নেতা থেকে বঙ্গবন্ধু -৭

78

আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী

[গত সংখ্যার পর]
৬ নম্বর দফা : এই দফাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দফায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষী বাহিনী গঠনে সুপারিশ করেন। এই দফা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এই দফায় আমি পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষী বাহিনী গঠনের সুপারিশ করিয়াছি। এ দাবী অন্যায়ও নয়, নতুনও নয়। একুশ দফা দাবীতে আমরা আনসার বাহিনীকে ইউনিফর্মধারী সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তরিত করার দাবী করিয়াছিলাম। তাতো করা হয়ই নাই, বরং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনস্ত, ইপিআর বাহিনীকে এখন কেন্দ্রের আওতায় নেওয়া হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করতঃ এ অঞ্চলকে আত্মরক্ষায় আত্মনির্ভর করার দাবি একুশ দফার দাবি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বারো বছরেও আমাদের একটা দাবিও পূরণ করে নাই। পূর্ব পাকিস্তানে অধিকাংশ পাকিস্তানির বাসস্থান। এটাকে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় সরকারেরই নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে আমাদের দাবী করিতে হইবে কেন? সরকার নিজে হইতে সে দায়িত্ব পালন করেন না কেন? পশ্চিম পাকিস্তানকে আগে বাঁচাইয়া সময় ও সুযোগ থাকিলে পরে পূর্ব পাকিস্তান বাঁচানো হইবে, ইহাই কি কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমত? পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষা ব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানেই রহিয়াছে- এমন সাংঘাতিক কথা শাসনকর্তারা বলেন কোন মুখে? মাত্র সতের দিনের পাক-ভারত যুদ্ধ কি প্রমান করে নাই আমরা কত নিরুপায়? শত্রæর দয়া ও মর্জির ওপর তো আমরা বাঁচিয়া থাকিতে পারি না। কেন্দ্রীয় সরকারের দেশরক্ষা নীতি কার্যতঃ আমাদেরকে তাহাই করিয়া রাখিয়াছে।” এ প্রস্তাবগুলো ব্যাখ্যাসহকারে “আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি” শীর্ষক পুস্তিকার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে প্রচারের জন্য পেশ করা হয়েছিল। এ কর্মসূচি তখন এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি ঘরেই এ পুস্তিকা জনগণ সযত্নে পড়েছিল এবং রেখেছিল। এ পুস্তিকায় বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তা হুবহু এখানে উদ্ধৃত হলো:
আমাদের বাঁচার দাবি
৬-দফা কর্মসূচি
-শেখ মুজিবুর রহমান
আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা,
আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবিরূপে ৬ দফা কর্মসূচি ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করার পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থবাদী দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছেন। জনগণের দুশমনদের এই চেহারা ও গালাগালির সহিত দেশবাসী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবি যখন উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈ চৈ করিয়া উঠিয়াছেন, আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, পূর্ব পাক জনগণের মুক্তিসনদ একুশ দফা দাবী, যুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবি, ছাত্র-তরুনদের সহজ ও স্বল্পব্যায়ে শিক্ষালাভের মাধ্যম করার দাবি ইত্যাদি সকল প্রকার দাবীর মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।
আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতেও এরা তেমনিভাবে পাকিস্তানকে দুই টুকরা করিবার দূরভিসন্ধি আরোপ করিতেছে। আমার প্রস্তাবিত ৬ দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি শোষিত-বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা-সমিতির বিবরণে, সকল শ্রেণীর সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ উদ্দীপনার সাদা দেখিতেছি। তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামীলীগ আমার ৬ দফা দাবি অনুমোদন করিয়াছেন। ফলে ৬ দফা দাবি আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবীতে পরিণত হইয়াছে। এ অবস্থায় কায়েমী স্বার্থবাদী শোষকদের প্রচারণায় জনগণ বিভ্রান্ত হইবেন না, সে বিশ্বাস আমার আছে।
