নোবেল প্রত্যাখ্যান এবং জঁ পল সার্ত্রে

277

পৃথিবীর বুকে প্রচলিত যাবতীয় পুরস্কারের মধ্যে নাম, গুণ, মূল্য এবং ওজনে নোবেল পুরস্কার সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার। এই পুরস্কার প্রদানের দাবিতে ব্যক্তি বা ব্যক্তির পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম, লেখালেখীর ইতিহাসও কম নয়। আবার মানবীয় বৈশিষ্ট্যের ঊর্দ্ধে ওঠে পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের বিরল কয়েকটি ঘটনাও ইতিহাসে দৃশ্যমান। ফরাসি চিন্তক জঁ পল সার্ত্রে ( ২১ জুন ১৯০৫- ১৫ এপ্রিল ১৯৮০)এমন একটি বিরল ইতিহাস সৃষ্টিকারী ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্বমহিমায় সমোজ্জ্বল। ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, নাট্যকার, সাহিত্যিক এবং সমালোচকজঁ পল সার্ত্রে অস্তিত্ববাদের জনক হিসেবে,তাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও উদারনীতির জন্য এবং নোবেল প্রত্যাখ্যান করে পৃথিবীর চিন্তাশীল মানুষের হৃদয়ে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
২১ অক্টোবর ১৮৩৩ সালে সুইডেনের স্টকহোমে জন্ম নেওয়া রসায়নবিদ আলফ্রেড নোবেল ধ্বংসাত্মক ডিনামাইট আবিষ্কার করেন। তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রের মানববিধ্বংসী রূপ দেখে তিনি শেষ জীবনে খুবই অনুতপ্ত হন। এ কারণে মৃত্যুর পূর্বে তাঁর সম্পদের ৯৪% (৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার) জনকল্যাণে অবদান রাখা ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করবার জন্যদান করে দেন। এই বিপুল সম্পত্তি হতে ১৯০১ সাল থেকে তাঁর নামে প্রদান করা হচ্ছে নোবেল পুরস্কার। পৃথিবীতে নানান ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র বা সংস্থা হতে প্রদান করা হয় বিভিন্ন পুরস্কার। এসব পুরস্কারের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান, লোভনীয় ও ওয়েটফুল পুরস্কার হলো আলফ্রেড নোবেলের নামে প্রচলিত তাঁর দানকৃত অর্থে প্রদত্ত নোবেল পুরস্কার। নোবেল পুরস্কারে থাকে ১৮ ক্যারেট সবুজ স্বর্ণের ধাতবের ওপর ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া ক্রেস্ট, একটি সম্মাননা সনদ এবং মোটা অঙ্কের সম্মানী অর্থ। সম্মানী অর্থের অঙ্ক বর্তমানে ১১ লক্ষ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশী মূদ্রায় যা ৯ কোটি টাকারও বেশী)। সবচেয়ে সম্মানজনক ও লোভনীয় এই পুরস্কারের জন্য লবিং, মিছিল-মিটিং ও লেখালেখির ঘটনা ইতিহাসে কম নয়। পুরস্কার ঘোষিত হবার পূর্বে এবং পরে প্রত্যাখ্যানের বিরল ঘটনাও কিন্তু আছে। নোবেল প্রত্যাখ্যানকারীদের নির্লোভ-নির্মোহ মানসিকতার ব্যাপারে কারো সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়। ১৯৬৪ সালে একজন ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিক তাঁরজগত বিখ্যাত দর্শন সম্পর্কিত গ্রন্থ ‘বিং অ্যান্ড নাথিংনেস’ এর জন্য নোবেল কমিটি কর্তৃক চূড়ান্ত মনোনীত হয়েও প্রকাশ্য ঘোষণাপূর্বক এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ইতিহাসে সর্বপ্রথম হিসেবে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণার কয়েকদিন পূর্বেই নোবেল গ্রহণ করবেন না মর্মে চিঠি দিয়ে হৈচৈ ফেলে দেওয়া ব্যক্তিত্বের নাম জঁ পল সার্ত্রে।বিংশ শতকের আলোচিত ফরাসি দর্শন ও মার্ক্সিজমের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাত জঁপল সার্ত্রে নোবেল পুরস্কারের মতো লোভনীয় পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে ইতিহাসের বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।
যদিও সার্ত্রের পূর্বে ১৯৫৮ সালে রুশ লেখক বরিস পাস্তেরনাক নোবেল প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে ঐ প্রত্যাখ্যানের নেপথ্যে ছিল ভিন্ন ঘটনা। নোবেল পাবার সংবাদ শুনে বরিস পাস্তেরনাক আনন্দিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু পুরস্কার ঘোষণার চার দিন পর নোবেল কমিটি পাস্তেরনাকের নিকট হতে একটি বার্তা পায়। তাতে লেখা ছিলো, ‘আমার সমাজে এ্ই পুরস্কারের তাৎপর্য বিবেচনা করে আমি তা গ্রহণ করতে পারছি না। অনুগ্রহ করে আমার এই স্বেচ্ছা প্রত্যাখ্যানে আহত হবেন না।’ পরবর্তীতে বরিস পাস্তেরনাক নোবেল প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে আমৃত্যু পরিষ্কার করে কিছু বলেননি। তবে ধারণা করা হয়ে থাকে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে তিনি নোবেল প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফরাসি চিন্তক, সাহিত্যিক ও দার্শনিক জঁ-পল সার্ত্রে১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন।কিন্তু এই পুরস্কার গ্রহণে তিনি সরাসরি অস্বীকৃতি জানান। তার মতে, একজন লেখকের জন্য কখনোই নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে দেওয়া উচিত নয়।সে হিসেবে কোন প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার গ্রহণকে জঁ পল সার্ত্রে নিজের বিকাশের পথে অন্তরায় হিসেবে অভিহিত করেন। ১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবর নোবেল পুরুষ্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয় । ইতিপূর্বে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হচ্ছেন জানতে পেরে জঁ পল সার্ত্রে ১৪ অক্টোবর নোবেল কমিটি বরাবর একটি চিঠি লেখেন, যেন তার নাম মনোনয়নের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয় । তিনি চিঠিতে নোবেল কমিটিকে সতর্ক করে দেন এই বলে, যদি তাঁকে পুরুষ্কার দেয়াও হয় তা তিনি গ্রহন করবেন না।কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, তার চিঠিটা কেউ পড়েনি ।
১৯৭৩ সালেও এমন একটি ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। ভিয়েতনামের ক্রান্তিকালে ভিয়েতনামী বিপ্লবী লে ডাক থো এবং ইউএস নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরী কিসিঞ্জারের ভূমিকার কথা বিবেচনা করে ১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেলের জন্য মনোনীত করা হয়। হেনরী কিসিঞ্জার নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করলেও লে ডাক থো বেঁকে বসেন এবং এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। প্রত্যাখানের স্বপক্ষে তাঁর যুক্তি হলো, ভিয়েতনামে এখনো শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কীভাবে আমি নোবেল নেবো?
