নয়কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ

15

হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজের জন্য মালামাল ক্রয়ে প্রায় নয় কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ল্যাপটপ, প্রিন্টার, চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমসহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র বাজারদরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরুর বছরে এ ধরনের অভিযোগকে কলেজটির এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বইপত্র, সাময়িকী, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার জন্য ২০১৮ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়। সে সময় কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আবু সুফিয়ান স্বাক্ষরিত আদেশে ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক ডা. মো. শাহীন ভূইয়াকে সভাপতি করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট বাজারদর যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। দরপত্রে অংশ নেয় ৭টি প্রতিষ্ঠান। তবে মূল্যায়ন রিপোর্টে সদস্যদের স্বাক্ষর ছাড়াই ঢাকার শ্যামলীর বিশ্বাস কুঞ্জছোঁয়া ভবনের নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ ও মতিঝিলের মঞ্জুরি ভবনের পুণম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে মালামাল সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
জানা যায়, কলেজটির মালামাল ক্রয়ের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট ও আয়কর খাতে সরকারি কোষাগারে জমা হয় এক কোটি ৬১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৪৮ টাকা। মালামাল ক্রয়ে ব্যয় দেখানো হয় ১৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮১ হাজার ১০৯ টাকা। তবে বাস্তবে ওই মালামালের মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি নয় বলে দরপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ও বিক্রেতারা জানিয়েছেন।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিলের কাগজ থেকে জানা যায়, মেডিক্যাল কলেজের জন্য সরবরাহ ৬৭টি লেনেভো ল্যাপটপের (মডেল ১১০ কোর আই ফাইভ, কিং জেনারেশন) মূল্য দেখানো হয়েছে ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫শ’ টাকা। প্রতিটির মূল্য ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা। অথচ ঢাকার কম্পিউটার বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ফ্লোরায় একই মডেলের ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪২ হাজার টাকায়। এইচপি কালার প্রিন্টার (মডেল জেড প্রো এম ৪৫২এন ডব্লিউ)-এর দাম নেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯শ’ টাকা; যার বাজার মূল্য ৬০ হাজার টাকা।
বিলের কাগজ থেকে আরও জানা যায়, ৫০ জন বসার জন্য কনফারেন্স টেবিল, এক্সিকিউটিভ চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমের জন্য ব্যয় হয়েছে ৬১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। এ খাতে জনপ্রতি খরচ পড়েছে এক লাখ ২২ হাজার ৪শ’ টাকা। চেয়ারগুলোতে ইয়ামিন ফার্নিচার লেখা থাকলেও টেবিলগুলোতে কোনও প্রতিষ্ঠানের স্টিকার লাগানো নেই। দেশের নামিদামি ফার্নিচার প্রতিষ্ঠান হাতিল ও রিগ্যালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব চেয়ারের মূল্য ওই দামের অর্ধেকের চেয়েও কম। শুধু তাই নয়, সাধারণ মানের ১৫টি বুক সেলফের মূল্য ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা, ৫টি স্টিলের আলমারি ২ লাখ ৮৫ হাজার, ১০টি স্টিলের ফাইল কেবিনেট ৪ লাখ ২২ হাজার, ২৫টি স্টিলের র‌্যাক ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ও ৬ হাজার ৪৭৫টি বইয়ের জন্য ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ টাকা বিলে দেখানো হয়েছে। এছাড়া বিলে প্লাস্টিকের তৈরি মানবদেহের ১০৪টি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মূল্য ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৩ টাকা দেখানো হয়েছে। দেশের বাজারে পেডিয়াটিক সার্জারি (২ ভলিউমের সেট) বইটির দাম ৩৩ হাজার টাকা হলেও নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ দাম দেখিয়েছে ৭০ হাজার ৫৫০ টাকা।
পুণম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দরে ৮১টি কার্লজিস প্রিমো স্টার বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ সরবরাহ করেছে। এর মূল্য নিয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ ৩২৫ টাকা। অথচ এর বাজার মূল্য এক লাখ ৩৯ হাজার ৩শ’ টাকা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি এক লাখ ৬৮ হাজার টাকা দরে ৩১টি এসি কিনেছে ৬১ লাখ ৩৮ হাজার টাকায়। ওয়ালটনের যে মডেলের ফ্রিজের দাম ৩৯ হাজার ৩৯০ টাকা; সেই একই মডেলের ৬টি ফ্রিজ কোম্পানিটি ৮৫ হাজার টাকা দরে কিনেছে বলে মূল্য তালিকায় দেখানো হয়েছে। ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল ওয়েইং (ওজন মাপার যন্ত্র) মেশিনের দাম দেখানো হয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাস্তবে যার বাজার মূল্য ৪০ হাজার টাকা করে।
এছাড়া মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি সম্বলিত কাগজে ছাপা চার্ট বাজারে ১শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় পাওয়া গেলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিটি চার্ট কিনেছে ৭ হাজার ৮শ’ টাকা দরে। এ রকম ৪৫০টি চার্ট ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে ৩৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। দেশে এক লাখ ৩৮ হাজার টাকায় পাওয়া যায় স্টারবোর্ড নামে হিটাচি কোম্পানির ৭৯ ইঞ্চির ইন্টারেক্টিভ বোর্ড। কিন্তু একই কোম্পানি ও মডেলের এই ইন্টারেক্টিভ বোর্ডটি কেনা হয়েছে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়।
হবিগঞ্জ অথেন্টিক কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী নোমান খান বলেন, ‘যে ল্যাপটপের মূল্য ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৮ হাজার টাকা, আমাদের দোকানে তা ৪০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়া এইচপি কালার পিন্টার আমরা বিক্রি করি ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকায়।’
হবিগঞ্জ শহরের পুরান মুন্সেফি এলাকার বাসিন্দা তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘যে ল্যাপটপ আমরা ৪০ হাজার টাকায় ক্রয় করতে পারি, এখানে ক্রয় মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। এতে বোঝা যায় কত বড় দুর্নীতি হয়েছে।’
ওইসব মালের বাড়তি দাম নিয়ে কানাঘুষা আছে খোদ কলেজেই। কলেজের দুজন শিক্ষক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, যেসব বই কেনা হয়েছে, এগুলোর মধ্যে অনেক বই এমবিবিএস ক্লাসের ছাত্রদের কোনও কাজে লাগবে না। সেগুলো গবেষণা কাজের জন্য। মেডিক্যাল কলেজের ফার্স্ট ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এখন তৃতীয় বর্ষে। ২০২২ সালে তারা পঞ্চম বর্ষে উঠবে। কিন্তু ২০১৮ সালে পঞ্চম বর্ষের বই কেনার কোনও যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রী হবিগঞ্জকে দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ হিসেবে মূল্যায়ন করেন। তার নামে করা কলেজে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এতে তাকেই অসম্মান করা হয়েছে। এ ঘটনাকে কলেজটির এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে দেখছেন তিনি।
এ বিষয়ে শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. আবু সুফিয়ানের সঙ্গে যোগযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ করে বাজারদর যাচাই-বাছাই কমিটি সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ঢাকার দুটি প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার দিয়েছে। এখানে কোনও অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি।’