কিন্তু এও জানি, জনগণের দুশমনদের ক্ষমতা অসীম ও তাদের বিত্ত প্রচুর। হাতিয়ার এদের অফুরন্ত, মুখ এদের দশটা, গলার সুর এদের শতাধিক। এরা বহুরূপী। ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এঁরা আছেন সরকারি তলে। আমার ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহায় দিয়ে এঁরা আছেন অপজিশন দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশমনির বেলায় এরা সকলে একজোট। এরা নানা ছলাকলায় জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিবেন। সে চেষ্টা শুরুও হইয়া গিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিষ্কাম সেবার জন্য এরা ইতিমধ্যে বাহির হইয়া পড়িয়াছেন। এদের হাজার চেষ্টাতেও আমার অধিকার সচেতন দেশবাসী সে বিভ্রান্ত হইবেন, তাতেও আমার কোন সন্দেহ নাই। তথাটি ৬ দফা দাবীর তাৎপর্য ও উহার অপরিহার্যতা জনগণের মধ্যে প্রচার করা সমস্ত গণতন্ত্রী, বিশেষত আওয়ামীলীগ কর্মীদের অবশ্য কর্তব্য। আশা করি তাঁরা সকলে অবিলম্বে ৬ দফা ব্যাখ্যার দফাওয়ারী সহজ সরল ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাও যুক্তিসহ এই পুস্তিকা প্রচার করিলাম। আওয়ামীলীগের তরফ হইতেও এ বিষয়ে আরো পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশ করা হইবে। আশা করি সাধারণভাবে সকল গণতন্ত্রী, বিশেষভাবে আওয়ামীলীগের কর্মিগণ ছাড়াও শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানি মাত্রই এইসব পুস্তিকার সদ্ব্যবহার করিবেন।
১ নম্বর দফা :
এই দফায় বলা হইয়াছে যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইন-সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে। ইহাতে আপত্তির কি আছে? লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগনের নিকট কায়েদে আযমসহ সকল নেতার দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা। মুসলিম বাংলার জনগণ একবাক্যে পাকিস্তানের বক্সে ভোট দিয়াছিল, এই প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭ টি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবী ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি। মুসলিম লীগ তখন কেন্দ্রের ও প্রদেশের সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সরকারী সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা লইয়া তাঁরা এ প্রস্তাবের বিরোধিকা করিয়াছিলেন। এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেই ইসলাম বিপন্ন ও পাকিস্তান ধ্বংস হইবে, এসব যুক্তি তখনও দেওয়া হইয়াছিল। তথাপি পূর্ব বাংলার ভোটাররা এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষের কথা বলিতে গেলে এই প্রশ্ন চূড়ান্তভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে মীমাংসিত হইয়াই গিয়াছে। কাজেই আজ লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলেই যাহারা আৎকিয়া উঠেন তাহারা হয় পাকিস্তান সংগ্রামে আগ্রহী ছিলেন না, অথবা তাহারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি-দাওয়ার বিরোধিকা ও কায়েমী স্বার্ধবাধীদের দালালী করিয়া পাকিস্তানের অনিষ্ট সাধন করিতে চান।
এই দফায় পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার, সার্বজনীন ভোটে সরাসরি নির্বাচন, আইন-সভার সার্বভৌমত্বের যে দাবি করা হইয়াছে তাতে আপত্তির কারণ কি? আমার প্রস্তাবই ভালো, না প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ও পরোক্ষ নির্বাচন এবং ক্ষমতাহীন আইনসভাই ভালো এ বিচারের ভার জনগণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া কি উচিত নয়? তবে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির এই তরফদারেরা এই সব প্রশ্নে রেফারেঞ্জামের মাধ্যমে জনমত যাচাই এর প্রস্তাব না দিয়া আমার বিরুদ্ধে গালাগালি বর্ষণ করিতেছেন কেন? তাঁহারা যদি নিজেদের মতে এতই আস্থাবান, দবে আসুন এই প্রশ্নের উপরই গণভোট হয়ে যাক।
২ নম্বর দফা :
এই দফায় আমি প্রস্তাব করিয়াছি যে, ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এই দুইটি বিষয় থঅকিবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেটসমূহের হাতে থাকিবে। এই প্রস্তাবের দরুনই কায়েমী স্বার্থের দালালরা আমার উপর সর্বাপেক্ষা বেশী চটিয়াছেন। আমি নাকি পাকিস্তানকে দুই টুকরা করতঃ ধ্বংস করিবার প্রস্তাব দিয়াছি। সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি ইহাদের এতই অন্ধ করিয়া ফেলিয়াছে যে, ইহারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল সুত্রগুলি পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছে। ইহারা ভুলিয়া যাইতেছে যে, ব্রিটিশ সরকারের ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালে যে প্ল্যান দিয়াছিলেন এবং যে প্ল্যান কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই গ্রহন করিয়াছিলেন তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এই তিনটি মাত্র বিষয় ছিল বাকী সব বিষয়ই প্রদেশের হাতে দেওয়া হয়েছিল। ইহা হইতে এইটা নিঃসন্দেহে প্রমাণিক হইয়াছে যে, ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলের মত এই যে, এই তিনটি মাত্র বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকিলেই কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে পারে। অন্য কারণে কংগ্রেস চুক্তিভঙ্গ করায় ‘ক্যবিনেট প্ল্যান’ পরিত্যক্ত হয়। তাহা না হইলে এই তিন বিষয় লইয়াই আজো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে থাকিত। আমি আমার প্রস্তাবে ক্যবিনেট প্ল্যানেরই অনুসরণ করিয়াছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা আমি বাদ দিয়াছি সত্য, কিন্তু তাহার যুক্তিসঙ্গত করাণও আছে। অখন্ড ভারতের বেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থারও অখÐতা ছিল। ফেডারেশন গঠনের রাষ্ট্রবৈজ্ঞানিক মূলনীতি এই যে, যে যে বিষয়ে ফেডারেটিং স্টেটসমূহের স্বার্থ এক ও অভিভাজ্য, কেবল সেই সেই বিষয়ই ফেডারেশনের এখতিয়ারে দেওয়া হয়। এই মূলনীতি অনুসারে অখÐ ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য ছিল। পেশোয়ার হইতে চাটগা পর্যন্ত একই রেল চলিতে পারিত। কিন্তু পাকিস্তানে তা নয়। দুই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য তো নয়ই; বরঞ্চ সম্পূর্ণ পৃথক। রেলওয়ে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ট্রান্সফার করিয়া বর্তমান সরকারও তাই স্বীকার করিয়াছেন। টেলিফোন, টেলিগ্রাম, পোস্ট অফিসের ব্যাপারেও এ সত্য স্বীকার করিতেই হইবে।
তবে বলা যাইতে পারে যে, একুশ দফায় যখন কেন্দ্রটি তিনটি বিষয় দেবার সুপারিশ ছিল, তখন আমি আমার বর্তমান প্রস্তাবে মাত্র দুটি দিলাম কেন? এ প্রশ্নের জবাব আমি তিন নম্বর দফার ব্যাখ্যায় দিয়াছি। এখানে আর পুনরুক্তি করিলাম না। আর একটি ব্যাপারে ভুল ধারণা সৃষ্টি হইতে পারে, আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে প্রদেশ না বলিয়া স্টেট বলিয়াছি। ইহাতে কায়েমী র্স্বাথ শোষকরা জনগণকে এই বলিয়া ধোঁকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছে যে, স্টেট অর্থ আমি ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেট বা স্বাধীন রাষ্ট্র বুঝিয়েছি। কিন্তু তা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র বড় বড় ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলিয়া স্টেট্স বলা হইয়া থাকে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকে ফেডারেশন বা ইউনিয়ন বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মানী, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাদের প্রদেশসমূহকে স্টেট ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী আসাম ও পশ্চিম বাংলা প্রদেশ নয়, স্টেট। এরা যদি ভারতকে ইউনিয়নের প্রদেশ হইয়া স্টেট হওয়ার সম্মান পাইতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে এতটুকু নামের মর্যাদা দিতেই বা কর্তাদের এত এলার্জি কেন?
৩ নম্বর দফা : এই দফায় আমি মূল্য সম্পর্কে দুইটি বিকল্প বা অলটারনেটিভ প্রস্তাব দিয়াছি। এই দুইটি প্রস্তাবের যে কোন একটি গ্রহণ করিলেই চলিবে।
ক. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানেরজ ন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। এই ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সী কেন্দ্রের হাতে থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকিবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুই স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকিবে।
খ. দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সী থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে ইকটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে, দুই অঞ্চলে দুুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। এই দুইটি বিকল্প প্রস্তাব হইতে দেখা যাইবে যে, মুদ্রাকে সরাসরি কেন্দ্রের হাত হইতে প্রদেশে হাতে আনিবার প্রস্তাব আমি করি নাই। যদি আমার দ্বিতীয় আল্টারনেটিভ গৃহীত হয়, তবে মুদ্রা কেন্দ্রের হাতেই থাকিয়া যাইবে। ঐ অবস্থায় আমি একুশ দফা প্রস্তাবের খেলাফে কোন সুপারিশ করিয়াছি, এ কথা বলা চলে না।
যদি পাকিস্তানী ভাইরা আমার এই প্রস্তাবে রাজী না হন, তবেই শুধু বিকল্প অর্থাৎ কেন্দ্রের হাত হইতে মুদ্রাকে প্রদেশের হাতে আনিতে হইবে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভুল বুঝাবুঝির অবসান হইলে আমাদের এবং উভয় অঞ্চলের সুবিধার খাতিরে পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইরা এই প্রস্তাবে রাজি হইবেন। আমরা তাঁদের খাতিরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ত্যাগ করিয়া সংখ্যাসামান্য মানিয়া লইয়াছি। তাঁরা কি আমাদের খাতিরে এতটুকু করিবেন না? (চলবে)
লেখক: শিশু সাহিত্যিক, বঙ্গবন্ধু গবেষক ও প্রাবন্ধিক