নেতা কেন লন্ডনে ?

117

দুবাই থাকাকালে আমাদের কোম্পানিতে আসা কিছু পাকিস্তানি মোহাজের যুবকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। তারা খানিকটা উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা করতো। জনৈক পাকিস্তানি কলিগ থেকে জানতে পেরেছিলাম এরা এম কিউ এম এর লোক। করাচিকে এরা ত্রাসের নগরী বানিয়ে রেখেছে। তাদের নেতা আলতাফ হোসেন দীর্ঘকাল ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। লন্ডন থেকেই টেলিফোনে বক্তব্য দিয়ে সেই বক্তব্য লাউড স্পিকারে দিয়ে হাজার হাজার লোককে শোনানোর ব্যবস্থা করে থাকে এম কিউ এম। এখন অবশ্য সরাসরি ভিডিও কনফারেন্স করে থাকেন। এই বাকপটু নেতা তার বক্তব্যের মাঝে কখনো হাসেন, কখনো কাঁদেন। সারা করাচিজুড়ে এই এম কিউ এম (মোহাজের কওমি মুভমেন্ট) এর ছেলেরা ব্যবসায়িদের নাকে দম করে রেখেছে বলে জানালো পাকিস্তানের অন্য লোকেরা। পাকিস্তানে করাচিসহ যেখানে যেখানে মোহাজের আছে সবাই এম কিউ এম আর চির কুমার আলতাফ হোসেন ছাড়া কিছুই বোঝে না। আমি প্রশ্ন করেছিলাম তাদের কাছে, তোমাদের নেতা দেশের বাইরে কেন ? তারা উত্তরে বলেছিল- উনি দেশে আসলে মেরে ফেলা হবে, তাই দেশে আসছেন না। আমি বললাম, বন্ধুরা কিছু মনে না করলে বলি, আমি বাংলাদেশের লোক। তারা বলল, না রাগ করবো কেন ? বলো। আমি সুযোগ হাতছাড়া না করে বললাম, তোমাদের নেতার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি এরকম নেতা দিয়ে তোমাদের কিছুই হবেনা। উনি ব্যবসায়িদের চাঁদার টাকাই লন্ডনে বিলাসী জীবন-যাপন করবে, ব্যবসা করবে, অর্থের পাহাড় গড়বে, আর তোমরা খুন-খারাবি করে ভাই হারাবে, সন্তান হারাবে, বাপ হারাবে। তারা ড্যাপ ড্যাপ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রলো। যিনি আপনা জানের মায়া করবেন, মৃত্যুকে ভয় পাবেন, দেশ থেকে দূরে থাকবেন, নেতা কর্মীদের জেল জুলুম আর মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন তিনি কিসের নেতা ? কেমন নেতা ? আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭১ এ পালিয়ে যেতে পারতেন। নিজের জানের মায়া, পরিবারের মায়া ছেড়ে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে মৃত্যু পরওয়ানা মাথায় নিয়ে তিনি নিজ বাসায় অবস্থান করছিলেন। কারণ তিনি সাহসী নেতা ছিলেন, তার ভেতর প্রশ্নাতীত দেশপ্রেম ছিল। পাকিস্তানের কারাগারেও নানা হুমকি-ধামকি ভয়-ভীতিতে তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারেনি। তাই তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হতে পেরেছিলেন। জাতির পিতা হতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু পালাতে পারতেন কিন্তু তিনি পালাননি। কারণ তিনি বাঙালিদের নির্বাচিত নির্ভীক দৃঢ়চেতা সাহসী নেতা ছিলেন। তিনি তাঁর প্রাণের চেয়েও বেশি এইদেশ এবং জাতিকে ভালবেসেছিলেন। তাই স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতিরজনক তথা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়ে তিনি না পারেন আত্মসমর্পণ করতে, না পারেন পালাতে। এম কিউ এম এর ছেলেরা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রলো। নতুন আসা যুবকদেরকে মার্কেটিং লাইনে ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্ব আমাদের কয়েকজনের ওপর ছিল। এক মোহাজের ছেলেকে ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তেছিল। ছেলেটা পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী ছিল। আমার সাথে গাড়িতে বসলেই কথায় কথায় ধর্ম টেনে আনতো। আমি একদিন গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ চালিয়ে দিলাম। চুপ করে সে বসে রইলো আর ভাষণ শুনতে লাগলো। ভাষণ শেষে সে বলল-আচ্ছা স্যার, আমিতো কিছুই বুঝিনি তবে শুনতে খুব ভালো লেগেছে। না বুঝলেও দরাজ কণ্ঠ আর ভাষণের উঠা-নামা এতোই আকর্ষণীয় ছিল যে আমার শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেছিল। জানতে পারি কী এটা কার ভাষণ শুনলেন ? আমি তার মন্তব্য শোনার জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি চালিয়েছিলাম। আমি বললাম, শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছো ? সে উৎসুক দৃষ্টি মেলে বলল-ইয়ে মুজিবর রহমান থা ? আমি উনার নাম শুনেছি, আজকে উনার ভাষণ শুনলাম। যদিও আমি কিছুই বুঝিনি। কিন্তু উনার কণ্ঠে জাদু আছে। এই ভাষণ বারবার শুনতে ইচ্ছা করে। আরেকটি ঘটনা বলি আমার প্রবাসজীবনের। আমার অফিসের টেবিলে ঢাকার একটি সাপ্তাহিকী স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা পড়েছিল যার প্রচ্ছদে ছিল তর্জনি উত্তোলিত বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ছবিখানা। কোম্পানির পাঞ্জাবি সুপারভাইজার আজহার জাবেদ ভাট এর নজর পড়তেই সে উল্লাসে চিৎকার করে বলল- আবে ইয়ে তো বঙ্গবন্ধু হ্যাঁয়। ( আরে এযে বঙ্গবন্ধু) আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বঙ্গবন্ধুকে চেনো ? সে চোখ কপালে তুলে বলল- ইতনা বড়া মশহুর লিডার কো কওন নেই জানতা, (এতবড় বিখ্যাত নেতাকে কে না চেনে ) উসনে তোমারা মুল্লুক বানায়া, তুম লোগোকো আজাদী দেলায়া, মাগার আফসোস ! তুম লোগ উস মহান হাস্তি কো মার ঢালা। আরে এক কওম কা লিয়ে আজাদী বহুত বড়া নেয়ামত হোতা হ্যাঁয়। (তিনি তোমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় তোমরাই ওই মহামানবকে হত্যা করেছো। একটা জাতির জন্য স্বাধীনতা এক বড় নেয়ামত)। একজন পাকিস্তানি পাঞ্জাবির মুখে আমি বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে বিস্ময়ে মুক হয়ে গেলাম। পাকিস্তানে পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচি, মাকরানি, বিহারী ও মোহাজের ইত্যাদি মিশ্র জাতির বসবাস। পাকিস্তানে মূলত মুসলিম লীগ ও পিপলস পার্টি’তেই ভোটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। বাকি জামায়াতে ইসলামী ও হালের তেহেরিকে ইনসাফ। যেমন বাংলাদেশে মূল দল দুটি আওয়ামী লীগ এন্ট্রি আওয়ামী লীগ। ভোটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় আওয়ামীলীগ বিএনপির মধ্যে। তারপর জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি বাকি সব ডট ডট। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ব্যতীত শান্ত পরিবেশে সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হলেও ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। মিডিয়ার কল্যাণে কোন কিছুই আর গোপন থাকছেনা। লন্ডন থেকে দল চালাতে গিয়ে তারেক রহমানের অনেক পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। বিএনপি ভাঙতে ভাঙতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হয়ে গেছে। ডা. বদরুদ্দোজা, কর্নেল অলি, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা প্রমুখগণ তো বিএনপি থেকে বের হয়ে নিজেরা দল গঠন করেছে সে অনেক আগে। পাকিস্তানে পাখতুনদের স্বপ্ন তারা তাদের অংশ নিয়ে পাখতুনিস্তান বানাবে। বেচারা পাঠানেরা পাঞ্জাবিদের জন্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারছেনা। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এশিয়ার অনেক অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী মানুষ স্বাধীনতার অমৃতস্বাদ থেকে বঞ্চিত। ভারতের শিখেরাও তাদের অংশ নিয়ে খালিস্থান বানানোর আন্দোলন করছে দীর্ঘদিন থেকে। সে তুলনায় বাঙালি জাতি অনেক সৌভাগ্যবান জাতি। বঙ্গবন্ধুর মত একজন নেতা পেয়েছিলেন বলে। এ কে ফজলুল হক, শহীদ সরওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানিসহ আগে আরও অনেক নেতা আমরা পেয়েছি। উনারা আমাদেরকে স্বাধীনতার সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু স্বাধীনতার সিঁড়ি ডিঙ্গাতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বর্তমানে তাঁর সুযোগ্য কন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বলে খ্যাত বিএনপি এখন অপরিপক্ষ ও দুর্বল নেতৃত্বের হাতে মার খেতে খেতে লবেজান দশা। পলাতক নেতা তারেক রহমানের দেশে এসে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা অসম্ভব, তাই পাকিস্তানি এম কিউ এম লিডার আলতাফ হোসেনের পথ অনুসরণ করে নেতা-কর্মীদের জ্বলন্ত উনুনে নিক্ষেপ করেছেন তিনি। নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের মাঝে আস্থাহীনতা, প্রচার বিমুখিতা, স্ববিরোধী বক্তব্যসহ নানা অসংগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অনেক জায়গায় তারা পোলিং এজেন্ট দিতেও ব্যর্থ হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে তাদের স্বেচ্ছাসেবকদের দেখা গেছে হতাশ।
বিএনপি নেতা মওদুদ সাহেবের ফাঁস হওয়া টেলিফোনে জানা গেল, নির্বাচনে গিয়েছিল তারা আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করার জন্য জেতার জন্য নয়। তাহলে বোঝা যাচ্ছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলন জ্বালাও-পোড়াও করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে তাদের নেত্রীকে মুক্ত করা। তারেক জিয়ার মামলা প্রত্যাহার করা ইত্যাদি। জনগণ হতাশ। জনগণ এখন অধিকাংশই কোন দলের পক্ষে নেই। তারা এখন উন্নয়নের পক্ষে। দেশের পক্ষে। আমরাও ব্যতিক্রম নই।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক