নৈতিকতা ও মূল্যবোধ

533

মানুষ কি শুধু বাঁচতে চায়, না শুধু বাঁচতে চায় নাÑ বাঁচার মত বাঁচতে চায়, সহজে ও স্বস্তিতে বাঁচতে চায়, আনন্দ নিয়ে বাঁচতে চায়। সেভাবে বাঁচুক না, বাধা কোথায়। হ্যা! বাধা আছে। সে পূর্ণতায় বাঁচা এত সহজ না, তাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। আর সংগ্রাম মানে তো বাধা অতিক্রম করা, সমস্যা কাটিয়ে উঠার অব্যাহত প্রচেষ্টা।
সংগ্রামশীলতার চেতনা আসতে হয়, আসে- সমসাময়িক সামাজিক অসংগতি থেকে, সেই অসংগতি ও অমানবিকতার প্রতি সংবেনশীল দায়িত্ববোধে এবং জীবনমান উন্নয়নে। এভাবে মানব সমাজ বিকাশের পথে নানা সমস্যা অসংগতি দূর করতে গিয়ে তাদের প্রত্যেকটির জন্য এক একটি অনুজ্ঞান তৈরি হয়। অনুজ্ঞান হল জলবিন্দু বা ফোঁটার মত। যাদের সামষ্টিক প্রবাহে সভ্যতা ও সংস্কৃতি তৈরি হয়। এ সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রবাহে, নদীর মত উৎস থাকে। আবার লক্ষ্যও থাকে। নদীর উৎস পাহাড় ঝর্ণা, আর লক্ষ্য হল সাগর। সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রবাহের উৎস হল মানব সমাজ, আর লক্ষ্য হল মানুষকে বাঁচানোÑমর্যাদাময় আর উপভোগ্য করে বাঁচানো। সেখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে- নদীর নির্দিষ্ট দিকে জলপ্রবাহের জন্য, জল প্রবাহের তিব্রতার জন্য, জলরাশিকে দুইদিকে তটবন্দী থাকতে হয়। আর সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশের ধারা মূল্যবোধ ও নৈতিকতার তটবন্দী হয়ে, জল প্রবাহের মত প্রবাহিত হতে হয়। জলরাশি তটবন্দী হওয়া ছাড়া যেমন নদী হতে পারে না, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার তটবন্দী হওয়ার ছাড়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানবমুখিতা থাকতে পারে না।শুধু সংগ্রাম করলে হয় না, সংগ্রামের জীবনমুখিতা থাকতে হয়, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের কাঠামোতে হতে হয়। তবেই সংগ্রামীচেতনার অগ্রসরতা কার্যকর হয়। সবাই সমাজের প্রতি সংবেদনশীল ও সংগ্রামী চেতনায় হৃদ্ধ হতে পারে না, জাগরন ঘঠাতে পারে না। কেউ কেউ পারে। তারা মনবতা বিকাশের পথে তৈরি বাঁধা ভাংতে চায়, সমস্যা সমাধানে যুক্তিসিদ্ধ চেতনাকে ধারণ করে ব্যবহার করতে চায়। এতে তাদের চিন্তাশীলতার বিষয়টিতে উৎকর্ষ ঘটে, যা বৌদ্ধিক চেতনায় রূপান্তর ঘটে। সেই বৌদ্ধিকচেতনায় এসে সবাই সফল হতে পারে না। এগিয়ে যাওয়ার জন্য, বুদ্ধির কার্যকারিতার জন্য সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি লাগে। সাহস লাগে। তাতে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ থাকতে হয়। তা না থাকলে সে বৌদ্ধিক চেতনার বিলুপ্তি ঘটে। তাতে কি সংগ্রামশীলতা হারিয়ে যায়, না হারিয় যায় না। সেই বৌদ্ধিক চেতনাকে কাজে লাগানোর জন্য সমাজের প্রাগসর সৃজনশীল ব্যক্তিরা নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যায়, পরিবর্তন করে বুদ্ধিকে। বাধা কাটিয়ে উঠার উপযোগী করা সম্ভব হলে সমস্যা সমাধানে উপযোগী করে Ñ তবে সেই সমস্যা ও বাধা কাটিয়ে উঠা মুখি বুদ্ধি তখন জ্ঞানে রূপান্তর ঘটে। এভাবে অনুজ্ঞানের সমষ্টির থেকে সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ ঘটে।