উল্লেখ্য, হেনরী কিসিঞ্জারের শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্তি বেশ হাস্যকর ছিলো। তিনি ১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং পাকিস্তানি নির্মম গণহত্যাকে সমর্থন করেছিলেন। এনমকি স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশকে নিয়ে বিষেদাগার করেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুড়ি এবং ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কেও বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত নিয়ে অমানবিক বক্তব্য প্রদানকারী একজন বিতর্কিত রাজনীতিককে শান্তিতে নোবেল প্রদান করায় নোবেল কমিটি ব্যাপক সমালোচিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালে সাহিত্যে নোবেল জয়ী মার্কিন গীতিকবি বব ডিলান প্রথমে প্ররস্কার গ্রহণ না করলেও পরবর্তীতে পুরস্কার গ্রহণ করেন।
জঁপল সার্ত্রে সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্যতত্ত¡, উত্তর উপনিবেশবাদি তত্ত¡ ও সাহিত্য গবেষণায় ব্যপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তিনি নিজ যোগ্যতা গুণে সমকালীন দার্শনিক সমাজের উঁচু স্তরে অবস্থান করেছিলেন এবং এখনো বিশ্বসাহিত্য বলেন আর দর্শন বলেন যে রাস্তায়ই মানুষ হাঁটুক না কেন, জঁ পল সার্ত্রেকে অধ্যয়ন করতেই হবে। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। এই মহামানবীয় গুণ তিনি তাঁর দর্শন তত্ত্বের মাধ্যমেই অর্জন করেছিলেন। কোন সমাজতান্ত্রিক দলের সাথে সার্ত্রে সরাসরি সম্পর্ক না রাখলেও তাঁর লেখনীতে সমাজতন্ত্রের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন খুঁজে পাওয়া যায়। সাম্যবাদ ও মানবতাবাদের অগ্রসেনা হিসেবে তিনি সকল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। এসব কারণে তাঁর ফ্ল্যাটে বোমা ছোড়া হয়, চেষ্টা করা হয় প্রাণে মেরে ফেলার।
জঁপল সার্ত্রেকে ফরাসি অস্তিবাদের জনক মনে করা হয়।তাঁর দর্শন অস্তিত্ববাদ – নান্দনিক বিষয়কে প্রাধান্য দেয়। সামাজিক সমস্যা সমাধানে তাঁর কথা হলো, প্রকৃতপক্ষে মানুষের সত্তা বা অধিবিদ্যক ধারণার কোনো প্রয়োজনই নেই, কারণ তা মানুষের জীবনে পরিপ‚র্ণভাবে সুখ দিতে পারে না।মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার নিজের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া। অস্তিত্ব স্বীকৃত হলেই মানুষের জীবনে সত্য অর্জিত হয়। কারণ মানুষ সর্বাবস্থায় স্বাধীন। স্বাধীন ব্যক্তিসত্তাই মানুষকে সাহায্য করে সবকিছুচিনতে, ভাবতে ও অর্জন করতে।সার্ত্রে তাঁর সাহিত্যকর্মে দেখিয়েছেন, বিবেচনাহীনতার কাছে ব্যক্তিমানুষ কতই না অসহায়! তিনি মনে করেন, এই মানবতাবাদ পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল মানুষের জন্য চ‚ড়ান্ত মানবতারহতে পারে। ব্যক্তি যদি তার অস্তিত্ব বিষয়ে সচেতন থাকে, তবে তাকে শোষণ করা খুব সহজ হবে না।
২০ শতকের বিখ্যাত ফরাসি লেখক, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক জঁ পল সার্ত্রে প্রথাবিরোধী লেখক ছিলেন। তাঁর চিন্তা-চেতনা জুড়ে ছিলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক প্রথাভাঙার প্রবল ঝড়। তিনি প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির তেমন তোয়াক্কা করতেন না। অপরদিকে যখন যা ঠিক মনে করেছেন তা-ই অকপটে প্রকাশ করতেন। তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর অস্তিত্ববাদ বিষয়ক দর্শনের জন্য। দর্শনের ইতিহাসে তাঁর ‘বিং অ্যান্ড নাথিংনেস’পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী দর্শনগ্রন্থের একটি, যেটির জন্য তিনি নোবেল পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিলেন । অথচ ব্যক্তিগত দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক অভিহিত করে তিনি নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন! নোবেল পেলেই ইতিহাস মনে রাখবে বিষয়টি কিন্তু এমনও নয়। আইনস্টাইন নোবেল পেলেও নোবেল পাননি লিউ টলস্তয়। তাই বলে কী টলস্তয়কে মানুষ ভুলে গেছে! যতদিন সূর্য পশ্চিমাকাশে ঊদিত হবে, ততদিন জঁ পল সার্ত্রে পৃথিবীতে বেঁেচ থাকবেন।