নির্মাণ শ্রমিকের নিরাপদ কর্মপরিবেশ কতদূর?

70

ইফতেখার উদ্দিন

দুর্ঘটনায় নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যুর খবর প্রায় প্রতিদিনের। কেউ সুউচ্চ ভবন থেকে নিচে পড়ে মারা যাচ্ছে, কারো মাথায় লোহার রড বিঁধে যাচ্ছে-পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখা যাচ্ছে এ ধরনের ঘটনা। মাসখানেক আগে চট্টগ্রামের হালিশহরে সুমন নামের এক নির্মাণ শ্রমিকের ঝাঁপসা করে দেয়া বীভৎস ছবি চোখে পড়লো পত্রিকায়। চারতলা একটি ভবনে কাজ করতে গিয়ে নিচে পড়ে যান এ নির্মাণ শ্রমিক। ভবনের নিচে অপর একটি স্থাপনার লোহার রড তাঁর মাথার পেছন দিয়ে ঢুকে কপাল দিয়ে বেরিয়ে যায়। গেঁথে থাকা রডসহ তাকে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ছবিটি দেখলে যে কারো মনে হতে পারে যাদের শ্রমে ঘামে দেশের সব কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, মানুষের আবাসসহ নানা ধরনের অট্টালিকা গড়ে উঠছে তাদের জীবনের মূল্য যেন একেবারে ঠুনকো বিষয়।
নির্মাণ শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য দেশে আইন আছে। কিন্তু এসব আইনের বাস্তবায়ন যাদের করার কথা তাদের ইচ্ছা, সামর্থ দু’টোরই অভাব। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দেয়া হলেও তদারকি চালানোর মতো জনবল, সক্ষমতা এসব প্রতিষ্ঠানের নেই। যার কারণে দেশের ৩৮ লাখেরও বেশি নির্মাণ শ্রমিককে ঝুঁকিতে রেখে দায়সারাভাবে চলছে গুরুত্বপূর্ণ এ সেক্টর, বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি।
দেশে নির্মাণ শ্রমিকের স্থায়ী চাকরি নেই বললেই চলে। ঠিকাদারদের মাধ্যমে দৈনিক মজুরী ভিত্তিতে তারা কাজ করেন। শহর এলাকায় একজন পূর্ণাঙ্গ কাজ জানা নির্মাণ শ্রমিক দৈনিক ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা মজুরী পান। কিন্তু তাদের সহকারী হিসেবে যারা কাজ করেন তাদের মজুরী দৈনিক ৪০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা। গ্রামে-গঞ্জে আরো কম দৈনিক মজুরীতে নির্মাণ শ্রমিকদের কাজ করতে হচ্ছে।
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবা এবং নিরাপত্তা সুবিধা প্রতিটি শ্রমিকের বৈধ আইনগত অধিকার হলেও এ বিষয়ে শ্রমিকদের সচেতনতা খুবই কম। যার কারণে একজন ঠিকাদার বেশি মুনাফার আশায় শ্রমিকদের কোন ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করছেন। অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করলে নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরীও আটকে দেয়া হচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী, কাজের সময় একজন শ্রমিকের মাথায় হেলমেটসহ কাজের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারের কথা। কিন্তু এ নিয়ম মানার বালাই একেবারেই নেই। রাস্তাঘাটে হাঁটলেই চোখে পড়ে কোন ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই বাঁশের সরু মাচার ওপর দাঁড়িয়ে সুউচ্চ ভবনে কাজ করছেন শ্রমিকরা। পিঠে নিরাপত্তার জন্য বেল্ট বা রশি কিছুই বাঁধা নেই। কংক্রিট আর সিমেন্টের ঢালাইয়ের কাজ করছেন অথচ হাতে গ্লাবস নেই। চোখে চশমা ছাড়াই করছেন ওয়েল্ডিংয়ের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। লোহার রডসহ নানা সামগ্রী নির্মাণাধীন ভবনে এমনভাবে ছড়িয়ে রাখা হয় যে একটু অসাবধান হলেই ঘটবে দুর্ঘটনা।
বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসেবে গেল ছয়বছরে কেবল রাজধানীতেই প্রায় সাড় ছয়শ’ জন নির্মাণ শ্রমিক কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা এর কয়েকগুণ, যাদের অনেককেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। এ ধরণের হতাহতের ঘটনায় অধিকাংশ নির্মাণ শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পান না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে নামেমাত্র সহযোগিতা করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। মৃত্যুর ঘটনায় অনেকক্ষেত্রে মামলাও হয় না। যার কারণে সুরক্ষা ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করে যারা মৃত্যুফাঁদ তৈরি করেন তারা পার পেয়ে যান। দুর্ঘটনাপ্রবণ খাত হওয়ার পরও নির্মাণ শিল্পের এ অবস্থা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।
এটা ঠিক যে, নির্মাণ খাতের বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শ্রমিকদের সুরক্ষাসহ ইমারত আইন মানার প্রবণতা বেড়েছে। তবুও ইমারত শ্রমিকদের নিয়ে এখনো অনেক কিছু ভাবার আছে। নির্মাণ শ্রমিকদের প্রশিক্ষিত করা গেলে সার্বিকভাবে ঝুঁকি কমবে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কী কী ধরনের নিরাপত্তাসামগ্রী দরকার, বিপজ্জনক কাজ কিভাবে করলে ঝুঁকি কমে এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ জরুরি। নির্মাণ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। ইট-বালি-সুরকির যে ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে অস্বাস্থ্যকর। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়িয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি কিভাবে কমানো যায় সে চেষ্টা জরুরি। নির্মাণ শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হন। অনেক নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করার সময় প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়ার মতো শৌচাগারের ব্যবস্থাও রাখা হয় না। দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে কাজ করা বিশাল এ জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষার কথাটিও ভাবতে হবে। একজন শ্রমিকের মৃত্যু হলে, অঙ্গহানি হলে, অসুস্থ হলে কিংবা অবসরে গেলে তাঁর পরিবার কিভাবে চলবে সেটি ভাবা নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্বে পড়ে।

লেখক : সংবাদকর্মী