এক কথায় মানুষের সংগ্রামশীলতার জীবনে জ্ঞান, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ হল মূল সম্পদ। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ছাড়া কোন জ্ঞানই জ্ঞান হয় না। যুক্তিসিদ্ধতায় ও দর্শন চেতনায় যা বর্জনীয়। এই নৈতিকার ও মূল্যবোধের কারণে সমাজ কাঠামো রাষ্ট্র কাঠামোতে মানুষকে থাকতেই হল। তাই মানুষ শুরুতেই প্রাকৃতিকভাবে মুক্ত হলেও পরে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রাণীতে পরিণত হয়। যা কৃত্রিম, মানুুষের সৃষ্টি। সামাজিক মানুষ মাত্রই মূলবোধ ধারন করতে হয়। নৈতিকতায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিশেষত্বসেখানে নয়, সে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের গুনগত মানে কতটুকু মানবতামুখী ও সময়োপযোগী তাতে। আমরা মানুষ, তাই নির্ভর যোগ্য জ্ঞানের চেষ্টায়, অপরের সহযোগিতায় নিজেকে এবং সমাজেকে বদলাতে পারি, বিকশিত করতে পারি। এই বিকাশের ধারায় মানুষ নিজেকে সম্পৃক্ত করতে গিয়ে নিজের ইচ্ছা, পছন্দ ও আকাক্সক্ষাকে অন্যসবের ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, পছন্দ এর সাথে সমন্বিত করতে হয়। সামঞ্জস্য করতে হয়। এতেই সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে উঠে। সংস্কৃতির কল্যাণ মুখী সমাজমূখী দিক তৈরি হয়।
এই সামাজিক মূল্যবোধে আবার তিনটি শর্ত কার্যকর রাখতে হয়Ñ যৌক্তিকতা, সামাজিকতা ও মনস্তাত্তি¡কতা। যাতে মানুষের প্রত্যাশা পূরনে, উন্নয় প্রচেষ্টায়, জীবন দর্শনে, জাতীয় আদর্শে ও ঐক্যবদ্ধতায় স্বতঃস্ফূর্ত দায়বদ্ধতা থেকে সচেষ্ট থাকতে পারে। তাতে জ্ঞাননির্ভর, জীবনমুখী আধুনিক ভাব সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জোরালো প্রবাহ তৈরি হয়। তাতে সামাজিক অনাচার, কুসংস্কার ভেসে যায়, ঠিকতে না পেরে। মূল্যবোধ ও নীতিবোধের উন্নত চেতনায় সংস্কৃতিকে প্রবাহমান রাখে, জীবনকে স্বাচ্ছন্দময় করে তোলে। তাই সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ উন্নত সমাজে মানুষ মুল্যবোধ ধারন করে থাকতে পারে। নীতির প্রশ্নে অটল থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতো এখনও আধিপত্য মানসিকতা, পশ্চাদপদ দৃষ্টিভঙ্গি, অজ্ঞতা-মূঢ়তা, নিছক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চেঁপে দেওয়া থেকে পূর্নমুক্ত হতে পারেনি। ফলে মানুষ সমাজ বিমুখ হয়ে পড়ে। সুস্থ ধারার সংস্কৃতির বিকাশ শ্লথ হয়ে পড়ে,দুর্বল হয়ে যায়। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এর বিকাশের স্তর বিবেচনায় আমরা তিনটি স্তর অতিক্রম করতে যাচ্ছি। ধর্মীয় যুগ, দর্শনের যুগ ও বিজ্ঞানের যুগ।
