নির্মমতায় নয়, সুশিক্ষা ও মমতায় বড় হোক শিশুরা

163

দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট, বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, “সমাজ কীভাবে শিশুদের প্রতি আচরণ করে তার মধ্য দিয়ে সমাজের চেহারা ফুটে ওঠে।’’ জাতির ভবিষ্যৎ শিশুদের আমরা কিভাবে গড়ছি, তা কী কখনও ভেবে দেখেছি? শিশুরা সাধারণত অনুকরণ প্রিয়। তারা যা দেখে, তা শিখে। ভাবুন তো, আমাদের সমাজে যে নির্মমতা, অনাচার, পাপাচার চলছে, তারমধ্যে বেড়ে ওঠছে শিশুরা। কদর্যরূপ দেখে যারা বড় হচ্ছে, তারা জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে কী? নিশ্চয় কখনও পারবে না। তাই শিশু মনোবিজ্ঞানী জেমস্ বেডউইন বলেছেন,“শিশুরা হচ্ছে ভেজা মাটির মতো, এর উপর যা কিছুই পতিত হয় তার ছাপ ফুটে ওঠে”। যদি সুন্দর ভবিষ্যৎ আমরা প্রত্যাশা করি, তবে শিশুদের সুশিক্ষা ও মমতায় গড়তে হবে।
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। শ্রেষ্ঠদের সবকিছু হবে শ্রেষ্ঠ। সে হিসেবে মানুষের চলাফেরা, আচার-ব্যবহার, আখলাক-চরিত্র, রুচিবোধ, সৃজনশীলতা, মননশীলতা -সবকিছু শ্রেষ্ঠ হবে, এটাই স্বাভাবিক। সারাবিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তারের ফলে মানুষ নিত্য-নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে দিন দিন উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে সেই শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রাখছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষ দিন দিন সভ্য হচ্ছে। অন্যদিকে গুঁটিকয়েক মানুষের মানবতা বিবর্জিত কর্মকাÐের ফলে মানব সভ্যতাকে লজ্জায় নুয়ে যেতে হচ্ছে। আধুনিক বিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহ, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ, দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, নারী-শিশু নির্যাতন প্রভৃতি বিভীষিকাময় চিত্রে মনে হয়- মানুষ সভ্য নয়, বরং দিনদিন অসভ্য বর্বর পশুতে পরিণত হচ্ছে।
সারাবিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। রাজনৈতিক নানা কারণে হয়তো কাক্সিক্ষত সুফল জাতি পাচ্ছে না। তবুও শিক্ষাখাতে আমাদের অর্জন ঈর্ষণীয়। একটা সময় ছিল যখন শিক্ষা অর্জনের বিষয়টা অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কালক্রমে মানুষের উপলব্ধি হলো, শিক্ষা এমন একটি বিষয় যা সবার জন্য প্রয়োজন। শিক্ষা ছাড়া মানুষ অন্ধের শামিল। এখন শিক্ষার অনেক দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, সেই সঙ্গে শিক্ষা অর্জন হয়েছে আগের তুলনায় সহজতর। শিক্ষার হার বাড়ছে, সেই সাথে শিক্ষিত লোকের নৈতিক স্খলনও বাড়ছে। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘স্বশিক্ষিত লোক মাত্রই সুশিক্ষিত’। যে শিক্ষা মানুষকে মানুষের মত মানুষ হওয়া শেখায়, সেটাই সুশিক্ষা। তাই সুশিক্ষাটাই প্রত্যাশিত। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সুশিক্ষার অনুপস্থিতি প্রকটতর। ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষা তথা সুশিক্ষার অভাবের ফলেই আজ শিক্ষকের নিকট ছাত্র-ছাত্রীরা নিরাপদ নয়। প্রতিদিন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের ধর্ষণ-যৌন নিপীড়নের খবরে আমরা শিউরে উঠি। তারচেয়ে মারাত্মক অবস্থা বিরাজ করছে বাচ্ছাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে। প্রতিদিন শিশু নির্যাতন, যৌন নিপীড়নের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যা সভ্যতা-ভব্যতার জন্য কলঙ্কজনক। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বর্তমানে আমাদের দেশেও শিশু নির্যাতনের এ ব্যাধি ভাইরাসের ন্যায় অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পিতা-মাতা, অভিভাবকবৃন্দ সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। চারিদিকে এক অসহনীয় পরিবেশ। এমতাবস্থায় মুক্তির একমাত্র পথ ইসলামের প্রকৃত শান্তির বাণী প্রচার-প্রসার ও অনুসরণ। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যেহেতু মুসলমান, সেহেতু ইসলামের সেই শান্তির বাণী অন্তরে ধারণ ও পালন করার মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে উত্তোরণ করাও সম্ভব। ইসলাম সর্বজনীন ও মানবতার ধর্ম। ইসলাম ধর্মে সমাজের উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড় সকল শ্রেণীর মানুষের অধিকার এবং কর্তব্যের কথা রয়েছে। বিশেষ করে শিশুর প্রতি আচরণ সম্পর্কে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শিশুকে স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান দেখায় না সে আমাদের দলভুক্ত নয়’। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)নিজে যেমন শিশুদের আদর করতেন, তার উম্মতকেও শিক্ষা দিয়ে গেছেন- শিশুদের আদর করতে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নাতি হাসান (রা.)কে চুমু খেলেন। সেখানে আকরা ইবনে হাবিস নামে এক সাহাবী বসা ছিলেন। হাসান (রা.)কে চুমু খাওয়া দেখে তিনি বললেন, আমার দশটি সন্তান রয়েছে। আমি তাদের কাউকে চুমু খাইনি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হবে না। -(সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৬৫১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২১৯)। নিজের সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে সব শিশুর প্রতি আমাদের স্নেহ ও ভালোবাসা দেখাতে হবে। বিশেষ করে যেসব শিশুর বাবা বেঁচে নেই কিংবা বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই, সেসব অনাথ শিশুদের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ প্রকাশ করতে হবে। তাদের খোঁজখবর নিতে হবে এবং প্রয়োজনে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘আমি এবং এতিমের প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব। একথা বলে তিনি তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলির মধ্যে সামান্য ফাঁক রাখলেন। বোখারী : ৪৯৯৮)। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেবল শিশুদের ভালোবেসেই ক্ষান্ত হননি, তিনি তাদের খোঁজখবরও নিতেন। মাঝে-মধ্যে তাদের সাথে রসিকতাও করতেন। অনেক সময় ঘোড়া সেজে নাতি হাসান (রা.), হোসেন (রা.)কে পিঠে নিয়ে মজা করতেন। স্বাভাবিকভাবে ছোট বড়কে সালাম দিবে, এটাই নিয়ম। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বড়রা ছোটদের সালাম দিবে না। হযরত আনাস (রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আনসারদের সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতেন তখন তাদের শিশুদের সালাম দিতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন এবং তাদের জন্য দুআ করতেন। -(সুনানে কুবরা নাসাঈ, হাদীস ৮২৯১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪৫১)। অন্য হাদিসে হযরত ইউসুফ ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ( শৈশবে) আমার নাম ইউসুফ রেখেছেন। তিনি আমাকে তাঁর কোলে বসিয়েছেন এবং আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন।-(আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৩৬৭)। নামাযের মত মহান ইবাদতেও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিশুদের প্রতি খেয়াল রাখতেন। তিনি বলেন, আমি কখনো নামায দীর্ঘ করার ইচ্ছা করি। কিন্তু কোনো শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনে নামায সংক্ষিপ্ত করে ফেলি। কেননা বাচ্চার কান্নার কারণে মায়ের কষ্ট হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৭৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬১০; সহীহ ইবনে খুযায়মা ৯৮৯, সুনানে ইবনে মাজাহ ৯৮৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২১৩৯)। আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদায় গিয়েছেন আর হাসান বা হুসাইন রা. তাঁর পিঠে চড়ে বসেছেন। ফলে তিনি দীর্ঘ সময় সিজদায় থাকতেন। (অপেক্ষা করতেন কখন তারা পিঠ থেকে নামবে)। (সুনানে নাসাঈ, হাদীস ১১৪১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭৬৮৮; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৪৭৭৫)। হাদীসের কিতাবে আরো অনেক ঘটনা আছে। সেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মত দাবিদার হয়ে আজ যারা শিশুদের অপহরণ ও পাশবিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করছে, তারা কখনো মুসলমান হতে পারে না। মুসলমানের আদর্শ তা নয়। নবীর উম্মত হিসেবে সবার উচিত তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে শিশুদের আদর-যতœ ও স্নেহ-ভালোবাসা প্রদান করা বিশেষ করে অসহায় ও অনাথ শিশুদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। হযরত আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে হাজির হয়ে বলল, আমার অন্তর বড়ই কঠিন। তিনি বললেন, তুমি কি তোমার অন্তর কোমল করতে চাও? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে এতিম বাচ্চাদের আদর কর, স্নেহ-ভালোবাস প্রদান কর, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, তাদের খাবার খাওয়াও। তবেই তোমার অন্তর কোমল হবে। কত সুন্দর ইসলামী বিধান। অন্তর নরম করার জন্য শিশুদের স্নেহ-ভালোবাসা দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন নবীজী। আর সেই নবীর উম্মত দাবি করে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা বা দয়াহীনতা দেখিয়ে আমাদের সমাজকে কলঙ্কিত করছে গুটিঁকয়েক পাপাচারি। মনে রাখবেন, হৃদয়হীন বা নির্দয় ব্যক্তি সবচেয়ে বড় হতভাগ্য। তার প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে না। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কেবল হতভাগ্য ব্যক্তির হৃদয় থেকেই দয়া তুলে নেয়া হয়’। (তিরমিজি-১৯২৩) তাই যারা শিশু নির্যাতন করে তাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়। শিশুর প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসাপূর্ণ আচরণের প্রতি ইসলাম ধর্মে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই যদি সত্যিকারভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত হয়ে থাকলে, তবে নবীর দেয়া সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত হোন। এ পৃথিবীতে জাতির ভবিষ্যৎ শিশুদের আবাদযোগ্য রূপে গড়ে তুুলুন। নিজের সন্তানের ন্যায় পরের সন্তানকেও স্নেহ-ভালোবাসা দিন। তবে আপনার সন্তানও অন্যের স্নেহ-ভালোবাসা, মমতা পাবে। তাই আর নির্মমতা নয়, শিশুরা বড় হবে সুশিক্ষা ও মমতায়।
ইতি টানছি ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের একটি উক্তি দিয়ে , তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা আজকের দিনটি উৎসর্গ করি যেন আমাদের শিশুরা একটি সুন্দর আগামী পেতে পারে।’’

লেখক: প্রাবন্ধিক