নোবেলজয়ী ওলগা টোকারচুক ও পিটার হ্যান্ডকে’র সাড়াজাগানো সৃষ্টি

160

সাহিত্য মানুষের সহিত। মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে। সরাসরি কিংবা ঘোমটা পরে। আর এই সাহিত্য যখন পুরোপুরি মানুষের হয়ে ওঠে। মানুষের অন্দরমহলের কথা বলে তখন তা মানুষের হৃদয়াসনে আসীন হয়। প্রোজ্জ্বল হয়ে আলোকিত করে হৃদ প্রকোষ্ঠকে। সামসময়িক বিষয়কে নান্দনিকভাবে ফুটে তুলে। কিন্তু তা আর থাকে না কালের গÐিতে আবদ্ধ। হয়ে ওঠে কালজয়ী।
অনুরূপ বিষয়াদি নিজ সৃজনে ধারণ করে পাঠক হৃদয়কে উদ্বেলিত করে শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে যাঁরা সাড়া ফেলে দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সদ্য নোবেলজয়ী পোলিশ প্রোজ্জ্বল ঔপন্যাসিক ওলগা টোকারচুক ও অস্ট্রিয়ান বহুমাত্রিক লেখক পিটার হ্যান্ডকে। সাহিত্যাঙ্গনের সবথেকে মর্যাদাবান পুরস্কার হিশেবে ধরা হয় এই নোবেলকে। অসংখ্য লেখকের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ১২৯ জন লেখক এ পুরস্কারে ভ‚খিু হয়েছেন। সুতরাং অনুমেয় যে কোন পর্যায়ের লেখক হলে বা সৃজনকর্ম মানুষকে উপহার দিলে এরকম পুরস্কারে ভ‚খিু হওয়া যায়। যদিও সুইডিশ নোবেল কমিটি মাঝেমধ্যে এমন দু’য়েকজন ব্যক্তিকে নোবেলে ভ‚খিু করেন যা সাধারণ মানুষের নিকট মানদÐের প্রশ্নে একবারে তলানিতে পড়ে যায়।
গতবছর নোবেল ঘোষণা স্থগিত ছিল। কারণ নোবেল কমিটির একজন নারী সদস্যার স্বামী তার মাধ্যমে নোবেল কে পেতে যাচ্ছে সেই খবর নিয়ে জুয়াড়িদের কাছে পৌঁছে দিয়ে অর্থ বাগিয়ে নেয়। আর এরকমটি যে শুধু গতবছর হয়েছে এমনটা নয়। অনেকদিন ধরেই তা চলে আসছিল। আর সেই জুয়াড়িদের থেকে যে অর্থ পেতেন মহিলার স্বামী তা দিয়ে একটা এনজিও খুলেছেন। আর সেই এনজিওর মহিলাকর্মীদের উপর যৌন অত্যাচার করতো মহিলার স্বামী। এক পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে মহিলাকর্মীরা ফুঁসে উঠলে এ ঘটনার ফাঁস হয়। বিব্রত অনুভব করায় নোবেল কমিটি গতবছর নোবেল ঘোষণা স্থগিত করেছিল। সেই ২০১৮ সালের নোবেল আর ২০১৯ সালের নোবেল একত্রে ঘোষণা হয়ে গেলো গত বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর।
যেহেতু সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভ‚ষিত হয়েছেন উপর্যুক্ত দু’জন লেখক সেহেতু তাদের সাহিত্যকর্ম, ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন, রাজনৈতিক মতাদর্শ ইত্যাদি বিশদভাবে বিশ্লেশিত হচ্ছে। ওলগা টোগারচুকের যেরকমটি গ্রহণযোগ্যতা দেখা যাচ্ছে, অপরদিকে ঠিক পিটার হ্যান্ডকেকে ততোটাই সমালোচিত হতে হচ্ছে।
২.