আমাদের মূল্যবোধের সংকট তৈরি হয় তখনই যখন নিজেরা মন-মননে অখÐতা বজায় রাখতে পারি না। আমরা বাস করি যুক্তিসিদ্ধ বিজ্ঞান যুগেÑ কিন্তু ভাবগত চেতনায় মধ্যযুগে থেকে যাই। বিজ্ঞান পড়েও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন থাকি, বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারি না, পারিবারিক, সামাজিক, পেশাগত জীবনে খÐবিখÐিত হয়ে যাই। মনন সত্তার সুস্থতার নিশ্চয়তা বিঘিœত হয়। পারিবারিক জীবনে যা ঔচিত্য মনে করি, দয়িত্ব মনে করি, সমাজিক জীবনে তা মনে করি না। আবার সমাজিক জীবনে যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা প্রকাশ করে নিজেকে গ্রহনীয় পুজনীয় করিÑপেশাগত জীবনে তা ধারণ করি না। এ বহুরূপতায় বেঁচে থাকা যায় কিন্তু চারিত্রিক দৃঢ়তায় বাঁচার মত বাঁচা যায় না, সুস্থ সুন্দরভাবে বাঁচা যায় না। সেভাবে বাঁচতে চাইলে মূল্যবোধে দৃঢ়তা থাকতে হয়। যাতে মানুষ তার নিজের কাজের উপর প্রভুত্ব করতে পারে। সে নিজের জন্যই নিজের কাজের তত্ত¡াবধায়ক হতে পারে। যেমন মূল্যবোধের দিক দিয়ে মানুষকে স্বজাতির ইতিহাস সচেতন থাকতে হয়। যে জাতি ইতিহাস ভুলে যায় সে জাতিকে ধর্মান্ধতা ও কুসংস্করে গ্রাস করে। অতিথে যেমন সেই ইতিহাস ভুলে যাওয়ার কারণে আমাদের জাতীয় জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল।
আবার মূল্যবোধের মানদÐের দিকে মনযোগ দিতে হয়। মৌলিক মানদÐ দুটিÑ একটি বিজ্ঞান মনস্কতা, দ্বিতীয়টি আন্তর্জাতিকতা, এই দুইটির মাপকাঠিতে যদি মূল্যবোধ ও নৈতিকতা দাঁড় করানো যায় তাহলে আমরা কূপমন্ডুকতা থেকে রক্ষা পাই, কুসংস্কারের অনাচার থেকে মুক্ত হই। কারণ মূল্যবোধ যদি এ মানদন্ডে না হয় তাহলে আত্মপ্রত্যয়হীনতা, হৃতসামর্থ্য, নির্বোধ অনুসরণ মানসিক জাড্য,ভোগবৃত্তি থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না।
অন্য দিকে সে মানের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ধারন উপযোগী সংস্কৃতি নামক জীবন প্রবাহ থাকতে হয়।সেই উপযোগী সংস্কৃতির মানুষদেরকে হতে হয় মননশীল, সৃজনশীল। যারা মননশীল তারা যা আছে তা থেকে উপদান নিয়ে, যা নেই তাকে কল্পনা করে এবং রূপ দেয়। যাতে মন-মননে ব্যক্তি সমাজকে প্রাগ্রসর রাখতে পারে। আর যারা সৃজনশীল তারা বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়। আর জীবন মানের উন্নয়ন ঘটায়। আরোপিত কিছুর চেয়ে অর্জিত কিছুকে মূল্যবান মনে করে। যার জন্য অভিজ্ঞতাই জ্ঞান বিবেচিত হয়, আর সমস্য সমাধান উপযোগী, পরিশোধিত বুদ্ধিকে জ্ঞান বিবেচনা করে।যে অনুজ্ঞানের সামষ্টিক ¯্রােতে সংস্কৃতির প্রবাহ বিকাশমান থাকে। এ মাপকাঠির বিচার বহিঃভূত মূল্যবোধ বা আচার থাকতে পারে না।