোস্তাক আহমেদ বলেন, এটা ঠিক শতভাগ পণ্যের মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বিএসটিআই নিয়মিত মোবাইল কোর্ট, সার্ভিলেন্স অভিযান পরিচালনা করছে। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। জরিমানার বাইরে অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো সিলগালা করলে মানহীন পণ্যের দৌরাত্ম্য কমবে। ভোক্তারা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভোক্তাদের সচেতন করতে আমরা পত্রিকায় বৈধ ও চিহ্নিত অবৈধ প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করছি।
উল্লেখ্য, ১৯৪৬ সালের ১৪ অক্টোবর তারিখে লন্ডনে বিশ্বের ২৫টি দেশের প্রতিনিধিরা বিশ্বব্যাপী পণ্য-সৈবার মান বজায় রাখার জন্য একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান নির্ধারক সংস্থার বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন। পরের বছর থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করেন। ঐদিনকে স্মরণীয় করে রাখতেই এ দিবস বৈশ্বিকভাবে পালন করা হয়। প্রত্যেক বছরই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় চলমান বিষয়াদিকে ঘিরে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭০ সাল থেকে আইএসও এই দিনটি পালন করে আসছে। বিএসটিআই ১৯৭৪ সালে আইএসও’র সদস্যপদ লাভ করে। আইএসও’র সক্রিয় সদস্য হিসাবে বিএসটিআই দিবসটি পালন করে আসছে।