গতবছর সাহিত্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মানের পুরস্কার ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে সারাবিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ৫৭ বছর বয়স্কা ওলগা। প্রথম কোনো পোলিশ লেখক হিসেবে এই সম্মাননা লাভ করেছিলেন তিনি। এই সম্মান তাকে এনে দিয়েছিল তাঁর ফ্লাইটস নামক উপন্যাস। সেটি পোলিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন জেনিফার ক্রোফট। সেটির পোলিশ নাম বিগুনি। সেসময়ই সাহিত্য সমালোচকগণ এক বাক্যে বলেছিলেন যে, ওলগাই হবেন ২০১৮ সালের নোবেলবিজয়ী। কেননা ওলগার লেখনশৈলী সত্যিই অসাধারণ ও ভিন্ন আঙ্গিকের।
মানবিক ও ভিন্ন আঙ্গিকের ঔপন্যাসিক ওলগা টোকারচুক ১৯৬২ সালের ২৯ জানুয়ারি মধ্য ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডের জিয়েলোনা গোরার নিকটর্বুী সুলেচো নামক সুন্দর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এখন রোকলাও নামক স্থানে বসবাস করেন। সেই ছোট্টবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি ওলগার আগ্রহ জন্মে। প্রাথমিক জীবনে তিনি কবিতা চর্চা করতেন। পরর্বুীতে কথাসাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়েন ওলগা। শিক্ষক দম্পতির সন্তান হওয়ায় তাঁর ভিতরে শিক্ষার নানা দিক কাজ করে। অধিকন্তু তাঁর বাবা একজন লাইব্রেরিয়ানও ছিলেন। ফলে লাইব্রেরিতে অনায়াসে গমন করে গুরুত্বপ‚র্ণ অনেক বইয়ের পাঠ শেষ করেন ওলগা। সেসকল বিষয়াদি নিজের ভিতর প্রথিত করে সৃজনকর্মে এনেছিলেন চমৎকারিত্ব।
তিনি ১৯৮০ সালে রাজধানী ওয়াারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। এ সময় তিনি কিশোরদের আচরণগত সমস্যার জন্য নির্মিত কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে জীবনের প্রথম কর্মজীবন আরম্ভ করেন। ১৯৮৫ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি ভ্রোক্লাউ ও পরে ভালব্রিচে চলে যান, সেখানে তিনি থেরাপিস্ট হিসেবে অনুশীলন শুরু করেন। এই থেরাপির অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনকে এগিয়ে নিতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করেছে। টোকারচুক নিজেকে কার্ল জাঙের শিষ্য হিসেবে বিবেচনা করেন। জাঙের মনস্তত্ত¡ তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বলে উল্লেখ করেন।
বর্তমানে ওলগা লিখালিখির পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিগত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘রুটা’ দেখভাল করছেন। কারণ তিনি জীবিকার্জনের জন্য নিজ লিখিণ বইয়ের বিক্রিত অর্থের পাশাপাশি স্বচ্ছলতার জন্য এবং শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার জন্যই এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। সামসময়িক সকল ইস্যুতেই তিনি প্রথমসারির একজন আন্দোলনকারী। রাজনৈতিক মতাদর্শে দল দ্য গ্রিনসের সদস্য এবং বামপন্থী ধারণায় বিশ্বাসী
ওলগা টোকারচুক শুধু একজন লেখকই নন, মানবিক অন্যান্য গুণাবলীরও অধিকারী তিনি। যেমন তিনি একজন একনিষ্ঠ সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবী। তাকে পোল্যান্ডে তাঁর প্রজন্মের অন্যতম সমাদৃত ও ব্যবসাসফল লেখক বলে গণ্য করা হয়।
ওলগা আসলেই কতটা বৃত লেখিকা ও মানবী তা তাঁর জীবনী দেখলেই স্পষ্ট বুঝা যায়। সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী ১১৪ জন পুরুষ আর ১৫ জন নারীর মধ্যে পনেরতম মহিলা সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া সত্যই সম্মানের। ৫৭ বছর বয়সী টোকারচুককে তাঁর প্রজন্মের শীর্ষ ঔপন্যাসিক মনে করা হয়ে থাকে। তিনি বাস্তবতা আর কল্পনার মিশ্রণে উপন্যাস লেখেন। তবে, এক্ষেত্রে কল্পনাগুলোর স‚ত্রপাত হয়ে থাকে বাস্তবতা থেকেই।
মধ্যপ্রজ লেখিকা ওলগা এ পর্যন্ত নয়টি উপন্যাস ও কয়েকটি ছোটগল্প ও প্রবন্ধের বই লিখেছেন। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বই দ্য বুকস অব জ্যাকব নয়শ পৃষ্ঠার এক মহাকাব্যিক উপন্যাস যার পটভ‚মি অষ্টাদশ শতকের পোলান্ড। পোল্যান্ডে এ বইটির কদর উচ্চমানের। নোবেল কমিটি ওলগাকে বলেছেন তাঁর প্রজন্মের পোলান্ডের সবচেয়ে মেধাবী লেখক। তাঁর লেখনি সম্পর্কে কমিটির উদ্ধৃতি ‘সীমারেখা ভেঙেচুরে চলা মানবজীবনের চিত্র গভীর মমতায়, কল্পনায় ও আগ্রহে তিনি তুলে ধরেছেন’।
৩.
সাহিত্যে ২০১৯ এর নোবেলবিজয়ী পিটার হ্যান্ডকে। মধ্য ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ার একজন সামসময়িক প্রখ্যাত লেখক পিটার। অস্ট্রিয়ার গ্রিফেন শহরে ৬ ডিসেম্বর ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ এই আলোচিত সমালোচিত লেখকের। ব্যাংকের করণিকের ছেলে পিটার গ্রাজ ইউনিভারসিটিতে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তবে ডিগ্রি অর্জনের প‚র্বেই তিনি পড়াশোনা বাদ দেন।
পিটার হ্যান্ডকে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৬ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ডাই হরনিসেন এর প্রকাশের মাধ্যমে। তবে তিনবছর পর নিজেকে সাহিত্যধারায় প্রতিষ্ঠা করেন অফেন্ডিং দ্য অডিয়েন্স প্রকাশের মাধ্যমেই।
চলচ্চিত্র নির্মাণেও পিটার সম্পৃক্ত ছিলেন। আর এই চলচ্চিত্র তাকে সমধিক খ্যাতি এনে দেয়। তাঁর খুবই কাছের বন্ধু প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার উইম ওয়েনডার্স এর সাথে কিছু দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সাড়াজাগানো কিছু স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। ১৯৮৭ সালে উইংস অব ডিজার্স নামক চলচ্চিত্রটি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কিছু ফিচার ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখার পাশাপাশি তিনি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাঁর জীবনীর উপর একটি ডকুমেন্টারি ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়।
এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা’র মতে, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, বেতার নাটক আর কিছু আত্মজীবনীমূলক লেখা তিনি লিখেছেন। পিটারের লিখনির সবথেকে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ভাষার সারল্য, প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতা, সমাজের কুসংস্কারচ্ছন্নতার বিরুদ্ধবাদ ইত্যাদি।
৭৬ বছর বয়স্ক পিটারের সাহিত্যিক খ্যাতির উপর কলঙ্ক লেপন হয় ২০০৬ সালে বলকানের কসাই খ্যাত সেøাবেদেন মিলোসোভিক এর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগদান করে তার স্তুতি করে বক্তৃতা করে। অথচ সেøাবেদন এর বিরুদ্ধে তখন হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আটহাজার মুসলিম গণহত্যার বিচারকার্য চলমান ছিল।
নোবেল প্রাইজ কমিটি টুইটারে জানিয়েছেন যে, পিটার প্রায় পঞ্চাশবছর পর উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন প্রকার সাহিত্য সৃষ্টি করে পাঠকের হৃদয়ে আসন গেড়ে নেন। এবং এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবথেকে গুরুত্বপ‚র্ণ লেখক হিশেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন।
সুইডিশ একাডেমি পিটারের আ সরো বিয়ন্ড ড্রিমস গ্রন্থটির উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তাদের মতে এটি সংক্ষিপ্ত এবং তেজালো, কিন্তু গভীরভাবে গ্রহণীয় গ্রন্থ। পিটারের জননী জীবনের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই ঘটনাটিই এখানে উপস্থাপিত হয়েছে।
পুরস্কার পাওয়ার পর পিটার হ্যান্ডকে বলেন, তিনি বিস্মিত হয়েছেন। সুইডিশ একাডেমির এটা খুবই সাহসী সিদ্ধান্ত।
অষ্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট এই পুরস্কার প্রাপ্তিতে পিটারকে অভিনন্দন জানিয়ে এপিকে এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকার দেন। সেখানে তিনি বলেন, এটা আমার দেশের জন্য বড়ই সম্মানের খবর।
পিটারের বিখ্যাত সৃজনকর্মের মধ্যে উপন্যাস নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্রই প্রোজ্জ্বল। তাঁর চলচ্চিত্রগুলি যেমনি ব্যবসা সফল তেমনি শিল্পমানে অনন্য। তাঁর সেসকল চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কল্পিত সিনেমা উইংস অব ডিজায়ার। ড্যামিয়েল ও ক্যাসিয়েল নামক দু’জন পরী। বার্লিনের ব্যস্ত শহুরে রাস্তায় তারা পথিকদের পর্যবেক্ষণ করে। তাদেরকে মনের গহীনে এক অদৃশ্য আলো দেখায়। কিন্তু তাদের সাথে কোনোরূপ ইন্টারেকশন করে না। এভাবেই ড্যামিয়েল শরীরচর্চার যন্ত্রশিল্পী ম্যারিওনের প্রেমে পড়ে যায়। পরীটি অনেকদিন বাস্তব জগতের সাথে থেকে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এই চলচ্চিত্রের জন্য পরিচালক ওয়েন্ডার্স কান চলচ্চিত্র উৎসব আর ইউরোপিয়ান ফিল্ম এওয়ার্ডস এ সেরা পরিচালকের পুরস্কারে ভ‚ষিত হন।
৪.
সাহিত্য মানুষের কথা বলবে। মানবুার কথা বলবে। কিন্তু যদি কোনো সাহিত্যিক মানবতা বিরোধী কোনো কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন বা সমর্থন করেন তবে তার লেখক সত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। বর্তমান সময়ের সবথেকে আলোচিত উপর্যুক্ত দু’জন সাহিত্যিক একই এলাকার দেশের নাগরিক, একই মানের পুরস্কারে ভ‚ষিত হলেও চিন্তা-দর্শনের দিক থেকে উভয়ই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা ও চিন্তক। একজনের স্তুতিতে যেমন গোটা চিন্তাশীল সমাজ মুখরিত। ঠিক অন্যজনের সমালোচনায়ও মুখরিত গোটা বিশ্বের জাগ্রত বিবেক। আমাদের আজ আশু কর্তব্য নিজ দর্শন ও মতাদর্শ ঠিক করে নেয়া। কেননা আজকের সাময়িক সুবিধার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যেন না হই আমি ঘৃণার পাত্র।