সেরূপ কিছু থাকলে তা কুসংস্কার জীবনবিমুখ অনাচার ছাড়া অন্য কিছু নয়। এসব আচার কুসংস্কার যে সমাজে থাকে সে সমাজে ব্যক্তিত্বের স্ফুরণে, প্রতিভার বিকাশে, কার্যদক্ষতা বৃদ্ধির পথে বড় বাধা। যার জন্য বড় মাপের বড় মানুষ পাওয়া সেই সমাজে কঠিন হয়ে পড়ে। আর বড় মাপের মানুষ না হলে কখনো বড় জাতি আশা করা যায় না। এজন্য মূল্যবোধ ও নীতিবোধের মাপকাঠি প্রয়োজন। আর সেই পরিমাপে যা ধারন করা উপযোগীÑ উর্বর, আধুনিক উৎপাদনশীল সংস্কৃতি পরিমÐলের প্রতি মনোযোগী হওয়া দরকার। যা মানবিকতায় পূর্ণ, উন্নত সমাজ ধারণ করে।
আমাদের দেশ বস্তুগত সংস্কৃতির কাঠামো উন্নয়নে অনেক দূর এগিয়ে গেছে- পদ্মাসেতু, মেট্রো ট্রেন, কর্ণফুলী টার্নেল, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পারমাণবিক চল্লি, বঙ্গবন্ধু স্যাটালাইট, অগনিত ফ্লাইওভার ইত্যাদিÑ এসব কিছু জীবন যাপনকে সহজ করেছে। কিন্তু কতটুকু জীবনকে স্বস্তিতে রেখেছে সে প্রশ্ন থেকে যায়। এসব কিছুÑ প্রকল্প ও অর্থের জোরে দ্রæত করা যায়। কিন্তু মন-মননে, সভ্যতা- সংস্কারে, অনুশীলন- পরিশীলনে, শিক্ষায় – দীক্ষায়, নীতি-রীতিতে, আচার-আচরণে, রুচি-অভিরুচিতে কতটুকু মান অর্জন করতে পেরেছি, সে ব্যাপারে আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। এসব অর্জনেÑ ধারনে, প্রজ¤œান্তরে বিস্তারে ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন গুণগত মানের জীবনবোধ,সাহিত্য ও শিল্প চর্চার ক্ষেত্র প্রসার ও বিস্তার করা প্রয়োজন। এসবে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মানদÐ কার্যকর করতে ধৈর্য লাগে, সময় লাগে। আর লাগে রূচি ও জ্ঞানের গভিরতা। অন্তসারশূন্য বাজার গণরুচির,ভোগবৃত্তের সংস্কৃতি থেকে বাহির হয়ে আসতে হয়Ñ প্রজন্মদের রক্ষার স্বার্থে। এর জন্য চিন্তনে-মননে-সৃজনে সমাজকে এগিয়ে রাখতে হবে। মন্দকে অবদমন করতে গেলে শক্তি ক্ষয় হয়। মূল্যবোধের ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে শ্রেয়কে সামনে আসার সুযোগ করে দিয়ে তা জোরালো করতে হবেÑ যাতে মন্দÑঅপ সংযুক্তিতে বাধা সকল কিছু তলিয়ে যায় ভেসে যায়। তবেই মূল্যবোধের, নীতিবোধের কার্যকারিতায় সুবাতাস বইবে। ফলে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য যে ঐক্যবদ্ধ জাতির মন-মননের উন্মেষ ও দেশপ্রেম প্রয়োজন তা গড়ে ওঠা ত্বরান্বিত হবে। আর তা সম্ভব হলে মানুষ বাঁচার মত বাঁচতে পারবে, মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারবে,যা সময়ের দাবি। সে দাবী মেটাতে, তা অর্জন করতে আমারেদ স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি সংবেদশীল হয়ে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবেÑগণমানুষের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্বার্থে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক